গ্যাসের চুলা স্বাস্থ্য ও পরিবেশের জন্য বিপজ্জনক, নিষিদ্ধ হচ্ছে আমেরিকায়!
যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, গ্যাসের চুলা থেকে প্রতিনিয়ত প্রাকৃতিক গ্যাসের প্রধান উপাদান মিথেন নির্গত হয়। ৪ কোটি গ্যাসের চুলা থেকে নির্গত এই গ্যাস পরিবেশের ওপর যে ক্ষতিকর প্রভাব রাখে তা পাঁচ লাখ গ্যাসচালিত গাড়ির দূষণের সমান। খবর দ্য ওয়াশিংটন পোস্টের
তবে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, চুলা না ধরালেও এই গ্যাস নিঃসরণ হতেই থাকে।
গবেষণাটির প্রধান গবেষক এরিক লেবেল বলছেন, 'গ্যাসের চুলা থেকে যে পরিমাণ মিথেন নির্গত হয়, এর ৭৫ শতাংশ চুলা বন্ধ থাকার সময়েই নির্গত হয়। খুব কম মনে হলেও দিনশেষে এই পরিমাণ বিশাল'।
সব মিলিয়ে বাড়িতে রান্নাবান্নার কাজে গ্যাস সংযোগকে দূষণের এক বড় উৎস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
তাছাড়া, মিথেন গ্যাস শুধু জলবায়ু পরিবর্তনেই প্রভাব ফেলে না, একইসঙ্গে গ্যাস চুলা নিঃসৃত ক্ষতিকর দূষিত কণার কারণে শ্বাসকষ্ট ও কার্ডিওভাসকুলার রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন কোটি কোটি মানুষ।
এদিক দিয়ে দেখলে গ্যাসের চুলা নীরব এক ঘাতক। জনস্বাস্থ্য ও পরিবেশ উভয়ের জন্যই যা ক্ষতিকর।
অনেক বছর ধরেই গোপন এই দূষণের দিকে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে যথেষ্ট বেগ পেতে হয়েছে বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য অধিকার কর্মীদের। তারা জানাচ্ছেন, যুক্তরাষ্ট্রে ৪ কোটি বাসাবাড়িতে গ্যাসের চুলা আছে, আর তাদের বায়ুদূষণের কারণে শিশুদের অ্যাজমা আক্রান্ত হওয়াসহ অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা বাড়ছে। মিথেন দূষণ আমাদের পৃথিবীকেও উষ্ণ করছে।
একারণে দেশটির বিজ্ঞানী ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা দূষণের উৎসটি নিষিদ্ধ করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের এ দাবি কর্তৃপক্ষের কাছে গুরুত্বও পেতে শুরু করেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের চারটি ভোক্তাপণ্য সুরক্ষা কমিশনের একটি গত সোমবার জানিয়েছে যে, তারা গ্যাস স্টোভ নিষিদ্ধের বিষয়ে ভাবছে। এছাড়া, লস এঞ্জেলস, সিয়াটল ও নিউইয়র্কের মতো বড় মহানগরীর কর্তৃপক্ষও নির্দিষ্ট কিছু বাসাবাড়ি ও এপার্টমেন্টে গ্যাস স্টোভ নিষিদ্ধ করেছে।
নিউইয়র্ক রাজ্যের গভর্নর পুরো রাজ্যেই স্টোভসহ গ্যাস চালিত অন্যান্য দূষণ উৎস বন্ধের প্রস্তাবও দিয়েছেন।
এর অন্যতম কারণ হলো– গবেষণায় দেখা গেছে সব ধরনের জ্বালানি পুড়িয়ে রান্নার কাজে বায়ুদূষণ হলেও, প্রাকৃতিক গ্যাসে মিথেনসহ অন্যান্য রাসায়নিক উপাদানও মিশ্রিত থাকে। তাই চুলা সচল থাকলে, এসব কেমিক্যাল পুড়ে তৈরি হওয়া সূক্ষ্মকণা (পার্টিকেল ম্যাটার বা পিএম) বাড়ির বাসিন্দাদের ফুসফুসে অনুপ্রবেশ করে। চুলা জ্বালানো অবস্থায় নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড ও ফর্মালডিহাইডের মতো গ্যাসও নিঃসৃত হয়, এগুলো বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা সৃষ্টি করে।
২০২০ সালে রকি মাউন্টেন ইনস্টিটিউটের (আরএমআই) প্রকাশিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব বাসায় গ্যাসের চুলা আছে সেখানকার বাতাসে নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইডের মাত্রা ৫০-৪০০ শতাংশ, কার্বন মনোক্সাইডের পরিমাণ ৩০ গুণ এবং পিএম ২.৫ এর পরিমাণ দ্বিগুণ বেশি।
