২০২২ সালে অর্থ লেনদেন-সংক্রান্ত রেকর্ড ৪২০০ কোটি টাকার মামলার নিষ্পত্তি
গত বছর ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত লেনদেন-সংক্রান্ত রেকর্ড ৩,৩৪৮টি মামলার বিরোধ নিষ্পত্তি করেছেন দেশের অর্থ ঋণ আদালত। গত বছর মামলাগুলোর নিষ্পত্তি করে বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির প্রায় ৪,২০০ কোটি টাকা আদায় করেছেন আদালত। লেনদেন-সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তির মাধ্যমে গত পাঁচ বছরে এটিই উদ্ধারকৃত সর্বোচ্চ অর্থ।
গত বছর নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ মামলাই ব্যবসায়িক লেনদেন-সংক্রান্ত।
২০২১ সালে অর্থ ঋণ আদালতের মাধ্যমে ২,১৮০টি মামলার নিষ্পত্তি করে প্রায় ২,৬০০ কোটি টাকা আদায় করা হয়েছে। এসব মামলা নিষ্পত্তি করে রায় দিয়েছেন দেশের ৬৪ জেলার সিনিয়র সহকারী জজ, যুগ্ম জজ ও অতিরিক্ত জেলা জজ আদালত।
এসব আদালতে যেসব মামলার রায়ের পর রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়নি, সেই রায়গুলো অনুযায়ী এই টাকা আদায় হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিশ্বব্যাংকের 'ইজ অভ ডুয়িং বিজনেস ইনডেক্স-২০২০' অনুসারে, চুক্তি কার্যকর করার ক্ষেত্রে ১৯০টি অর্থনীতির মধ্যে বাংলাদেশ ১৮৯তম স্থানে রয়েছে। এ সূচক বাণিজ্যিক বিরোধ নিরসনের সময় ও ব্যয় এবং বিচারিক প্রক্রিয়ার গুণমান নির্ধারণ করে।
কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ অ্যাডভোকেট প্রবীর নিয়োগী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ব্যবসা-সংক্রান্ত মামলা নিষ্পত্তির এরকম গতি দেশের ব্যবসাকে আরও সহজ এবং ব্যবসার পরিবেশ আরও উন্নত করবে।
তিনি বলেন, 'এটি মাত্র এক ধরনের মামলা, যেখানে শুধু টাকা লেনদেন-সংক্রান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি হয়েছে। এই মামলাগুলোর বেশিরভাগই ছোট ও মিডল ক্লাস ব্যবসায়ীর।
'কিন্তু কোম্পানিগুলোর মামলা হয় হাই কোর্টে। আবার অনেক লেনদেন-সংক্রান্ত বিরোধ রয়েছে, যেগুলো ব্যাংক চেকের মাধ্যমে লেনদেন হয়েছে, এগুলোর জন্য অনেক চেক ডিজঅনারের মামলা রয়েছে। আবার বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার নিয়ে, চুক্তি নিয়ে আদালতে যেসব বিরোধ পেন্ডিং আছে, ব্যবসার পরিবেশ আরো ভালো করতে এসব নিষ্পত্তিতে গতি আনতে হবে।'
যেভাবে অর্থ ঋণ মামলার নিষ্পত্তি হয়
নরসিংদী সদরের শাড়ি ও লুঙ্গির পাইকারি বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠান আলাল বস্ত্র বিতান-এর স্বত্বাধিকারী আলাল আহমেদ তার পাইকারি ক্রেতা সিরাজগঞ্জের সবুজ মিয়ার কাছে ২৭ লাখ টাকা পাওনা আদায়ের জন্য ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে মামলা করেন নরসিংদী জেলার যুগ্ম জেলা জজ আদালতে।
গত বছরের জুন মাসে মামলার রায় হয়, এবং চার মাসের চারটি কিস্তিতে ওই টাকা পরিশোধের আদেশ দেন আদালত। একইসাথে চার মাসের মধ্যে ওই টাকা পরিশোধ করার অঙ্গীকারে সবুজ মিয়াকে কোনো জরিমানা করেননি আদালত। সবুজ মিয়া গত অক্টোবর মাসের মধ্যে পুরো টাকা পরিশোধ করে আদালতে এফিডেভিট দাখিলের মাধ্যমে জানান যে চার কিস্তিই পরিশোধ হয়েছে।
