চা-মূল্যে চিন্তা ক্রয়-বিক্রয় করেন ঢাবি শিক্ষার্থী রনি!
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2023/02/15/img_20230206_174148_0.jpg)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে টিএসসি-র সড়কদ্বীপের কোণায় ফ্লাস্কে করে চা বিক্রি করছেন এক তরুণ। ফ্লাস্কের সামনে ছোট্ট একটা হোয়াইট বোর্ডে লেখা 'এখানে চা মূল্যে চিন্তা ক্রয়-বিক্রয় করা হয়'। তরুণকে ঘিরে কিছু কৌতূহলী পথচারীর ভিড়। তাদের কেউ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, কেউ রিকশাচালক, কেউ আবার চলতি পথের পথিক। কাগজের কাপে চা হাতে দাঁড়িয়ে কথা বলছেন সবাই। চা বিক্রেতার ছবিও তুলছেন কেউ কেউ। যাকে ঘিরে সবার আগ্রহ সেই চা বিক্রেতার পরিচয়—ঢাবির থিয়েটার অ্যান্ড পারফর্ম্যান্স স্টাডিজ বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী মহিউদ্দিন রনি।
গত তিন মাস যাবত বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে চা বিক্রি করছেন রনি। শুরুতে অন্য বিক্রেতাদের সহযোগী হয়ে তাদের ফ্লাস্ক নিয়ে চা ফেরি করলেও জানুয়ারি থেকে নিজেই বানাচ্ছেন স্পেশাল লিকার চা। ১০ টাকায় প্রতি কাপ চায়ের সঙ্গে আশেপাশের মানুষদের মাঝে ছড়িয়ে দিচ্ছেন শুদ্ধাচারের শিক্ষা।
গত বছর জুলাই মাসে বাংলাদেশ রেলওয়ের দুর্নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে দেশজুড়ে আলোচনায় আসেন মহিউদ্দিন রনি। এর কয়েক মাস আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চিকিৎসা কেন্দ্রের আধুনিকায়নের দাবিতে অনশনে বসেছিলেন তিনি। রেলওয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে টানা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার কয়েক মাসের মাথায় অসুস্থ হয়ে পড়েন রনি। সে কারণে হাসপাতালে ভর্তি থাকতে হয়েছে বেশ কিছুদিন। হাসপাতালের বেডে শুয়ে আত্মশুদ্ধির ভাবনা থেকেই এই চা বিক্রির পরিকল্পনা করেন বলে জানান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-কে।
'আন্দোলন করার সময় অনেক জায়গা থেকেই নানান লোভনীয় প্রস্তাব এসেছে আমার কাছে। সেসব গ্রহণ না করায় শত্রুও তৈরি হয়েছে অনেক। এই আন্দোলন চালিয়ে যেতে ধার-দেনাও হয়েছে বেশ। আর্থিক সংকটের কারণে দুর্বল হয়ে যেতে চাই না আমি। নানা দিক থেকে আসা চাপের মুখে পড়ে আমার নৈতিকতার স্খলন যেন না হয়, তাই আত্মশুদ্ধির প্রক্রিয়াটা শুরু করা দরকার ছিল খুব। সেই প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবেই চা বিক্রির এই উদ্যোগ,' বলেন রনি।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2023/02/15/img_20230206_174231.jpg)
ঢাবির এই শিক্ষার্থী মনে করেন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে যে শিক্ষা দিচ্ছে তা জনসাধারণের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া তার গুরুদায়িত্ব। শিক্ষিত হলেই মানুষকে আমলা বা শাসক শ্রেণির কেউ হতে হবে—এই তত্ত্বে বিশ্বাসী না তিনি। তাই চা বিক্রিকে অর্থ উপার্জন আর জ্ঞানের আদান-প্রদান উভয়ের মাধ্যম হিসেবেই বেছে নিয়েছেন মহিউদ্দিন রনি।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হয়ে চা বিক্রি করে সমাজের শিক্ষাহীন, নিম্ন আয়ের মানুষের উপার্জনে ভাগ বসাচ্ছেন বলে রনির উদ্যোগকে প্রশ্নবিদ্ধ করছেন অনেকেই। শুধু 'ভাইরাল' হওয়ার জন্যই এই পথ বেছে নিয়েছেন বলে সন্দেহও রয়েছে কারো কারো।