প্রতিবার চুলা জ্বালালেই নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয়। এই গবেষণায় নতুন আরেকটি দিক উঠে এসেছে, তা হলো আগের ধারণার চেয়েও দ্রুত এই নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড উৎপন্ন হয়।
গবেষণাটির আরেকজন গবেষক ও স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রব জ্যাকসন বলেন, "চুলা জ্বালানোর সাথে সাথেই নাইট্রোজেন অক্সাইড ও দূষিত কণা তৈরি হতে থাকে।"
এমনকি প্রায় কয়েক মিনিটের মধ্যেই ঘরের বাতাসের দূষণ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্ধারিত ন্যূনতম নিরাপদ সীমা অতিক্রম করে।
আরেকটি গবেষণায় জানানো হয়, গ্যাসের চুলা থাকা বাড়িতে শিশুদের মধ্যে অ্যাজমা আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা ৪২ শতাংশ বেশি দেখা গেছে। আরো ২৪ শতাংশ শিশু একারণে তাদের জীবদ্দশায় যেকোনো সময়ে অ্যাজমা আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।
গত সপ্তাহে নিরাপদ জ্বালানি বিষয়ক মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক- আরএমআই এর বিজ্ঞানীরা এক পিয়ার রিভ্যিউড গবেষণাপত্রে জানান, ১২.৭ শতাংশ শিশুর অ্যাজমা আক্রান্ত হওয়ার সাথে তাদের বাড়িতে গ্যাসে চুলা থাকার ঘটনা জড়িত আছে। এজন্য অনেক বিজ্ঞানী বাসায় গ্যাসের চুলা থাকাকে, বাসায় একজন ধূমপায়ী থাকার সমান বিপজ্জনক বলে উল্লেখ করেছেন। যেহেতু পরোক্ষ ধূমপানে শিশু স্বাস্থ্যের ব্যাপক ক্ষতি হয়, তেমনি প্রতিনিয়ত গ্যাসের চুলার নিঃসরণও তাদের ক্ষতি করছে।
যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ সংরক্ষণ সংস্থা– এনভায়রোমেন্টাল প্রটেকশন এজেন্সি (ইপিএ)'র হাতে ভবনের অভ্যন্তরীণ বায়ুমান নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা নেই। তবে এনিয়ে সচেষ্ট ইউরোপীয় ইউনিয়ন। জোটটির আইনপ্রণেতারা এর সদস্য সব দেশে ইনডোর বায়ুমান নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা চালুর তাগিদ দিচ্ছেন।
গ্যাসের চুলার চেয়ে স্বাস্থ্যবান্ধব বিকল্প হলো বৈদ্যুতিক চুলা বা ইন্ডাকশন স্টোভ। প্রাকৃতিক গ্যাস শিল্প লবির নানান প্রচেষ্টার কারণে খুব ধীর গতিতে আমেরিকানরা এটি ব্যবহারে ঝুঁকছে। গ্যাস কোম্পানিগুলো এখনও তাদের গণসংযোগ প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তারা পিআর (গণসংযোগ) ফার্মগুলোর সাথে চুক্তিবদ্ধ হয়ে স্থানীয়ভাবে গ্যাস চালিত সরঞ্জাম নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে প্রচারণাও চালাচ্ছে। তাদের প্রতিনিধিদের সামাজিক মাধ্যমের গ্রুপগুলোতেও এনিয়ে সরব হতে দেখা গেছে।
কিন্তু, জলবায়ু পরিবর্তন ও রুগ্ন স্বাস্থ্যের সাথে গ্যাসের চুলা ব্যবহারের সম্পর্কটি স্পষ্ট হতে থাকায় মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ছে। একারণেই গ্যাসের চুলা নিষিদ্ধের আলোচনা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রে।
স্বাস্থ্য ঝুঁকির দিকটিই বেশি ভাবাচ্ছে কর্তৃপক্ষকে। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন প্রশাসনও বাসাবাড়িতে বৈদ্যুতিক হোম এপ্লায়েন্সের ব্যবহার বাড়াতে চায়। তাই গ্যাসের চুলা নিষিদ্ধ করে বৈদ্যুতিক চুলার প্রচলন হবে কিনা এ প্রশ্ন এখন অবান্তর। বরং কত দ্রুত হবে– সেটাই মূল প্রসঙ্গ।