ইউক্রেনের স্বেচ্ছাসেবী যোদ্ধারা বাখমুতের যুদ্ধে হিমশিম খাচ্ছে
৪৫ বছরের ইউক্রেনীয় নাগরিক রোমান ধূসর দাঁড়িগোঁফের অধিকারী। যুদ্ধ শুরুর আগে তিনি স্নানাগার নির্মাণের কাজ করতেন। এটাই ছিল তার পেশা, যুদ্ধের কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না তার। রোমান এখন স্বেচ্ছাসেবী যোদ্ধা হিসেবে লড়ছেন বাখমুতে, যেখানে রুশ বাহিনীর সাথে প্রচণ্ড লড়াই অব্যাহত রয়েছে ইউক্রেনীয়দের। সমর বিশ্লেষকরা বলছেন, বাখমুতের যুদ্ধ নৃশংস এক রক্তক্ষয়ে রূপ নিয়েছে। প্রতিনিয়ত সেই অভিজ্ঞতা রোমানেরও হচ্ছে। প্রতিটি মুহূর্ত টিকে থাকার সেই দুঃসহ অভিজ্ঞতা তিনি তুলে ধরেছেন ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য টাইমসের কাছে।
রোমানের মতে, যুদ্ধ প্রশিক্ষণ এক কথা, আসল যুদ্ধ তার চেয়েও কঠিন। এটাই আমার প্রথম লড়াই, আমার মতো অনেকরই। মাঝেমধ্যেই শত্রু বনের পথে পেছন দিয়ে এসে হামলা করছে। রাতের বেলায় কাছাকাছি দূরত্বের লড়াই চালিয়ে যাওয়াটাই সবচেয়ে কঠিন।
বাখমুতের যুদ্ধ আরও ভয়াল রূপ নিচ্ছে। নিকটবর্তী সোলেদার শহরে অগ্রসর হয়েছে রুশ সেনারা। এই শহরটি বাখমুত থেকে মাত্র তিন মাইল উত্তরপূর্বে অবস্থিত। বাখমুতের দক্ষিণে রয়েছে বিস্তীর্ণ মাঠ ও বনাঞ্চল, গত সপ্তাহ পর্যন্ত এই দিকটি প্রতিরক্ষার দায়িত্ব ছিল রোমান ও তার স্বেচ্ছাসেবী সেনা ইউনিটের ওপর। কিন্তু, শুনতে যতোটা সহজ মনে হয়, কাজটা যে ততো সহজ নয়– সেই উপলদ্ধিই হয় তাদের।
কেন এতটা কঠিন?- জানতে চাইলে রোমান বলেন, প্রথমেই বলব আমাদের প্রতিরোধ সীমানা কোথায়, সেটাই গুলিয়ে যাচ্ছিল। 'শত্রু আমাদের ওপর পেছন থেকে হামলা করে বসে'। চারপাশে তখন ঘোর অন্ধকার। এরইমধ্যে সামান্য যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে তাদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য লড়তে হয়েছে।
ন্যাটো ও পশ্চিমা মিত্ররা ইউক্রেনকে হিমার্স থেকে শুরু করে অত্যাধুনিক সব যুদ্ধাস্ত্র দিলেও–সেগুলো ব্যবহার করছে ইউক্রেন সেনাবাহিনীর অভিজাত ইউনিটগুলো। রোমানের মতো স্বেচ্ছাসেবীদের কাছে তেমন কোনো অস্ত্র নেই।
তার ভাষায়, 'আমাদের কাছে ছিল কালাশনিকভ অ্যাসল্ট রাইফেল, আর খানকয়েক গ্রেনেড, ব্যস এতটুকুই'।
