ই-বর্জ্যের হেলায় হারানো সম্ভাবনা
ঢাকার সাভারের জেআর রিসাইক্লিং সলিউশন্স এর স্থাপনায় ইলেকট্রিক যন্ত্রাংশ বাছাইয়ের কাজ করছিলেন দুই দল কর্মী। সুরক্ষা সরঞ্জাম পরে একদল রাবারের ইনসুলেশন থেকে তামার তার আলাদা করছিলেন; আরেকদল ব্যস্ত ছিলেন কম্প্রেশার এয়ারগান দিয়ে স্মার্টফোনের স্ক্রু খোলায়।
এভাবে পুরনো ও বাতিল এসব পণ্য খুলে সেখান থেকে সংগ্রহ করা হচ্ছিল অ্যালুমিনিয়ামের চাকতি, ধাতব স্ক্রু ও প্লাস্টিক। স্যামসাং বাংলাদেশের উচ্চ মানের হ্যান্ডসেট তৈরির কারখানা থেকে এসব বাতিল পণ্য জেআর রিসাইক্লিং সলিউশন্সে পাঠানো হয়েছে। কারণ, পুরোনো জিনিস খুলে আহরণ করা উপকরণের আছে পুনর্ব্যবহার মূল্য (রিসাইক্লিং ভ্যালু)/ বা উপযোগিতা।
জেআর রিসাইক্লিং সলিউশন্স- এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএ হোসেন বলেন, 'একটি স্মার্টফোন সম্পূর্ণ খুলে প্রায় ২০০ টাকা মূল্যের ২৬ ধরনের আইটেম পাওয়া যায়'।
শেডের নিচে বেশকিছু কাঠের বাক্সে রাখা ছিল– এভাবে সংগ্রহ করা বিভিন্ন ধরনের আইটেম, যার বেশিরভাগই ছোট্ট আকারের, আর চকচকে। এমন সময় গুদাম থেকে প্লাস্টিকের একটি কনটেইনার নিয়ে সেখানে হাজির হলেন সাইট ইঞ্জিনিয়ার নকিব উদ্দিন। বাক্সটি অর্ধেক ভরা ছিল সোনার মতো চকচকে সোনার আবরণ দেওয়া পিন ও কানেক্টর দিয়ে। এগুলো বাটারফ্লাই নামেও পরিচিত, আর ব্যবহার করা হয় টেলিযোগাযোগ টাওয়ারগুলোর ইলেকট্রনিক সার্কিটে।
আরেকটি ক্রেটে ছিল, রুপার আবরণ দেওয়া ওয়াশার- এর স্তূপ।
স্থানীয় একজন ব্যবসায়ী সেখানে এগুলো কিনতে এসেছিলেন।
এমএ হোসেন বলেন, 'বাজারে তামার দাম প্রতিকেজি ৫৪০ টাকা। কিন্তু, পণ্যে রুপার প্রলেপ থাকায় এই ব্যবসায়ী ১,৫০০ টাকা (কেজিতে) দিতে চাইছেন'। যদিও এগুলির রপ্তানি মূল্য আরো বেশি। তাই ঐ ব্যবসায়ীর প্রস্তাব করা দামে 'কখনো বিক্রি করব না' বলে উল্লেখ করেন তিনি।
জেআর সলিউশন্স-সহ বাংলাদেশের ছয়টি কোম্পানি পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার লাইসেন্স পেয়েছে, যার আওতায় তারা সংগ্রহ করা আইটেমগুলো রপ্তানি করতে পারে।
এদের মধ্যে, ২০১১ সালে যাত্রা শুরু করে জেআর রিসাইক্লিং সলিউশন্স। কোম্পানিটি পুনরুদ্ধার করা আইটেম রপ্তানি করে। তাদের বেশিরভাগ রপ্তানিই হয়– জাপান ও কাতারে। বার্ষিক টার্নওভার প্রায় ৩০ কোটি টাকা। তবে ব্যবসার এই পরিসরে সন্তুষ্ট নন এমএ হোসেন, কারণ দেশে যে বিপুল পরিমাণ ই-বর্জ্য প্রতিবছর তৈরি হচ্ছে, তার সামান্য অংশ্যই সংগ্রহ করতে পারছে সনদপ্রাপ্ত ই-বর্জ্য রিসাইকেল কোম্পানিগুলো।
অপরদিকে, এই বাজারের সবচেয়ে বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করছে ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীরা। তারা সরাসরি চীনে স্ক্র্যাপ বা ভাঙ্গারি হিসেবে রপ্তানি করে। ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা, ২০২১ এর শিথিল প্রয়োগই এজন্য দায়ী বলে জানান হোসেন।