মহিউদ্দিন রনির ভাষ্যে, 'অন্য কারো উপার্জনে ভাগ বসাচ্ছি এটা ভাবার কোনো কারণ নেই। বরং এখানে আমার কাজের মাধ্যমে আশপাশের নিম্ন আয়ের মানুষদের অবস্থার উন্নতি করার চেষ্টা করছি। এখানকার রিকশাওয়ালা থেকে শুরু করে ভ্রাম্যমাণ সব বিক্রেতারা আমার বন্ধুর মতো হয়ে গেছে। কীভাবে গ্রাহকদের সাথে ভালো করে কথা বলবে, কীভাবে ব্যবসায় উন্নতি হবে, কীভাবে নিজের উন্নয়ন করবে ইত্যাদি নানা বিষয়ে প্রতিনিয়ত পরামর্শ চায় তারা আমার কাছে। সর্বোচ্চ চেষ্টা করি তাদের সাহায্য করার।
'আমরা সবসময় আকাশ ছুঁয়ে বেড়ানোর চেষ্টা করি, এই আকাশ ছোঁয়ার চিন্তা বাদ দিয়ে মাটিতে থাকা মানুষদের মধ্যেও শুদ্ধাচার চর্চাটা শুরু করা দরকার। এতে দেশে ব্যালেন্স আসবে। সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আদান-প্রদান সমানভাবে না হলে কিন্তু দেশ স্মার্ট হবে না। ভাইরাল হওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। তিন মাস ধরে চা বিক্রি করলেও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কিন্তু কয়েকদিম আগেই প্রকাশ করি এই কথা।'
চায়ের ফ্লাস্কের সামনে থাকা হোয়াইট বোর্ডে লেখা 'চায়ের মূল্যে চিন্তা ক্রয়-বিক্রয়' সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে চাইলে রনি বলেন, 'আশপাশের মানুষদের সাথে চায়ের আড্ডায় প্রতিনিয়তই নতুন আইডিয়া চাই আমি। জিজ্ঞেস করি নিজেদের সামনে ঘটে যাওয়া নানা সমস্যা সমাধানের কোনো পথ আছে কি না তাদের চিন্তায়। কার্যকরী কোনো আইডিয়া তারা দিতে পারলে সে অনুযায়ী মূল্য পরিশোধ করি আমি তাদের।
'সব মানুষের ভেতরই কিন্তু অসাধারণ কোনো চিন্তা বা আইডিয়া থাকে। সেগুলোই বের করে আনার চেষ্টা করি আমি তাদের সাথে কথা বলে। এই আইডিয়ার মূল্য আমি চায়ের দামে মেটাই। আইডিয়াদাতার চাহিদা অনুযায়ী দুই কাপ, দশ কাপ বা দুইশো কাপ চা বা সমপরিমাণ নগদ টাকা তাদের দিই আমি। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে পাওয়া অভিনব চিন্তাগুলোকে কাজে লাগানো যায় কীভাবে সেই পরিকল্পনা করতে শুরু করি।'
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2023/02/15/img_20230206_174334.jpg)
চা বিক্রি করে রোজগার খুব কম নয় বলে জানান রনি। সাধারণত সন্ধ্যা থেকে শুরু করে ভোররাত পর্যন্ত চা ফেরি করেন তিনি। কোনো উৎসব বা বিশেষ দিন থাকলে আড়াই-তিনশো কাপ চা বিক্রি হয় তার একদিনেই। আর সাধারণ দিনগুলোতে বিক্রি হয় প্রায় ৭০-৮০ কাপ চা। সিলেটের চা বাগান থেকে সংগ্রহ করা চা পাতার সঙ্গে আরো ১২ জাতের মশলা দিয়ে এই চা বানান রনি। প্রতিদিন চা বানাতেই তার ব্যয় হয় তিন-চার ঘণ্টা।
পরিবার, বন্ধুবান্ধব থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ে রনির শিক্ষকেরাও রনির এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন। তারাও প্রায়ই রনির কাছ থেকে চা খেতে আসেন। কাজে ভালো করার নানা পরামর্শও দেন। বাংলাদেশের চা-কে শিল্প হিসেবে বিশ্বদরবারে উপস্থাপন করার স্বপ্ন দেখেন রনি।
যারা সংবাদমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই চা বিক্রি নিয়ে হাসি-ঠাট্টা বা গালমন্দ করছেন, তাদের চায়ের আড্ডায় আমন্ত্রণ জানান মহিউদ্দিন রনি। নিন্দুকদের সঙ্গে কথা বলে, ভাবনার আদান-প্রদান করে তাদের চিন্তার দেয়াল বদল করতে চান তিনি।
কয়েক মাসের এই উদ্যোগে সমাজের নিম্ন আয়ের মানুষদের সঙ্গে যে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ে উঠেছে তার, সেটিকেই নিজের সর্বোচ্চ পাওয়া হিসেবে গণ্য করেন ঢাবি শিক্ষার্থী এই চা বিক্রেতা তরুণ।