লোডশেডিং কমাতে জ্বালানি তেলভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে চায় বেসরকারি উৎপাদনকারীরা
আগামী গ্রীষ্মে জ্বালানির বর্ধিত চাহিদা মোকাবিলা ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির জন্য ব্যবহৃত বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে হেভি ফুয়েল অয়েল (এইচএফও) বা ফার্নেস তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবহার বাড়াতে পরামর্শ দিয়েছে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীরা (আইপিপি)।
বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন (বিপ্পা) সম্প্রতি বিদ্যুৎ বিভাগে স্টেকহোল্ডারদের এক বৈঠকে এ প্রস্তাব দেয়। সেখানে তারা বলে, ২০২৩ সালে এইচএফওর ব্যবহার ৪০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬৬ শতাংশ করা যেতে পারে।
এ উদ্যোগ নিলে সরকার প্রায় ১৬ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা সাশ্রয় করতে পারবে বলে উল্লেখ করে তারা।
বিপ্পার তথ্যমতে, বাড়তি ২৬ শতাংশ বা ১১ হাজার ৪৫ মিলিয়ন কিলোওয়াট/ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য সরকারের মাত্র ১৭ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা ব্যয় হবে। অন্যদিকে স্পট এলএনজি ব্যবহার করে একই পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যয় হবে ৩৪ হাজার ২৪০ কোটি টাকা।
প্রস্তাবিত পরিকল্পনাটি বাস্তবায়িত হলে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য পেট্রোবাংলাকে স্পট এলএনজি আমদানি করার প্রয়োজন পড়বে না। বরং বর্তমান সরবরাহ দিয়েই অন্যান্য খাতের গ্যাসের চাহিদা মেটাতে পারবে।
এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করলে আগামী গ্রীষ্মে প্রত্যাশিত জ্বালানি সংকট থেকেও সরকার পরিত্রাণ পাবে বলে কর্তৃপক্ষকে আশ্বস্ত করেছে বিপ্পা সদস্যরা।
ডিসেম্বরে বেসরকারি বিনিয়োগকারীরা যখন বিদ্যুৎ বিভাগে প্রস্তাবটি জমা দেয় তখন প্রতি মেট্রিক মিলিয়ন ব্রিটিশ থার্মাল ইউনিট (এমএমবিটিইউ) স্পট এলএনজির দাম ছিল ৩১ থেকে ৩২ ডলার।
তবে এলএনজি জাপান/কোরিয়া মার্কার প্ল্যাটস রেট বলছে, প্রতি এমএমবিটিইউ স্পট এলএনজির দাম এখন ২২-২৩ ডলারের মধ্যে ওঠা-নামা করছে।
বিদ্যুৎ বিভাগের নীতি প্রণয়ন শাখা পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তারা প্রস্তাবটি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করছেন এবং আসন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্মিলিত পরিকল্পনা করছেন।
'তবে তাদের পরিকল্পনা পুরোপুরি গ্রহণ করা হবে — এ কথা বলব না,' বলেন তিনি।
তবে জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ ধরনের প্রস্তাব গ্রহণের আগে কর্তৃপক্ষের উচিত বিভিন্ন জ্বালানির খরচ বিশ্লেষণ করে দেখা।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড মিনারেল রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তামিম বলেন, 'ফার্নেস তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের জ্বালানি খরচ যদি এলএনজির চেয়ে কম হয়, তাহলে কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্রের সঙ্গেও এর দাম তুলনা করে দেখতে হবে। ধরুন, বিশ্ববাজারে কয়লার দাম কমে গেল। সেক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচও কমে যাবে।'
আগামী গ্রীষ্মের মধ্যে দেশের কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা ৪,০০০ মেগাওয়াটে পৌঁছাবে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি) ও পেট্রোবাংলার তথ্য বলছে, বিশ্ববাজারে জ্বালানির বর্তমান মূল্য অনুযায়ী, প্রতি ইউনিট কয়লা ও ফার্নেস তেলভিত্তিক বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ১২-১৩ টাকা কিলোওয়াট ঘণ্টা ও ১৫-১৬ টাকা কিলোওয়াট ঘণ্টা।
আর স্পট এলএনজি দিয়ে উৎপাদিত প্রতি ইউনিট বিদ্যুতের উৎপাদন ব্যয় ৩০-৩১ টাকা কিলোওয়াট ঘণ্টা। কারণ দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় প্রতি ইউনিট এলএনজির আমদানি খরচ প্রায় ৪৫ থেকে ৫০ টাকা।
জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ ধরে নিয়ে বিপ্পা এর প্রস্তাবে প্রক্ষেপণ করেছে যে, ২০২৩ সালে দেশে প্রায় ৯২ হাজার ২৬৪ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা (এমকেডব্লিউএইচ) বিদ্যুতের প্রয়োজন হবে, যা গত বছরের ব্যবহারের চেয়ে ৭ শতাংশ বেশি।
চাহিদা মেটাতে বিপ্পা দুটি বিকল্পের প্রস্তাব রেখেছে। প্রথম বিকল্প হলো, ফার্নেস তেল থেকে ২৮ হাজার ৩৭ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন। দ্বিতীয় বিকল্পেও একই উৎস থেকে ১৬ হাজার ৯৯২ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদনের কথা বলা হয়েছে।
প্রস্তাবে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে, প্রথম বিকল্প বাস্তবায়ন করা হলে বিদ্যুৎ বিভাগ জ্বালানি খরচ ১৬ হাজার ৫৬৮ কোটি টাকা কমাতে পারবে।