অব্যবহৃত রয়ে যাওয়া অমিত সম্ভাবনা
২০১৮ সালে সেন্টার ফর এনভায়রোমেন্টাল আন্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট (সিইআরএম) এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) যৌথভাবে– ই-বর্জ্য তৈরির পর্যালোচনা, বাংলাদেশে এর পরিবেশগত প্রভাব ও সম্পদ পুনরুদ্ধার সম্ভাবনা– শীর্ষক বেজলাইন সমীক্ষা পরিচালনা করে। এই গবেষণার তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতিবছর ৪ লাখ টন ই-বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। ২০৩৫ সালে নাগাদ যার পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৬ লাখ ২০ হাজার টন। অর্থাৎ, বার্ষিক ২০ শতাংশের মতো উচ্চ হারে বাড়ছে ই-বর্জ্য।
অন্যদিকে, সোনা, রুপা, প্ল্যাটিনাম, প্যালাডিয়াম, নিডোমিয়ামসহ অন্যান্য দামি ধাতু থাকায় ই-বর্জ্যকে 'আরবান মাইন' বলা হয়। এরমধ্যে পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর সীসার মতো ধাতুও রয়েছে। পরিবেশ-সম্মত কার্যকর উপায়ে এসব ধাতু সংগ্রহ করা গেলে ই-বর্জ্য পরিণত হবে একটি মূল্যবান সম্পদে।
২০১৮ সালের বেজলাইন সমীক্ষাটি জানায়, ১ টন হ্যান্ডসেটে থাকে সাড়ে তিন কেজি রুপা, ৩৪০ গ্রাম সোনা, ১৪০ গ্রাম প্যালাডিয়াম এবং ১৩০ কেজি তামা।
ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালায় ই-ওয়েস্ট সৃষ্টিকারী প্রতিষ্ঠান, আমদানিকারক, ব্যবসায়ী, সবশেষ স্তরের ভোক্তা এবং এসব পণ্যের মেরামতকারীদের নিজস্ব খরচে ই-বর্জ্য অনুমোদিত হ্যান্ডলার (রিসাইক্লিং) প্রতিষ্ঠানের কাছে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। এতে আরো বলা হয়েছে, এরপর অনুমোদিত প্রতিষ্ঠান পর্যাপ্ত সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়ে এসব পণ্য খুলে বা পৃথক করে পরিবেশ-সম্মত উপায়ে রিসাইকেল করবে।
তবে এই বিধির প্রয়োগ নেই সেভাবে। ই-বর্জ্যের জন্য সুনির্দিষ্ট ডাস্টবিনের প্রচলনও বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠা পায়নি। এছাড়া, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও বাসাবাড়ি থেকে এটি সংগ্রহের চ্যানেলও নির্ধারণ করা হয়নি। ফলে অনুনোমোদিত ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীরাই নিয়ন্ত্রণ করছেন পরিবেশের জন্য উচ্চ ঝুঁকিপূর্ণ এবং একইসাথে অব্যবহৃত রয়ে যাওয়া অমিত সম্ভাবনার ই-বর্জ্যের ব্যবসা।
আন্তর্জাতিক কমপ্ল্যায়েন্সের আওতায়, বহুজাতিক টেলিকম অপারেটররা নিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানের কাছে তাদের ই-বর্জ্য দিলেও, বেশিরভাগ সরকারি সংস্থা এক্ষেত্রে উন্মুক্ত দরপত্র প্রক্রিয়ায় যায়। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই প্রক্রিয়ায় সর্বনিম্ন দরদাতা ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে না নিবন্ধিত ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপক কোম্পানি।