তার অপর সহযোদ্ধা ও পেশায় দূরপাল্লার লরিচালক ৩১ বছরের যুবক ইউরি বলেন, 'আমাদের কাছে যদি নাইট ভিশন গগলস, বা তেমন কোনো রাতে দেখার সরঞ্জাম থাকতো, তাহলে হয়তো আমরা রাশিয়ানদের দেখতে পারতাম'।
এমন উপকরণ না থাকায় রাতের আঁধারে আন্দাজেই লড়তে হয়েছে স্বেচ্ছাসেবী এ ইউনিটকে। শত্রু যেখান থেকে তাদের ওপর গুলি চালিয়েছে, আন্দাজে সেদিকেই অন্ধের মতো গুলি চালায় তারা।
এতে শত্রুর কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কিনা– জানতে পারেননি তারা। কিন্তু, তাদের মধ্যে অনেকেই এসময় হতাহত হয়েছে। এতে, বোঝা যায় হয়তো আক্রমণকারীদের কাছে ছিল নাইটভিশন উপকরণ।
পরিস্থিতি যখন চরম অবনতির দিকে, তখন এই অবস্থানে থেকে প্রতিরোধের চেষ্টা বৃথা বলে বুঝতে পারেন কমান্ডাররা এবং সেখান থেকে তাদের সরে আসার নির্দেশ দেন। প্রতিকূল দশায় সফলভাবে পিছু হঠতে সফল হওয়ায়, সে যাত্রায় অনেকেরই প্রাণ বেঁচে গেছে।
এই লড়াইয়ের ৩৬ ঘণ্টা পর দুঃসহ অভিজ্ঞতার কথা ব্যক্ত করেন ইউনিটের সদস্যরা।
১১ মাসে পা দিয়েছে ইউক্রেন যুদ্ধ। শেষের মাস ছয়েক রণাঙ্গনে সুবিধে করতে পেরেছিল ইউক্রেনীয়রা। কিন্তু, তাই বলে তারা সব লড়াইয়ে জিতেছে– এ ধারণা ভুল। তার অন্যতম কারণ, লড়াই জিততে চাই অভিজ্ঞ সেনা। কিন্তু, ইউক্রেনের বেশিরভাগ সেনাই এখন নতুন। সংঘাতের অভিজ্ঞতা যাদের নেই বললেই চলে।
গত শুক্রবার সোলেদার শহরের দখল নিয়েছে রুশ বাহিনী। আক্রমণের সম্মুখভাগে ছিল তাদের ওয়াগনার গ্রুপের ভাড়াটে যোদ্ধারা। এরপর শত্রুর চোখ ফাঁকি দিয়ে কয়েক মাইল বিস্তীর্ণ প্রান্তর ও বনাঞ্চল পারি দিয়ে– তারা বাখমুতের দক্ষিণে এসে পড়ে। ফলে অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে শহরটি। দনেয়স্ক প্রদেশের সড়ক সংযোগ থেকে হয়েছে বিচ্ছিন্ন। রুশ সেনা অভিযানের ত্রিমুখী হামলার জন্য এখন প্রস্তুত হচ্ছে বাখমুতের ইউক্রেনীয় যোদ্ধারা। এই বাস্তবতায়, শহরটি রক্ষায় অভিজ্ঞ সেনাদের পাঠাতে শুরু করেছে কিয়েভ।
কিয়েভ এটাও উপলদ্ধি করছে, আসন্ন বসন্তে উভয়পক্ষের আক্রমণ ও পাল্টা-আক্রমণ অভিযানের ভিত্তিতেই নির্ধারিত হবে যুদ্ধের সার্বিক গতিপ্রকৃতি। সেজন্য প্রস্তুতিও নিচ্ছে। সেকারণে সবচেয়ে অভিজ্ঞ সেনা ও সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে না বাখমুত বা সোলেদারে। ফলে রুশ বাহিনীর হাতে বাখমুতের পতন মনে হচ্ছে সময়ের ব্যাপার মাত্র। রুশ বাহিনীর জন্য এটি এক প্রতীকী জয় হবে বলে দাবি পশ্চিমাদের, যাতে যুদ্ধের মোড় বদলাবে না তেমন।
