কল্যাণ তহবিলে মুনাফার অংশ দিচ্ছে না কোম্পানীগুলো, উপেক্ষিত শ্রমিকেরা
কোম্পানীর মুনাফার একটি অংশ শ্রমিকের কল্যাণ তহবিলে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত বেশিরভাগ কোম্পানীই তা মানছে না।
দেশের শ্রম আইন অনুযায়ী, মুনাফার ৫% বছর শেষ হওয়ার ৯ মাসের মধ্যেই অংশগ্রহণ তহবিল, কল্যাণ তহবিল এবং বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে জমা দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
ঢাকা ডায়িং কোম্পানী ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ডে বিগত কয়েক বছরে ৮.১২ কোটি টাকা বরাদ্দ রেখেছে কিন্তু ফান্ড বিতরণ করেনি, ফাউন্ডেশনকেও দেয়নি।
জুট স্পিনার্স কোম্পানীতে এই ফান্ডের ১.৩৭ কোটি টাকা জমা থাকলেও শ্রম আইন অনুযায়ী ব্যবহার ও বিতরণ করেনি।
শুধু এরাই নয়, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত যেসব কোম্পানী নিয়মিত মুনাফা করছে, তাদের বড় অংশই শ্রমিকদের কল্যাণে ফান্ড গঠন, বিতরণ ও শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন– এ জমা দিচ্ছে না।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ বা ডিএসই সূত্রে জানা যায়, পুঁজিবাজারে তিন শতাধিক কোম্পানী তালিকাভুক্ত, যার বড় অংশ মুনাফা করছে। আর কিছু কোম্পানী লোকসানে রয়েছে।
শ্রমিক কল্যাণের ফান্ড ব্যবস্থাপনা, বিতরণ ও বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন- এ জমা না দেওয়ার বিভিন্ন অনিয়মের বিষয়ে আপত্তি তুলেছে নিরীক্ষক।
আপত্তির মধ্যে ফান্ডের যথেচ্ছা ব্যবহার, ব্যবহার করলেও ইন্টারেস্ট না দেওয়া, শ্রমিকদের মধ্যে ফান্ড বিতরণ না করা এবং কল্যাণ ফাউন্ডেশন- এ নির্দিষ্ট হারে টাকা জমা না দেওয়ায় শ্রম আইনের লঙ্ঘন পেয়েছে নিরীক্ষক।
২০২১-২২ অর্থবছরের আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষার পর কোম্পানীর শ্রম আইন লঙ্ঘনের বিষয়টি তুলে ধরে নিষ্পত্তি করার পরামর্শও দিয়েছে নিরীক্ষকরা।
বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন বলছে, আইন লঙ্ঘন করলেও জনবল সংকটে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না। ফলে শ্রমিকের কল্যাণের জন্য ফান্ডের কার্যকারিতা ফলপ্রসূ হচ্ছে না।
ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড এবং শ্রমিক কল্যাণ ফান্ড ট্রাস্টির মাধ্যমে আলাদা ব্যাংক হিসাবে ব্যবস্থাপনা হবে। আর শ্রমিকদের কল্যাণে গঠিত বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন ফান্ড সংগ্রহ করে ক্ষতিগ্রস্ত, আহত, কিংবা দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত শ্রমিকদের প্রদান করবে।
তালিকাভুক্ত অনেক কোম্পানীর শ্রম আইন পরিপালন না করার বিষয়টি জানিয়ে গত বছর বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনকে চিঠি দেয় শ্রম ও প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়।
মন্ত্রণালয়ের ওই চিঠির প্রেক্ষিতে, ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ড ও শ্রমিক কল্যাণ তহবিল গঠনের তথ্য চেয়ে গত বছরের এপ্রিলে তালিকাভুক্ত সব কোম্পানীকে আলাদা চিঠি পাঠিয়েছিল বিএসইসি।
বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬ এর ২৩৪ ধারা অনুযায়ী, কোম্পানিগুলিকে অবশ্যই এ দুটি তহবিল প্রতিষ্ঠা করতে হবে।
আইন অনুযায়ী, হিসাব বছরের শেষ দিনে পরিশোধিত মূলধনের পরিমাণ অন্যূন এক কোটি টাকা কিংবা স্থায়ী সম্পদের মূল্য অন্যূন দুই কোটি টাকা হলে কোম্পানী নীট মুনাফার ৫ শতাংশ শ্রমিকের কল্যাণ তহবিলে প্রদান করবে।
এর মধ্যে ৮০% অংশগ্রহণ তহবিলে, ১০% কল্যাণ তহবিল এবং অবশিষ্ট ১০% শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন তহবিলে যাবে।
