৮ বছরে সর্বোচ্চ নিপাহ আক্রান্ত শনাক্ত, চলতি মৌসুমে বড় প্রাদুর্ভাবের আশঙ্কা
চলতি বছর দেশে এখন পর্যন্ত নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ৯ জন। তাদের মধ্যে ৫ জন মারা গেছেন, যা গত ৮ বছরে সর্বোচ্চ। নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত সন্দেহে হাসপাতালে ভর্তি আছে একাধিক রোগী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, এ বছর দেশের ৬টি জেলায় নিপাহ রোগী শনাক্ত হয়েছে। বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন জেলায় কেস শনাক্ত হওয়ায় বড় প্রাদুর্ভাবের ঝুঁকি আছে বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। নিপাহ থেকে বাঁচতে খেঁজুরের কাঁচা রস পান না করার পরামর্শ তাদের।
চলতি বছর রাজশাহী, নওগাঁ, রাজবাড়ি, শরিয়তপুর, পাবনা ও ঢাকা জেলায় ৯ জন রোগী শনাক্ত হয়েছে। তাদের মধ্যে ৩ শিশু ও বাকিদের বয়স ১৮-৩৫ এর মধ্যে। আক্রান্তদের মধ্যে ৫ জন নারী, ৪ জন পুরুষ। তাদের মধ্যে দুই শিশুসহ ৫ জন মারা গেছেন।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের (আইইডিসিআর) নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, "গত কয়েক বছর ধরে দুই-তিনটা করে নিপাহ কেস পাওয়া যাচ্ছিল। এ বছর গত কয়েক বছরের তুলনায় কেস বেশি। কিন্তু এবারের সমস্যা হলো বিভিন্ন জায়গায় ছড়ানো কেসগুলো। আগে আউটব্রেক হতো একটি জায়গায়, অনেক কেস থাকতো। একই খেজুরের রস খেয়ে অনেকে আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু এবার কেসগুলো ছড়ানো-ছিটানো। এটি একটি ঝুঁকির কারণ।"
''অনেক জেলায় আক্রান্ত বাদুড় রয়েছে। বিভিন্ন জেলায় মানুষ যদি বেশি খেজুরের রস খায় তাহলে বড় আউটব্রেকের ঝুঁকি থাকে। সাধারণত ডিসেম্বর থেকে মার্চ বা এপ্রিল পর্যন্ত নিপাহ কেস পাওয়া যায়। সে কারণে এখনো মৌসুম আছে। খেজুরের রস যতদিন থাকে ততোদিন ঝুঁকি আছে", বলেন তিনি।
এর আগে ২০১৫ সালে দেশে নিপাহ ভাইরাসে ১৫ জন আক্রান্ত হয়েছিল, যাদের মধ্যে মারা যায় ১১ জন। তারপরের বছরগুলোতে নিপাহ রোগীর সংখ্যা ২-৮ এর মধ্যে ওঠানামা করেছে।
আইইডিসিআরের তথ্য বলছে, ২০০১ সালে মেহেরপুরে প্রথম নিপাহ রোগী শনাক্ত হয়। এখন পর্যন্ত দেশের ৩২ জেলায় ৩৩৪ জন নিপাহ রোগী শনাক্ত হয়েছে, যার মধ্যে মারা গেছেন ২৩৫ জন, মৃতের হার ৭১%।
আইইডিসিআরের উপদেষ্টা ডা. এম মুশতাক হোসেন বলেন, কোনো জায়গায় একবার নিপাহ ভাইরাস আক্রান্ত রোগী পাওয়া গেলে ওই স্থানকে ঝুঁকিপূর্ণ বিবেচনা করা হয়। কারণ যেখানে নিপাহ ভাইরাসের রোগী পাওয়া যায় সেখানে বাদুরও থেকে যায়, খেজুরের রসও থাকে। দেশের সব এলাকাই নিপাহ ভাইরাসের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ, কিন্তু যেসব জেলায় ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে, সেসব জেলায় বাড়তি সতর্কতা অবলম্বন করতে বলা হয়।
বৃহস্পতিবার দেশের ৩২টি জেলার মানুষ নিপাহ ভাইরাসজনিত জ্বরের ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। তাই হাসপাতালে জ্বর নিয়ে আসা রোগীদের সেবা দেওয়ার সময় সর্তকতামূলক ব্যবস্থা নিতে চিকিৎসকদের প্রতি নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
