দক্ষিণ আফ্রিকায় বাঘের খামার, লক্ষ্য তাদের হাড়-রক্ত-চর্বি
গত মাসেই জোহানেসবার্গের গ্রামীণ এলাকার একটি খামার থেকে পালিয়ে যায় একটি বাঘ। চারদিন ধরে পালিয়ে বেড়ানোর সময় বাঘটি এক ব্যক্তিকে আক্রমণ করে আহত করেছে, বেশ কিছু পশুকে মেরে ফেলেছে এবং শেষমেশ কর্তৃপক্ষ বাধ্য হয় গুলি করে প্রাণীটিকে হত্যা করেছে। দক্ষিণ আফ্রিকা প্রাকৃতিকভাবে বাঘের আবাসস্থল নয়, এবং একে বিদেশি প্রাণী হিসেবেই ধরা হয়।
বাঘটির এই পালিয়ে যাওয়ার সংবাদ অবশ্য দক্ষিণ আফ্রিকার অন্যতম বিতর্কিত বিষয়টিকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে তুলে এনেছে। আর তা হলো: দেশটির বাণিজ্যিক 'বিগ ক্যাট' প্রজনন খামার এবং আন্তর্জাতিক 'বিগ ক্যাট' বাজারে দেশটির অবৈধ বেচা-কেনা। পর্যটন তো রয়েছেই, শিকার এবং বাণিজ্যিক কারণেও বাঘকে খামারে পোষা হয়, যার মধ্যে তাদের দেহের বিভিন্ন অংশের বেচাকেনাও রয়েছে।
দ্য কনভার্সেশন আফ্রিকার সহকারী সম্পাদক ময়না স্পুনার এই বাঘের খামার শিল্পের ভেতরের খবর জানাতে নীল ডি ক্রুজ এবং অ্যাঞ্জি এলউইনের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। নীল ডি ক্রুজ ওয়ার্ল্ড অ্যানিম্যাল প্রোটেকশন সংস্থার বন্যপ্রাণী গবেষণা বিভাগের গ্লোবাল হেড হিসেবে কাজ করছেন। অ্যাঞ্জি এলউইনও একই প্রতিষ্ঠানের বন্যপ্রাণী গবেষণা ব্যবস্থাপক হিসেবে কাজ করছেন।
দক্ষিণ আফ্রিকার এই বন্দী বন্যপ্রাণীর খামার নিয়ে মূল আশঙ্কা কী?
জোহানেসবার্গ থেকে বাঘ পালিয়ে যাওয়ার সাম্প্রতিক এই ঘটনা আমাদেরকে দেখিয়ে দেয় এই খামারশিল্পের কী ভয়াবহ ঝুঁকি রয়েছে; বিশেষ করে এর সাথে জড়িত কর্মী, দর্শক আর সাধারণ মানুষদের ক্ষেত্রে। দক্ষিণ আফ্রিকায় বিগ ক্যাটদের আক্রমণে সাম্প্রতিক সময়ে পঙ্গু হয়ে যাওয়ার মতো জখমের শিকার হয়েছেন অনেকেই, মারাও গেছেন কেউ কেউ।
এছাড়াও কিছু কিছু বাঘকে পোষ মানানো সম্ভব হলেও একে গৃহপালিত প্রাণীর সাথে মিলিয়ে ফেললে ভুল হবে। তারা বনের প্রাণী। তাদের জৈবিক আর আচরণগত কিছু চাহিদা আছে, যেগুলো কেবল বন থেকেই মেটানো সম্ভব।
আরো একটি বিষয় হলো বন্যপ্রাণীর অবস্থা। দক্ষিণ আফ্রিকার বিগ ক্যাট প্রজনন খামারগুলোতে তাদেরকে যে পরিবেশে রাখা হয়, তা প্রাণীগুলোর জন্য ক্ষতিকারক। তাছাড়া এই খামারগুলোর কোনোটিই আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন কোনো প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিরীক্ষিত হয় না, এমনকি বাঘগুলোকে বনেও ছেড়ে দেয় না। অর্থাৎ, তারা খামারের মাধ্যমে কীভাবে এই বন্যপ্রাণীগুলোর প্রজাতিকে লাভবান করছে তার কোনো প্রমাণ তারা দেখাতে পারছে না।
তবে সবচেয়ে বড় আশঙ্কার বিষয় হলো দক্ষিণ আফ্রিকার এই বৈধ খামারগুলোতে থাকা বাঘগুলোকে শিকার হতে হচ্ছে অবৈধ আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের। এই বাঘগুলোর বড় একটি অংশকে জীবিত অবস্থায় অথবা মৃত অবস্থায় শরীরের বিভিন্ন অংশকে টুকরো টুকরো করে চীন, ভিয়েতনাম এবং থাইল্যান্ডে পাচার করা হচ্ছে। বাঘের অংশবিশেষ এবং অবৈধ বাঘ বাণিজ্যের পরিচিত হটস্পট এগুলো।