আলাল আহমেদ টিবিএসকে বলেন, 'ওই টাকা পেয়ে আমি ব্যবসার পরিসর আরও বাড়াতে পেরেছি।'
বিবাদী সবুজ মিয়া বলেন, 'আমার ব্যক্তিগত সমস্যার কারণে ওই টাকা পরিশোধ করতে সমস্যা হচ্ছিল। রায় প্রদানের সময় আদালত যখন বললেন, যদি চার মাসের মধ্যে পুরো টাকা পরিশোধ করা যায়, তাহলে জরিমানা করবেন না। আমি সেই সুযোগ কাজে লাগাই। কারণ রায়ে জরিমানা করলে আরও অন্তত ৫ লাখ টাকা দেওয়া লাগতো।'
শুধু নরসিংদীর এই মামলায় নয়, গত বছরের জানুয়ারি থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দেশের দেওয়ানি আদালতগুলোতে ব্যবসায়িক ও ব্যক্তিগত অর্থ লেনদেন-সংক্রান্ত এরকম ৩,৩৪৮টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১,০২৯টি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে। আর আপিল না হওয়া ২,৩১৯টি রায় বিবাদীরা মেনে নিয়ে প্রায় ৪,২০০ কোটি টাকা দাবীকারীদের পরিশোধ করেছেন।
২০২১ সালে ২,১৮০টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে, যার মধ্যে ৯৩০টি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে।
২০২০ সালে ২,২৩৫ টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে, যার মধ্যে ৮৫০টি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে। আর আপিল না হওয়া ১,৩৮৫টি রায় বিবাদীরা মেনে নিয়ে প্রায় ২,০০০ কোটি টাকা দাবীকারীদের পরিশোধ করেছেন।
২০১৯ সালে অর্থ ঋণ আদালতগুলো ২,২৪৩টি মামলার নিষ্পত্তির করেছেন, যার মধ্যে ১,১৩০ টি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে। আর আপিল না হওয়া ১,১১৩টি রায় বিবাদীরা মেনে নিয়ে প্রায় ২,০০০ কোটি টাকা দাবীকারীদের পরিশোধ করেছেন।
২০১৮ সালে প্রায় ২০০০টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে, যার মধ্যে প্রায় ৯২১টি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হয়েছে। আর আপিল না হওয়া ১,০৭৮ টি রায় বিবাদীরা মেনে নিয়ে প্রায় ২,১০০ কোটি টাকা দাবীকারীদের পরিশোধ করেছেন।
আদায় বাড়ার কারণ
নিম্ন আদালতের কয়েকজন বিচারক ও আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, করোনা মহামারির প্রভাবে দেশের ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাতে সঠিক দাবীকারী ব্যক্তি তাদের পাওনা টাকা পেলে হয়তো অর্থিকভাবে কিছুটা সচ্ছল হতে পারবে। আদালত এ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়েছেন।
এছাড়াও কয়েকজন বিচারক জানান, এই মামলাগুলোতে রায়ের সময় সঠিক দাবীকারীদের (মামলাকারী) দাবি যথাযথ হওয়া সাপেক্ষে বিবাদীকে বিভিন্ন পরিমাণে জরিমানা করা হয়।
কিন্তু গত বছর যে মামলাগুলো নিষ্পত্তি হয়েছে, সেগুলোতে বিবাদীদের খুব একটা জরিমানা করা হয়নি। তারা আদালতে অঙ্গীকার দেওয়া সাপেক্ষে মূল টাকা কিস্তির মাধ্যমে পরিশোধের সুবিধা দিয়ে রায় দেওয়া হয়েছে।
নরসিংদী জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট কাজী নাজমুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, গত বছর এই জেলাতেও প্রায় ১২০টি এরকম মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে—যা গত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি। এসব মামলার মধ্যে প্রায় ৮০টি মামলায় ছিল বিভিন্ন ব্যবসায়ীর।
