মেছো বাঘ, বাঘ নয়
শীতের সকাল। সেবার গিয়েছিলাম মৌলভীবাজারের লাউয়াছড়া বনে। কাকডাকা ভোরেই প্রবেশ করেছি বনের ভেতরে। কাঁধে বড় লেন্সওয়ালা ক্যামেরা নিয়ে বনের গভীরে ছড়ার (ঝিরি) পাশ দিয়ে হাঁটছি।
হঠাৎ দূর থেকে ভেসে এলো গোঙানির আওয়াজ। কিন্তু সামনেই বাঁক, সেজন্য কিছু দেখা যাচ্ছে না। শুধু অনুমান করেছিলাম, বিড়াল-জাতীয় কোনো প্রাণী মারামারি করছে। আমি চুপিসারে গুটি গুটি পায়ে এগোতে লাগলাম।
অনেকটা কাছে যাওয়ার পর গরগর শব্দ আরও জোড়ালো হতে লাগল। চুপিচুপি বাঁক পেরিয়ে বাঁয়ে উঁকি মারলাম। দেখলাম, ছড়ার ঠিক পাশে শুকনো বালিতে দুটি মেছো বিড়াল ঘড়...ঘড়, ঘড়ৎ শব্দ করে যৌন সঙ্গম (মেটিং) করছে। সঙ্গে সঙ্গে কাঁধ থেকে ক্যামেরা নামিয়ে তাক করতেই বিড়াল দুটি আমাকে দেখে ফেলল। দেখার পর আর দেরি নয়, নিমেষে কয়েক লাফে অদৃশ্য হয়ে গেল বনের ভেতর। সেই মুহূর্তে আমি ওদের সঙ্গমের ছবি তুলতে ব্যর্থ হলেও দুজনের পালিয়ে যাওয়ার মুহূর্তটাকে ক্যামেরাবন্দি করতে পারি।
একজন ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার হিসেবে বুনো পরিবেশে দুই-তিন সেকেন্ডের জন্য হলেও বিরল এই প্রাণীদের সঙ্গমের দৃশ্য দেখতে পারাটা আমার কাছে পরম সৌভাগ্যর বিষয় মনে হয়েছিল।
নিশাচর এই মেছো বিড়াল দেখার ও এদের জীবনযাপনের ছবি তোলার লোভে মৌলভীবাজারের হাইল হাওরে প্রতি বছর রুটিন করে আমি অনেকটা সময় কাটিয়েছি। একসময় তো টানা একুশ রাত কাটিয়েছিলাম সেখানে। দিনে ঘুমোতাম, আর বিকেলের পর থেকে পুরো রাত অবধি বিভিন্ন স্পটে শক্তিশালী টর্চ লাইট, মাথায় হেডল্যাম্প ও ক্যামেরায় ফ্ল্যাশ লাইট লাগিয়ে নিজেকে আড়াল করে ওত পেতে কখনো বসে কখনো বা মাটিতে উপুড় হয়ে শুয়ে থাকতাম। এত শ্রম দেয়ার পুরস্কারস্বরূপ মেছো বিড়ালের পানিতে ডুব দিয়ে মাছ শিকার করা, খাওয়া, সাঁতার কেটে বিল পাড়ি দেওয়াসহ অনেক দুর্লভ ঘটনার সাক্ষী হয়েছি, এবং তা নিজ ক্যামেরায় ধারণ করেছি।
এই প্রাণীটিকে দেশের অধিকাংশ মানুষ মেছো বাঘ নামেই চেনে। এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও এরা বাঘরোল নামেই পরিচিত। আগে আমিও এদের মেছো বাঘ বলেই জানতাম। কিন্তু প্রখ্যাত প্রাণিবিজ্ঞানী অধ্যাপক ড. রেজা খান স্যারের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানতে পারি এরা আসলে মেছো বিড়াল।
স্যারের কাছ থেকে এই তথ্য জানার পর থেকে আমি নিজেও এদের আর বাঘ বলে ডাকি না। এদেরকে আমি যে আর বাঘ বলে ডাকি না, তার পেছনে কারণ আছে। কারণটা হলো, মেছো বিড়ালকে মেছো বাঘ নামে ডাকায় মানুষ ভয় পেয়ে অকারণে এদের মেরে ফেলে। এদের সংখ্যা কমে যাওরা একটা একটা প্রধান কারণ।
