পরিকল্পিত গ্রামীণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আসছে
গ্রামীণ এলাকায় উৎপাদিত বর্জ্য নিয়ে প্রথমবারের মতো করা সমীক্ষায় দেখা গেছে, গ্রামে গড়ে দৈনিক মাপাপিছু বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে ০.৩৮ কেজি।
এই হিসেবে গ্রামে দৈনিক মোট বর্জ্য উৎপাদন হচ্ছে ৩৭ হাজার ৮৪ দশমিক ৪৬ টন। এই বর্জ্যের মধ্যে ৮৭ শতাংশ পচনশীল ও অবশিষ্ট ১৩ শতাংশ অন্যান্য বর্জ্য।
বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় গ্রামের বিভিন্ন স্থান বা জলাশয়ে ফেলা হচ্ছে এসব বর্জ্য। এতে পরিবেশের জন্য যেমন হুমকি তৈরি করছে, একইসঙ্গে জমির উর্বরতা কমছে। এছাড়া প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে নদী, খাল-বিল মরে যাচ্ছে।
এই অবস্থায় দেশে প্রথমবারের মতো গ্রামীণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কৌশল গ্রহণ করা হয়েছে। এর মাধ্যমে রিসাইকেলযোগ্য বর্জ্য পুনর্ব্যবহার ও উদ্যোক্তা তৈরির পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে।
শহরের সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে 'আমার গ্রাম আমার শহর' কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের আওতায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) এই সমীক্ষাটি করেছে।
দেশের বিভিন্ন এলাকার ১৫ ইউনিয়নের ১৫০ টি গ্রাম এবং ৪০টি ছোট, বড় ও মাঝারি আকারের হাটবাজারের ওপর এই জরিপ পরিচালনা করা হয়।
কারিগরি সহায়তা প্রকল্পের পরিচালক মনজুর সাদেক বলেন, 'শহরের সুবিধা গ্রামে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে সরকারের যে অঙ্গীকার রয়েছে, তার অংশ হিসেবে গ্রামীণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পরিকল্পিত গ্রামে নগর সুবিধা সম্প্রসারণের একটি অংশ।
'এই সমীক্ষায় সারা দেশে গ্রামীণ এলাকায় পরিকল্পতি বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কৌশল উঠে এসেছে, যার মাধ্যমে টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেবে বলে আশা করা হচ্ছে।'
হাট-বাজারের বর্জ্য
সমীক্ষা প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, বাংলাদেশের গ্রামীণ বাজারগুলোতে প্রতিদিন প্রায় ৪ হাজার ২৯০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে। বড় ধরনের যেসব হাট-বাজারে কমবেশি ১ হাজার ৫০০ দোকান রয়েছে, সেখানে গড়ে ২ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। হাটের দিনে ২.৫ টন এবং অন্যান্য দিনে এক থেকে দেড় টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়।
বাজারে পচনশীল বর্জ্য ৫৬.৭৭ শতাংশ থেকে ৬০ শতাংশ, অপঁচনশীল ৩৬.৬২ থেকে ৩৭.৫৩ শতাংশ এবং মেডিক্যাল বা বিপজ্জনক বর্জ্য উৎপন্ন হয় ২.৮১ থেকে ৪.৪৯ শতাংশ।
উপজেলা সদর বা পৌরসভা এলাকায় হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনোস্টিক সেন্টার বেশি থাকায় মেডিক্যাল বা বিপদজ্জনক বর্জ্য বেশি হতে পারে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশে গ্রামীণ বাজারভিত্তিক বিজ্ঞানসম্মত ও সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার প্রচলন এখনও শুরু হয়নি। তবে বাজার পর্যায়ে পরিষ্কার রাখার প্রচলন বহুদিন পূর্বেই শুরু হয়েছে। বাজারের বর্জ্য