তিনি বলেন, 'আমরা আদালতের কাছে কোভিড ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে কারণে মানুষ যে ধরনের সমস্যায় আছে, সেই বিষয়গুলো তুলে ধরেছি। আদালতও এই কথাগুলো আমলে নিয়ে এ ধরনের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করেছেন।'
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক টিবিএসকে বলেন, সব ধরনের মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্ট বিভিন্ন সময় বিচারকদের নানা নির্দেশনা দিয়েছে।
তবে অর্থ-সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি করতে গত কয়ে কবছর ইউএনডিপি, বিশ্বব্যাংক, জিআইজেড, এডিবিসহ দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সহায়তার বিচারকদের উল্লেখ্যযোগ্য পরিমাণ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
এই প্রশিক্ষণগুলোর প্রভাবে এরকম উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ লেনদেন-সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে বলে মনে করেন আইনমন্ত্রী।
সব ধরনের মামলার নিষ্পত্তির হার আগের বছরগুলোর তুলনায় এখন বৃদ্ধি পাচ্ছে বলেও মন্তব্য করেন মন্ত্রী।
কম সময়ে যেভাবে নিষ্পত্তি সম্ভব
দেওয়ানি আইন বিশেষজ্ঞ সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, অর্থ লেনদেন-সংক্রান্ত মামলার বিচার করতে খুব একটা বেশি সময় প্রয়োজন পড়ে না। কারণ এসব মামলায় টাকা লেনদেনের উপযুক্ত ডকুমেন্টগুলোই হলো বিচারের জন্য মূল তথ্য-প্রমাণ। এর বাইরে দুই-একজন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণের প্রয়োজন হয়। আদালত ইচ্ছা করলে দুই-তিন কার্যদিবসের মধ্যেই একটি অর্থ লেনদেন-সংক্রান্ত মামলার নিষ্পত্তি করতে পারে।
তিনি আইন মন্ত্রণালয়কে পরামর্শ দিয়ে বলেন, অর্থ লেনদেন-সংক্রান্ত মামলার বিচার করার জন্য প্রত্যেক জেলায় একটি করে পৃথক আদালত থাকা উচিত, যেখানে শুধু অর্থ লেনদেন-সংক্রান্ত মামলার বিচার হবে।
আরও যত মামলা ও আপিল পেন্ডিং
সুপ্রিম কোর্ট সূত্র জানায়, নিম্ন আদালতগুলোতে এখন প্রায় ২৯ হাজার অর্থ লেনদেন-সংক্রান্ত মামলা পেন্ডিং আছে। এই মামলাগুলোর সাথে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার লেনদেন জড়িত। এই মামলাগুলোর মধ্যে প্রায় ৪ হাজার মামলা রয়েছে দশ বছরের বেশি সময় ধরে পেন্ডিং, প্রায় ৮ হাজার মামলা রয়েছে ৫ বছরের বেশি সময় ধরে পেন্ডিং।
এছাড়াও জেলা জজ আদালত, হাই কোর্ট ও আপিল বিভাগে প্রায় ১১ হাজার আপিল বিচারাধীন রয়েছে, যেগুলোর সাথে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা জড়িত।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, এখন সুপ্রিম কোর্টসহ সব আদালতে প্রায় ৪০ লাখ মামলা বিচারাধীন রয়েছে।
তিনি বলেন, 'এই মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য উদ্যোগ নিতে হবে। আর অর্থ লেনদেন বা অর্থ-সংক্রান্ত মামলাগুলো বিচারের ক্ষেত্রে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি বিধান (এডিআর) প্রয়োগ করলে আরও ভালো ফলাফল আসবে।'