মেছো বিড়ালের ইংরেজি নাম Fishing Cat, বৈজ্ঞানিক নাম Prionailurus viverrinus (Bennett,1833). এরা আকারে গৃহপালিত বিড়ালের চেয়ে অনেকটা বড় হয়। শরীর ঘন, পুরু লোমে আবৃত। পুরুষ মেছো বিড়াল আকারে স্ত্রী মেছো বিড়ালের চেয়ে বড় হয়ে থাকে। এদের গায়ের রং ধূসর, সাথে বাদামি আভা আছে। পেটের নিচের রং সাদাটে। পুরা শরীরজুড়ে ছোপ ছোপ কালো দাগ আছে। চোখের ওপরে কপাল থেকে কানের দিকে কালো দুটি রেখা উঠে গেছে। গাল দুটি হালকা সাদাটে।
মেছো বিড়ালদের অনেকেই চিতা বিড়ালের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলে। দেখতে অনেকটা একই রকম হলেও এদের নাক কিছুটা চওড়া, দাঁত বড়, কান গোলাকার ও অপেক্ষাকৃত ছোট।
মেছো বিড়াল জলে ও স্থলে সমানভাবে তুখোড় শিকারি। সাধারণত খাল, বিল, নদী, পুকুর ও জলাভূমি আছে এমন জায়গাতেই এদের বসবাস। সুন্দরবনে বেশ ভালো পরিমাণেই আছে। তবে বেশি স্রোত আছে এমন নদীর পাশে এদের বসবাস করার তেমন তথ্য পাওয়া যায়নি।
মেছো বিড়াল মাছ, সাপ,ব্যাঙ, ইঁদুর, পাখি, খরগোশ, গুইসাপসহ মাঝারি আকারের অনেক প্রাণী শিকার করে থাকে। সুযোগ পেলে গৃহপালিত হাঁস-মুরগিও ধরে নিয়ে যায়। পানির ধারে ঝোপ অথবা কচুরিপানার ভেতরে এরা ঘণ্টার পর ঘণ্টা চুপ করে ঘাপটি মেরে শিকারের আশায় বসে থাকে। সুযোগ বুঝে থাবা দিয়ে মাছ ধরে। পানির নিচে ডুব দিয়ে মাছ ধরাতেও এরা বেশ পটু।
মেছো বিড়াল নিশাচর। দিনে ঘন ঝোপ, গাছের চওড়া ডালে অথবা গর্তে ঘুমিয়ে কাটায়। সূর্য ডোবার পরেই সাধারণত এরা শিকারে বের হয়। এলাকাভেদে একটি পুরুষ মেছো বিড়ালের সীমানা ২০ বর্গকিলোমিটার পর্যন্ত হতে পারে। যার প্রতি ৪-৫ বর্গকিলোমিটারের ভেতরে এক একটি স্ত্রী মেছো বিড়ালের বসবাস।
মেছো বিড়াল নিজের সীমানা ঠিক করার জন্য শরীর থেকে এক প্রকারের সুগন্ধি (ফেরোমন) নির্গত করে। স্ত্রী বিড়াল প্রায় ৭০দিন গর্ভধারণের পর এক থেকে চারটি বাচ্চা প্রসব করে। বাচ্চারা জন্মের নয় মাস পর্যন্ত মায়ের সাথেই থাকে।
বাংলাদেশে প্রাকৃতিক খাল-বিলে বাণিজ্যিকভাবে মাছ চাষ হওয়ায় মেছো বিড়ালের সংখ্যা মারাত্মকভাবে হ্রাস পাচ্ছে। মাছ চাষিদের খাল, বিল ও পুকুর থেকে মেছো বিড়াল মাছ খায় বলে এলাকাবাসী একত্রিত হয়ে ধাওয়া করে এদের পিটিয়ে অথবা বিষ টোপ ও ফাঁদ পেতে ধরে মেরে ফেলে। এছাড়া পানি দূষণ, জলাভূমি ভরাট করে চাষের জমি বা বাড়ি নির্মাণ করাও এদের সংখ্যা কমে যাওয়ার আরেকটি কারণ।
- আদনান আজাদ: বন্যপ্রাণী গবেষক ও ওয়াইল্ডলাইফ ফটোগ্রাফার