পরিস্কার করে বাজারের পাশে উন্মুক্ত স্থানে বা জলাশয়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে, যা পক্ষান্তরে সার্বিক পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নাচোল উপজেলার উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাইমেনা শারমিন বলেন, 'গ্রামের হাট-বাজারগুলো যারা ইজারা নেন, তারাই সেগুলোর বর্জ্য পরিষ্কার করেন। বাজারের পাশের কোনো খাস জমি বা জলাশয়ে এসব বর্জ্য ফেলা হয়। এটা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হলেও গ্রামীণ এলাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে উঠেনি। শুধু উপজেলা পরিষদ থেকে মাঝে মাঝে মনিটরিং করা হয়।'
গ্রামীণ পয়ঃবর্জ্য
গ্রামে মাত্র ১.৪৩ শতাংশ বাড়িতে ল্যাট্রিন নেই। বাকি ৯৮.৫৭ শতাংশ বাড়িতে খোলা স্থানে মলত্যাগ না করলেও সঠিক পয়ঃবর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় বর্জ্য বেশিরভাগ অংশই জলাশয় কিংবা খোলা স্থানে জমা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাধারণভাবে গ্রামাঞ্চলে জৈব্য বর্জ্য নিয়ন্ত্রণ করা সহজ। তবে শহরের মতো গ্রামেও অনিয়ন্ত্রিত জৈব বর্জ্য দ্রুত বেড়ে চলেছে। জনসংখ্যার ঘনত্ব বেশি থাকা গ্রামাঞ্চল, যেমন ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, কক্সবাজার উপজেলায় জৈব বর্জ্য অনিয়ন্ত্রিত। বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকায় এসব এলাকার গ্রামগুলো নগরের চেয়ে বেশি দূষিত ।
অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হাট-বাজারে যত বর্জ্য উৎপন্ন হয় তার ৭৫ শতাংশের বেশি জৈব বর্জ্য ।
এতে আরো বলা হচ্ছে, মহানগর ও গ্রামের হাট-বাজারের বর্জ্য থেকে প্রতিদিন ১০ হাজার টন মিথেন গ্যাস বায়ূমণ্ডলে মিশে যাচ্ছে। ফলে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। বর্জ্যের কারণে বিভিন্ন প্রকার চর্ম রোগসহ নতুন নতুন কঠিন রোগ হচ্ছে।
সরকারের গ্রামীণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নীতিমালা
বিভিন্ন সময় তৈরি করা সরকারি নীতিমালা, গাইডলাইন বা পরিকল্পনা দলিলে গ্রামীণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। কিন্ত এখনও এর বাস্তবায়ন দেখা যায়নি।
যেমন, কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিধিমালা ২০২১-এ বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন পরিষদের দায়িত্ব উল্লেখ করা হয়েছে।
এই বিধিমালায় বলা হয়েছে, বর্জ্য সৃষ্টিকারী তিনটি বিনে বর্জ্য জমা করবে। এটা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদের।
নড়াইলের লোহাগড়া উপজেলার উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আজগর আলী বলেন, 'বর্জ্য নিয়ে সরকারের বিভিন্ন আইন রয়েছে। কিন্ত এর প্রয়োগ নেই।
'মাঝে মাঝে সচেতনামূলক কার্যক্রম নেওয়া হয়। বিভিন্ন সভায় বর্জ্য ব্যববস্থাপনা নিয়ে কেমল আলোচনা হয়। কিন্তু গ্রামীণ এলাকায় বর্জ্য ব্যবস্থাপানা বলে কিছু নেই।'
অবকাঠামো উন্নয়নের প্রস্তাব
সমীক্ষা প্রতিবেদনে, পৌরসভা এবং উপজেলার আশপাশের গ্রামগুলোকে নিয়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এছাড়া ৩০০-৪০০ বাড়িকে নিয়েও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্ল্যান্ট স্থাপনের কথাও বলা হয়েছে।
সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উন্মুক্ত স্থানে মলত্যাগ করা যাবে না বা টয়লেটের পানি জলাশয়ে যাবে না, এমন বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে হবে।
বাড়ি পর্যায়ে বা কমিউনিটিভিত্তিক জৈব সার উৎপাদনে ছোট প্ল্যান্ট স্থাপনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।
জৈব ও অজৈব্য বর্জ্য সংগ্রহে প্রতিটি বাড়িতে বিভিন্ন রংয়ের বিন সরবরাহ করা হবে। বাড়ি গিয়ে ১৫ দিনে বা প্রতি মাসে প্লাস্টিক বর্জ্য সংগ্রহ করবে ইউনিয়ন পরিষদ।
হাট-বাজারে তিনটি আলাদা কম্পার্টমেন্টযুক্ত ডাস্টবিন স্থাপন করা হবে। বাজারের ধরন বা আকার অনুযায়ী কসাইখানা, মুরগীর বর্জ্যভিত্তিক বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট, কম্পোস্ট প্ল্যান্ট, প্লাস্টিক বর্জ্য প্রক্রিয়াকরণ প্ল্যান্ট, বিপজ্জনক বর্জ্য নিষ্পত্তির জন্য ইনসেনারেটর এবং ছোট আকারের ল্যান্ডফিল স্থাপন করা হবে। ড্রেনেজ ব্যবস্থারও উন্নয়ন করা হবে।
প্ল্যাস্টিক ও চিকিৎসা বর্জ্য উন্মুক্ত হাট-বাজারের প্ল্যান্টে ফেলা হবে অথবা নিকটবর্তী সেন্টারে পাঠানো হবে। হাট-বাজারে সোকঅ্যাওয়ের সেপটিক ট্যাংকসহ পাবলিক টয়লেট স্থাপন করা হবে।
বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করার উদ্যোগ
প্রতিবেদনে বর্জ্যকে সম্পদে পরিণত করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ভারতের মতো বর্জ্য প্লাস্টিক দিয়ে পরীক্ষামূলক রাস্তা নির্মাণ কাজ শুরু করেছে এলজিইডি। এলজিইডি এক বছর আগে প্রথমবারের মতো রাস্তা টেকসই করতে বিটুমিনের সঙ্গে নন-রিসাইক্লেবল পাতলা পলিইথিলিন মিশিয়ে রাস্তা নির্মাণ করে।
যেসব বর্জ্য পলিথিনের পুনর্ব্যবহার মূল্য নেই, সেগুলো ময়লার ডিপো থেকে ব্যবহারোপযোগী করা পর্যন্ত প্রতি কেজিতে ব্যয় হয় ২৭ টাকা। ফলে এ ধরনের সড়কে নির্মাণ ব্যয় কমবে বলে জানান এলজিইডির কর্মকর্তারা ।
এলজিইডির সুপারিন্টেনডিং ইঞ্জিনিয়ার আবু মোহাম্মদ শাহরিয়ার বলেন, 'প্লাস্টিক মেশানো বিটুমিন দিয়ে নির্মাণ শুরু হলে একদিকে যেমন সড়ক টেকসই হবে, অন্যদিকে দেশে প্লাস্টিক বর্জ্য আর যেখানে-সেখানে পড়ে থাকবে না। এতে কর্মসংস্থানও তৈরি হবে।'
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্জ্য প্লাস্টিক ব্যহার করে ফুটপাতে ব্যবহারযোগ্য বিভিন্ন প্রকার ব্লক, যেমন টাইলস, পার্টিশন বোর্ড, টেবিল টপ, ইট, গ্রামীণ পিট ল্যাট্রিনের জন্য রিং এবং নানা ধরনের স্যুভেনিয়, শোপিস বানানো সম্ভব। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে পরীক্ষামূলকভাবে এসব পণ্য উৎপাদন হচ্ছে।
মনজুর সাদেক বলেন, পাইলট প্রকল্পের আওতায় বর্জ্য প্লাস্টিক থেকে বিভিন্ন ধরণের পণ্য উৎপাদনে উপজেলা পর্যায়ে উদ্যোক্তা তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হবে । এক্ষেত্রে গ্রামীণ বেকার যুবকদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ ও ঋণ সহায়তাও দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা ওয়েস্ট কনসার্ন-এর গবেষণায় অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৮ লাখ ২১ হাজার ২৫০ টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদন হয়। এর মধ্যে কেবল ৫ লাখ ২৭ হাজার ৪২৫ টন প্লাস্টিক রিসাইকেল করা হয়।