কয়লার পরে ফুয়েল তেলকে পরিবেশের জন্য বেশি ক্ষতিকারক হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
বাংলাদেশ পরিবেশ আইনজীবী সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, 'আমরা যদি সঠিক সময়ে নবায়নযোগ্য [শক্তির উৎসের] দিকে ঝুঁকতাম, তাহলে বিশ্ব যখন নিট-জিরোর দিকে এগোচ্ছে, তখন আমাদের জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভর করতে হতো না।'
অন্যান্য শিল্পে নিয়মিত গ্যাস সরবরাহ
গত গ্রীষ্মে প্রায় সব শিল্পই গ্যাস ঘাটতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। এর ফলে সরকার অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিভিন্ন খাতে রেশনিংয়ের মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহ করতে বাধ্য হয়। যদিও এ উদ্যোগ নিয়েও সংকট খুব একটা কাটানো যায়নি।
জ্বালানি (গ্যাস, তেল ও কয়লা) ঘাটতির কারণে দেশে প্রায় ১ হাজার ৫০০ থেকে ২ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ ঘাটতি দেখা দেয়। এতে দীর্ঘ সময় লোডশেডিংয়ের কবলে পড়ে দেশ।
এ সংকটে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাশাপাশি শিল্পে উৎপাদনও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এ সংকট থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা মাথায় রেখে আইপিপিগুলো মনে করছে, এ পরিস্থিতির যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, তা নিশ্চিত করবে তাদের প্রস্তাব।
গত বছরের এপ্রিল থেকে জুন ও জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরে বিভিন্ন খাতে গ্যাস ব্যবহারের প্রবণতা এবং ২০২৩ সালে দৈনিক মোট ২ হাজার ৭৫০ মিলিয়ন ঘনফুট (এমএমসিএফ) গ্যাস — যার মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি এলএনজিও রয়েছে — সরবরাহ বিশ্লেষণ করে বিপ্পা দাবি করেছে, সরকার সংকটের মুখোমুখি হবে না।
বিপ্পা সারের জন্য দৈনিক ১৭৫ এমএমসিএফ, বিদ্যুৎ খাতে দৈনিক ৮৭৫ এমএমসিএফ, এবং শিল্প, ক্যাপটিভ বিদ্যুৎ, সিএনজি, গৃহস্থালিসহ অন্যান্য খাতে দৈনিক ১ হাজার ৭০০ এমএমসিএফ গ্যাস সরবরাহের সুপারিশ করেছে।
প্রস্তাবে পূর্বাভাস দেওয়া হয়েছে, ২০২৩ সালে বিদ্যুৎ খাতে গ্যাসের গড় চাহিদা হবে প্রায় ৮৭৫ এমএমসিএফ এবং সর্বোচ্চ চাহিদা এপ্রিলে ১ হাজার ১৩৯ এমএমসিএফ পর্যন্ত উঠতে পারে। আর সর্বনিম্ন চাহিদা ডিসেম্বরে ৪৫০ এমএমসিএফে নেমে এসেছিল।
স্থানীয় উৎপাদন ও দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি থেকে সরবরাহের মাধ্যমে এই চাহিদা মেটানো সম্ভব।
২০২১-২২ অর্থবছরে, দেশের মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল ৮৫ হাজার ৬০৭ মিলিয়ন কিলোওয়াট ঘণ্টা, যার মধ্যে ৫৫ শতাংশ উৎপাদন করেছে গ্যাসচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র, ২৬.৭১ শতাংশ উৎপাদন করেছে ফার্নেস তেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র, ৬.২৪ শতাংশ উৎপাদন করেছে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, ৯.০১ শতাংশ এসেছে ক্রস-বর্ডার আমদানি থেকে এবং ১.৭৩ শতাংশ এসেছে ডিজেল ও অন্যান্য উৎস থেকে।
এইচএফও আমদানি বাড়ছে
বিপ্পার সভাপতি ফয়সাল করিম খানের বরাত দিয়ে এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল বলেছে, জানুয়ারিতে বাংলাদেশ প্রায় ২.৫ লাখ মেট্রিক টন উচ্চ-সালফারযুক্ত জ্বালানি তেল আমদানি করবে বলে আশা করছে, যা ডিসেম্বরের চেয়ে ২৫ শতাংশ বেশি। ডিসেম্বরে তাপমাত্রা কম থাকার কারণে বিদ্যুতের চাহিদা কম ছিল।
এসঅ্যান্ডপি গ্লোবাল এ-ও পূর্বাভাস দিয়েছে যে, বাংলাদেশের এইচএফও চাহিদা ২০২৩ সালে ২২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
তবে ফয়সাল করিম খান জানান, এরপরও জানুয়ারির আমদানি পূর্বাভাস আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৩৭.৫ শতাংশ কম ছিল। কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়া এর অন্যতম কারণ।
তিনি বলেন, ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট সক্ষমতার রামপাল কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি ডিসেম্বরের শেষের দিকে একটি ইউনিট থেকে প্রায় ৬৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করেছে, যা এইচএফওচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে দেবে।
বাংলাদেশের প্রায় ৩ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বর্তমানে এইচএফও দিয়ে উৎপাদিত হচ্ছে, যা সন্ধ্যার পিক সময়ে উৎপাদিত মোট ৯ হাজার ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুতের প্রায় এক-তৃতীয়াংশের সমান।
গত বছর পেট্রোবাংলা স্পট মার্কেট থেকে ১৫ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ১৭ কার্গো এলএনজি আমদানি করে।