তবু বাখমুতে প্রাণান্তকর এবং বেশিরভাগ সময়েই ব্যর্থ প্রতিরোধ চেষ্টা করতে হচ্ছে স্বেচ্ছাসেবী যোদ্ধাদের। এই যোদ্ধাদের মধ্যে ইউরোপ, আমেরিকা ও কানাডার মতো বিভিন্ন দেশের নাগরিক বিদেশিরাও রয়েছে। রয়েছে পুতিন-বিরোধী চেচেন, দাগেস্তানি ও ইঙ্গুশেতিয়রাও, যারা রাশিয়ান ফেডারেশন থেকে মাতৃভূমির স্বাধীনতা চায়।
বাখমুকতা নদীর ওপর ধবংসপ্রাপ্ত একটি সেতুর কাছে পাহারায় ছিলেন 'ক্যাসিনো' নামক এক যোদ্ধা। সহযোদ্ধারা আলেক্সকে পোশাকি এ নামেই ডাকেন, কারণ দুই বছর আগেও একটি প্রমোদতরীতে জুয়ার টেবিলে ডিলারের কাজ করতেন তিনি। এরপর সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ডাঙ্গায় থিতু হওয়ার। তাই চাকরি নেন আমেরিকান একটি লজিস্টিকস কোম্পানিতে। প্রেমিকাকে বিয়ে করেন, এরপর সুখের দাম্পত্য জীবনের আশাই করছিলেন। কিন্তু, তখনই বাজলো যুদ্ধের দামামা।
স্বেচ্ছাসেবী যোদ্ধার খাতায় নাম দিয়ে বর্তমানে বাখমুতের যুদ্ধে জড়িয়েছেন অ্যালেক্স। দিন চারেক আগে লড়েন তার প্রথম লড়াই। সে অভিজ্ঞতা জানিয়ে বলেন, 'প্রথমে আমি প্যানিক অ্যাটাকের শিকার হই (ভীতি ও উদ্বেগের তীব্র অনুভূতি), তারপর যা কিচ্ছু হচ্ছিল তার সাথে তাল মেলাতে থাকি'।
কিন্তু, রোমানের মতোই একই রকম দুঃসহ অভিজ্ঞতা হয়েছে অ্যালেক্সের। তার প্রথম লড়াইয়ে শত্রুপক্ষ জয়ী না হলেও, অ্যালেক্স উপলদ্ধি করেছেন বাখমুতের যুদ্ধের পরিণতি বদলাতে তাদের ছোট্ট জয় তেমন কোনো ভূমিকাই রাখবে না। আরও বুঝেছেন, বীরত্ব দিয়ে জেতারও নয় এ যুদ্ধ।
তার মতে, 'লড়াই মূলত চলছে গোলাবর্ষণের মাধ্যমে, এই যুদ্ধে সবাই আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। তারা আমাদের ওপর গোলাবর্ষণ করে, সেই মুহূর্তে আমরা বুঝতেও পারি না আসলে কী হচ্ছে'।
অ্যালেক্স যেখানে দাঁড়িয়েছিলেন তার পেছনের একটি সড়ক থেকে রাশিয়ান অবস্থান লক্ষ্য করে মর্টারশেল নিক্ষেপ করা হচ্ছিল। বাখমুতের ইউক্রেনীয় যোদ্ধারা এখন ব্যাপক পরিসরে রাশিয়ান হামলার দিন গুনছে। সোলেদার দখলের পর দুই শহরের মাঝখানে অবস্থিত গ্রামগুলো দখল করে এদিকেই আসবে রুশ বাহিনীর প্রবল আক্রমণ। তবে বিপজ্জনক মিশনে ওয়াগনার যোদ্ধাদের জনবলহানি হওয়ায়, তা শুরু হতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে বলে মনে করছে তারা।