এমএ হোসেন বলেন, ভাঙ্গারি ব্যবসায়ীরা ই-বর্জ্য থেকে মূল্যবান ধাতু সংগ্রহে সস্তা ও ক্রুটিপূর্ণ পদ্ধতির আশ্রয় নেয়। এতে ব্যাপক পরিবেশ দূষণ এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি তৈরি হয়'। এছাড়া, চীনে ই-বর্জ্য রপ্তানিতে তাদের যথাযথ নিবন্ধনের দরকারও হয় না। অন্যদিকে, জাপানের মতো উন্নত দেশে রপ্তানি করতে হলে, আগে সব ধরনের সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা নিয়ে, পরিবেশগত সতর্কতা অবলম্বন করে এবং যথাযথ নিবন্ধনের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক্স সরঞ্জাম বিচ্ছিন্ন ও তা থেকে সম্পদ আহরণ নিশ্চিত করতে হয়।
২০১৮ সালের সিইআরএম-বুয়েট এর সমীক্ষা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ই-বর্জ্যে থাকে সীসা, ক্যাডমিয়াম, পারদ, বেরিলিয়াম, ক্রোমিয়াম, আর্সেনিক, ক্লোরোফ্লোরোকার্বন (সিএফসি)-র মতো বিষাক্ত ও ক্ষতিকর উপাদান। আরো থাকে পলিব্রোমিনেটেড ডিফাইনিল ইথার এবং পলিব্রোমিনেটেড বাইফেনিল- এর মতো অর্গানিক উপাদান, যা দীর্ঘস্থায়ী পরিবেশ দূষণের কারণ হয়।
গবেষক দলের নেতৃত্বদানকারী ড. রওশন মমতাজ বলেন, 'বেশিরভাগ ক্ষেত্রে উন্মুক্ত পরিবেশে রাখা হয় ই-বর্জ্য। এতে বৃষ্টির পানিতে টক্সিক কেমিক্যাল নিঃসৃত হওয়ার ব্যাপক ঝুঁকি থাকে। এসব রাসায়নিক প্রথমে মাটিকে দূষিত করে, তারপর ধুলার সাথে পার্টিকেল ম্যাটার হিসেবে মিশে বাতাসকেও দূষিত করে'।
পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক এই বর্জ্যকে সম্ভাবনাময় ব্যবসায় পরিণত করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করছেন জেআর রিসাইক্লিং সলিউশন্স এর এমডি এমএ হোসেন।
'ই-বর্জ্য হ্যান্ডলিং ও রপ্তানির মাধ্যমে বাংলাদেশ বছরে ৮০ মিলিয়ন ডলার আয় করতে পারবে। প্রাথমিক এক হিসাব অনুসারে, এই ব্যবসায় অন্তত ৫০ হাজার মানুষের কর্মসংস্থান তৈরি হতে পারে। কিন্তু, আমরা এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারছি না'- আক্ষেপ করেই বললেন তিনি।
সরকারি পদক্ষেপের অন্তহীন বিলম্ব
পরিবেশসম্মতভাবে ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং এই ব্যবসার রপ্তানি সম্ভাবনাকে সুবিধা দিতে– নিবন্ধিত ব্যবস্থাপক কোম্পানিগুলো দীর্ঘদিন ধরেই সরকারের কাছে অবিলম্বে ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা বিধিমালা বাস্তবায়নের অনুরোধ করে আসছে।