এছাড়াও ওয়ার্ল্ড অ্যানিম্যাল প্রোটেকশন সংস্থার ইন্টেলিজেন্স অনুযায়ী, পোচাররা এই খামারের বাঘগুলোকে তাদের অন্যতম শিকারে পরিণত করেছে। প্রায়ই তারা বাঘের মাথা আর থাবা সংগ্রহ করে এশীয় ক্রেতাদের চাহিদা মেটায়।
ইন্টেলিজেন্স রিপোর্ট থেকে পাওয়া সংবাদের ভিত্তিতে আরো একটি আশঙ্কা হলো, বেশ কিছু বিগ ক্যাট খামারের মালিকেরা সিংহ থেকে বাঘ এবং বাঘ-সিংহের সংকর লাইগারের খামার দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছেন। কারণ দক্ষিণ আফ্রিকায় বেশ কিছুদিন ধরেই সিংহের খামার বন্ধ করার আলোচনা চলছে। এ ব্যাপারে ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার কোথায় কী পরিমাণে বাঘ আছে, তা নিয়ে কি কোনো তথ্য-উপাত্ত রয়েছে?
দক্ষিণ আফ্রিকার এনভায়রনমেন্ট, ফরেস্ট্রি অ্যান্ড ফিশারিজ মন্ত্রীর দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বিগ ক্যাট উৎপাদন অথবা সংরক্ষণের জন্য দক্ষিণ আফ্রিকায় ৩৫০-রও বেশি সরকারি অথবা বেসরকারি খামার রয়েছে। প্রাণীগুলোর মধ্যে রয়েছে, বাঘ, সিংহ, চিতা, লেপার্ড, জাগুয়ার, পুমা, কোরাকাল, সার্ভাল এবং এদের সংকর জাতের প্রাণী।
তবে ঠিক কতগুলো প্রাণী এই খামারগুলোতে আটকে রয়েছে তা সম্পর্কে সঠিক উপাত্ত জানা যায় না, কারণ কখনোই এই খামারগুলোতে অডিট করা হয় না। কারণ এটি করতে রাজনৈতিক অনাগ্রহের পাশাপাশি সম্পদের অভাব এবং পর্যাপ্ত ও কার্যকর নিয়মাবলীর অভাব রয়েছে। তারপরও প্রাদেশিক কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে পাওয়া অপ্রকাশিত ডেটা (যেটির ওপর ভিত্তি করে আমরা আমাদের গবেষণা পরিচালনা করছি) এবং ব্লাড লায়ন নামের একটি সংস্থা থেকে পাওয়া ডেটা থেকে আমরা জানতে পেরেছি, ২০২২ সালে রেজিস্টারকৃত বেসরকারি খামারগুলোতে মোট ৪৯২টি বাঘ রয়েছে। প্রকাশিত ডেটা অনুযায়ী, ২০১৯ সাল পর্যন্ত ৫,২৯১টি সিংহ, ৩৭৩টি চিতা এবং ১৭৬টি লেপার্ড সংরক্ষণের অনুমতি দেওয়া হয়েছে কেবল এম্পুমালাঙ্গা, ফ্রি স্টেট, নর্থ ওয়েস্ট এবং গাউটেং প্রদেশেই।
যদিও এই তথ্যগুলো বাস্তব চিত্রের সামান্য একটি অংশ, দক্ষিণ আফ্রিকায় আটকে রাখের বাঘের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। এনভায়রনমেন্টাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি এবং ফোর পয়ের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকার সাতটি প্রদেশজুড়ে থাকা খামারে ১০০টির কাছাকাছি বাঘ ছিল।
কীভাবে বাঘগুলো এই বাণিজ্যিক খামারগুলোতে পৌঁছাচ্ছে তা অবশ্য অস্পষ্ট। তবে কনভেনশন অন ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইন এনডেঞ্জারড স্পেসিজ অফ ওয়াইল্ড ফনা অ্যান্ড ফ্লোরা মেইন নেভিগেশন ট্রেড ডেটাবেজ অনুযায়ী, গত দশকজুড়ে ৬৬টি জীবিত বাঘ আমদানি করা হয়েছে, যার বেশিরভাগই করা হয়েছে জার্মানি, বতসোয়ানা, রোমানিয়া এবং লেসোথো থেকে। এর বাইরে, চিড়িয়াখানা, সার্কাস এবং প্রজনন খামারগুলোর জন্য ভিয়েতনাম, চীন, থাইল্যান্ড, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে ৩৮৪টি জীবিত বাঘ আমদানি করা হয়েছে।
খামার শিল্পটিকে চালনা করার জন্য যা যা করা হচ্ছে, তা কি যথেষ্ট?