কমিশন কর্মকর্তারা জানান, চিঠির প্রেক্ষিতে প্রায় একশ কোম্পানীর ফান্ডটির যথাযথ ব্যবস্থাপনা, ফান্ড গঠন না করা ও ফান্ডের অর্থ বিতরণ না করার তথ্য পাওয়া গেছে। আবার কিছু কোম্পানী জানিয়েছে, তাদের ফান্ডের অর্থ বিতরণ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
সিকিউরিটিজ সংক্রান্ত আইনের মধ্যে না পড়লেও মন্ত্রণালয়ের চিঠির প্রেক্ষিতে তালিকাভুক্ত কোম্পানীকে শ্রম আইন পরিপালনের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আইন লঙ্ঘন হলে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা অধিদপ্তর আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে পারবে।
বিএসইসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী-রুবাইয়াত উল ইসলাম বলেন, "শ্রম আইন মানছে না কিছু কোম্পানী, তাদেরকে বিধি অনুযায়ী ফান্ড গঠন ও পরিচালনার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। যারা নন-কমপ্লায়েন্স, তাদেরকে কমপ্লায়েন্স হতে বলা হয়েছে।"
দেশে প্রায় লক্ষাধিক কোম্পানী নিবন্ধিত। শ্রম মন্ত্রণালয়ের অধীন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের (ডিআইএফই) নিবন্ধিত শিল্পকারখানা প্রায় ৪০ হাজার।
বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন সূত্রে জানা যায়, ২০০৬ সাল থেকে মাত্র তিনশ কোম্পানী এ ফাউন্ডেশনে টাকা জমা দিয়েছে। এই ফান্ডে এখন পর্যন্ত প্রায় ৭০০ কোটি টাকা জমা হয়েছে।
নিবন্ধিত কোম্পানীর বড় অংশই টাকা জমা না দেওয়ায় প্রতি মাসেই কোম্পানীগুলোকে চিঠি দিচ্ছে ফাউন্ডেশন।
ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ড. মোল্লা জালাল উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "শ্রম আইন অনুযায়ী ফাউন্ডেশনে টাকা জমা দিতে কোম্পানীগুলোকে চিঠি দেওয়া হচ্ছে। তবে চিঠির প্রেক্ষিতে কেউ কেউ টাকা দিচ্ছে আবার অনেকে কর্ণপাত করছে না।"
তিনি বলেন, "ফাউন্ডেশনের জনবল কম হওয়ায় কোনো কোম্পানী ফান্ডে টাকা জমা না দিলেও ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না। শ্রম আইন লঙ্ঘনের বিষয়ে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের সহায়তা নেওয়া হচ্ছে। কারণ তারা নিয়মিত বিভিন্ন বিষয়ে কোম্পানী পরিদর্শন করে, শ্রমিক কল্যাণের টাকা জমা না দিলে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।"
অডিটরের ভাষ্য মতে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত আরামিট লিমিটেড শ্রম আইনের ২৩৪ ধারা অনুযায়ী, শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনে ৩.২২ লাখ টাকা জমা দেয়নি।
সোনালী আঁশ ইন্ডাস্ট্রিজ কোম্পানী ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ডে ৭০.৯৭ লাখ টাকা জমা রাখলেও এই টাকা বিতরণ করেনি।
কুইন সাউথ টেক্সটাইল মিলস এখনো এই ফান্ড গঠন করেনি। অন্যদিকে স্যাভলো কেমিক্যালস ফান্ড গঠন করলেও আলাদা ব্যাংক হিসাব নেই, কোম্পানীর মূল হিসাবে এই টাকা জমা করছে।
শতভাগ রপ্তানিমুখী প্রতিষ্ঠান প্যাসিফিক ডেনিম মুনাফার ৫% নিয়মিতভাবে বরাদ্দ রাখে কিন্তু শ্রমিকদের মধ্যে একটি টাকাও বিতরণ করেনি।
এসব কোম্পানীর কোনোটিই শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশনকে কোনো অর্থ দেয়নি।
সাইফ পাওয়ারটেক ফান্ড গঠন করলেও আলাদা ব্যাংক হিসাব নেই। ফু-ওয়াং ফুডস কোম্পানীও ওয়ার্কার্স প্রফিট পার্টিসিপেশন ফান্ডে কোনো বরাদ্দ রাখেনি, শ্রমিকদের মধ্যেও বিতরণ করেনি।
এদিকে শ্রম কল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গত আগস্টে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত চার কোম্পানী বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ তহবিলে সাত কোটি টাকা জমা দিয়েছে।
কোম্পানিগুলো হচ্ছে- মেঘনা পেট্রোলিয়াম, লাফার্জ হোলসিম, বিএসআরএম এবং লিন্ডে বাংলাদেশ।
লাফার্জ হোলসিম দিয়েছে ২.২৫ কোটি টাকা, বিএসআরএম ১.৯৯ কোটি টাকা, মেঘনা পেট্রোলিয়াম ১.৯১ কোটি টাকা ও লিন্ডে বাংলাদেশ ৭৮.৬৫ লাখ টাকার চেক জমা দেয়।