২০১১ সালে প্রথম খসড়া প্রস্তুতের পর– এটি কার্যকর করতে প্রায় ১০ বছর লেগে যায় সরকারের। জানা যায়, এনিয়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) কিছু উদ্বেগ থাকায় এই বিলম্ব হয়।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ডব্লিউটিও সেলের মহাপরিচালক মো. হাফিজুর রহমান জানান, বাংলাদেশে ইলেকট্রনিক্স রপ্তানিকারক বেশকিছু দেশ এই বিধিমালা বাস্তবায়ন অন্তত এক বছর পেছাতে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় লবি করে। আমরা এসব পণ্য উৎপাদনের সময় সীসা ব্যবহারের যে মানদণ্ড নির্ধারণ করেছিলাম– সেটাও তারা কমাতে বলে।
'ইতোমধ্যে আমরা এটি বাস্তবায়ন করার ক্ষেত্রে এক বছর দেরি করেছি। তবে সীসা ব্যবহারের মানদণ্ড কমানো হবে না বলে তাদের জানানো হয়েছে' বলেন তিনি।
উক্ত বিধিমালার আওতায়– ক্যাডমিয়াম, সীসা, পারদ, ক্রোমিয়াম-৬, পলিব্রোমিনেটেড ডিফাইনিল ইথার এবং পলিব্রোমিনেটেড বাইফেনিল, বিস(২-ইথাইলহেক্সিল) ফাথালেট, বুটাইল বেনজিল ফাথালেট এবং ডিসোবুটাইল ফাথালেট- এর মতো রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহারের সীমা আরোপ করা হয়েছে।
পাঁচ বছরের মধ্যেই দেশের অন্তত ৫০ শতাংশ ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার লক্ষ্য রয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তরের। এরমধ্যে বিধিমালা বাস্তবায়নের এক বছরের মধ্যেই ১০ শতাংশ অর্জনের লক্ষ্য রয়েছে। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার আপত্তির দিকগুলো নিরসন হলে, এই বিধিমালা দ্রুত বাস্তবায়নের আশা করা হচ্ছে। তবে ২০২১ সালের ১০ জুনের পর এক বছর পেরিয়ে গেছে। অথচ, বিধিমালা অনুসারে এখনও নির্ধারণ করা হয়নি ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার চ্যানেল।
পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক (বর্জ্য ও রাসায়নিক পদার্থ ব্যবস্থাপনা) রাজিনারা বেগম বলেন, 'বিধিমালায় বলা হয়েছে যে, স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষগুলো (সিটি কর্পোরেশন ও পৌরসভার) এটির প্রয়োগ নিশ্চিত করবে, আর পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে থাকবে পরিবেশ অধিদপ্তর'। এটি বাস্তবায়নের জাতীয় পর্যায়ের কমিটি গত বছরের ২৪ নভেম্বর প্রথমবারের মতো সভা করেছে বলেও জানান তিনি।
তবে ওই সভার বিস্তারিত জানাননি রাজিনারা বেগম।
বিধিমালায় বলা হয়েছে, দেশের ইলেকট্রনিক্স ব্যবসায়ীরা ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার গুরুত্বপূর্ণ সংশ্লিষ্ট পক্ষ। তারা উৎপাদক, সবশেষ ভোক্তা ও রিসাইকেল প্রতিষ্ঠানের মধ্য সংযোগ সেতুর কাজ করতে পারেন। অথচ এবিষয়ে কী হচ্ছে না হচ্ছে– তা নিয়ে প্রায় অন্ধকারেই রয়েছেন এ খাতের ব্যবসায়ীরা।
ই-বর্জ্য বিধিমালা বাস্তবায়নে তারা কীভাবে সহযোগিতা দেবেন, জানতে চাইলে বাংলাদেশ ইলেকট্রনিক্স ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আমিনুল ইসলাম বলেন, 'এবিষয়ে আমার প্রায় কিছুই জানা নেই। তাই কিছু বলতেও পারব না'।