জ্বরের উপসর্গ নিয়ে হাসপাতালে আসা রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেওয়ার ক্ষেত্রে কর্তব্যরত চিকিৎসকদের জন্য ছয়টি নির্দেশনা দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
নির্দেশনাগুলো হলো: রোগী দেখার সময় আবশ্যিকভাবে মাস্ক পরতে হবে। রোগী দেখার আগে ও পরে সাবান দিয়ে হাত ধুতে হবে, জ্বরের উপসর্গ থাকলে রোগীকে আবশ্যই আইসোলেশন ওয়ার্ডে রাখতে হবে, জ্বরে আক্রান্ত রোগীর মধ্যে অজ্ঞান অবস্থা দেখা দিলে তাকে হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) রাখতে হবে, আইসিইউতে থাকাকালে রোগীর পরিচর্যাকারীরা শুধু গ্লাভস ও মাস্ক পরলেই হবে। কারণ রোগী থেকে বাতাসের মাধ্যমে নিপাহ ভাইরাস ছড়ায় না, যেহেতু আইসিইউতে রেখে এই রোগীর চিকিৎসা করা যায়, এ জন্য রেফার্ড করার প্রয়োজন নেই এছাড়া যেকোনো প্রকার তথ্যের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কল সেন্টারে ১৬২৬৩/৩৩৩ নম্বরে যোগাযোগ করতে বলা হয়েছে।
নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসায় ঢাকার মহাখালীর ডিএনসিসি কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালে ১০টি আইসোলেশন বেড ও ১০টি আইসিইউ বেড প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে ডিএনসিসি কোভিড হাসপাতালের আইসিইউ ওয়ার্ডে নিপাহ ভাইরাস সন্দেহে চিকিৎসা চলছে যশোর থেকে আসা এক ষাটোর্ধ্ব রোগীর। তিনি খেজুরের রস পান করেছিলেন এবং নিপাহ ভাইরাসের লক্ষণ আছে তার।
আইইডিসিআর পরিচালক অধ্যাপক তাহমিনা শিরিন জানান, বাদুড়ের লালা বা প্রস্রাবের মাধ্যমে নিপাহ ভাইরাস ছড়ায়। দূষিত-কাঁচা খেজুরের রস পান করলে এ ভাইরাসে সংক্রমিত হতে পারে। সংক্রমিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে তাদের পরিবারের সদস্য বা স্বাস্থ্যকর্মীদের মধ্যেও সংক্রমণ ছড়ায়।
নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে তিনি কাঁচা খেজুরের রস এবং মাটিতে পড়ে থাকা আধাখাওয়া ফল না খাওয়ার পরামর্শ দেন।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের (ডিজিএইচএস) মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, নিপাহ ভাইরাসের সংক্রমণ এড়াতে কোন অবস্থাতেই খেজুরের কাঁচা রস পান করা যাবে না, গুড় খাওয়া যাবে। খেজুরর কাঁচা রস পান করা, বিপণন করা, প্রদর্শন করা নিরুৎসাহিত করতে হবে।
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে খেজুরের রস বিক্রি করা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, "এটি বন্ধে প্রশাসনকেও উদ্যোগী হতে হবে; সবকিছু দাপ্তরিক নির্দেশ দিয়ে হয় না।"
ডা. নাজমুল ইসলাম বলেন, "আমরা হাসপাতালে আইসিইউ প্রস্তুত রেখেছি কারণ এটি সাংঘাতিক রকমের সংক্রমণ। এই রোগীকে কোন প্রাইভেট হাসপাতাল নিবে না। সরকারি হাসপাতালের আইসিইউতে থাকা রোগীরা ঝুঁকিতে থাকতে পারে তাদের জন্য। তাই এদের আলাদা করে রেখেছি। ভয় না পেয়ে সবাইকে নিপাহ সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে।"