আফ্রিকার হাতেগোণা কিছু দেশের মধ্যে দক্ষিণ আফ্রিকা এমন একটি দেশ, যারা বৈধভাবে প্রজনন করার জন্য খামারে বাঘ পালন, সংরক্ষণ এবং শিকারের অনুমতি দেয়। একইসাথে দেশে ও বিদেশে বাঘ বাণিজ্যও বৈধ এখানে। ১৯৮৭ সালে আন্তর্জাতিক বাঘ বাণিজ্য নিষিদ্ধকরণ এবং ২০০৭ সালে বাণিজ্যিকভাবে খামারে বাঘের প্রজননের আন্তর্জাতিক চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও দক্ষিণ আফ্রিকাতে এ বিষয়টি টিকে রয়েছে। বাঘের শরীরের অংশও আমদানি-রপ্তানি করা নিষিদ্ধ, যার মধ্যে রয়েছে ঔষধ হিসেবে ব্যবহার করা বাঘের হাড়, চর্বি, রক্ত এবং পিত্ত।
বিগ ক্যাটদের সম্পর্কিত আইনগুলো ২০০৪ সালের ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্টাল ম্যানেজমেন্ট বায়োডাইভারসিটি অ্যাক্টের মাধ্যমে প্রণয়ন করা হয়। প্রাদেশিক নিয়মাবলীগুলো এদিক-ওদিক হলেও এই বায়োডাইভারসিটি অ্যাক্ট অনুযায়ী, যাদের অনুমতি রয়েছে, তারা বাঘ আমদানি, সংরক্ষণ, প্রজনন কিংবা বাণিজ্য করতে পারবে।
আন্তর্জাতিক গোষ্ঠী বাঘের এই অবৈধ ব্যবসাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশগুলো যদি তাদের নিজেদের অভ্যন্তরে বাঘের এই ব্যবসাকে বৈধ করে রাখে, তবে এই সমস্যা শীঘ্রই সমাধান হওয়ার সম্ভাবনা নেই। দক্ষিণ আফ্রিকাকে তাই বাঘকে বন্দী করে প্রজনন, সংরক্ষণ এবং শিকার বন্ধ করার সক্রিয় প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
দক্ষিণ আফ্রিকা কেন এখনো এই উদ্যোগ নেয়নি তা পরিষ্কার নয়। অর্থনীতি একটি বড় কারণ হতে পারে। তবে এর ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দক্ষিণ আফ্রিকার যে দুর্নাম হচ্ছে, তার সাথে তুলনা করলে কতটুকু অর্থনৈতিক লাভ হচ্ছে, তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। তাছাড়া ব্যক্তিগতভাবে বন্যপ্রাণীর মালিক হওয়ার অধিকার এবং সাংবিধানিক অন্যান্য অধিকারও এর পেছনের কারণ হতে পারে।
একটি বিস্তারিত পরিকল্পনার মাধ্যমেই এই শিল্পের বর্তমান অবস্থা থেকে উত্তরণ সম্ভব। এর মধ্যে রয়েছে নিয়মিত অডিট, নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে সঠিকভাবে পরিদর্শন এবন সঠিক রেকর্ড সংরক্ষণ।
এই সিদ্ধান্তগুলো দক্ষিণ আফ্রিকার সবগুলো প্রদেশে বাধ্যতামূলক হওয়া উচিত। তাছাড়া কেবল বাঘই নয়, অন্যান্য বিগ ক্যাট প্রজাতিগুলোর জন্যেও একই ধরনের আইন প্রণয়ন করা উচিত, যাতে করে বাঘের হাড়ের বদলে অন্য প্রাণীর হাড় এর প্রতিস্থাপক হিসেবে আবির্ভূত না হয়।
সূত্র: স্ক্রলডটইন