ভরা মৌসুমেও ঊর্ধ্বমুখী চায়ের বাজার: দুই সপ্তাহে কেজিতে বেড়েছে ৩০ টাকা
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2022/09/11/17th-intl-tea-auction-in-ctg_0.jpg)
চা উৎপাদনের ভরা মৌসুম চলছে এখন। এই সময়ে চায়ের নিলাম ও পাইকারি-খুচরা বাজারে পণ্যটির দাম কমে আসে। কিন্তু এবারে দাম না কমে উল্টো বাড়ছে। গত দুই সপ্তাহে নিলাম ও বাজারে মানভেদে প্রতি কেজি চায়ের দাম ৩০-৪০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। গেল মাসে টানা তিন সপ্তাহ শ্রমিক মজুরি বৃদ্ধির আন্দোলনে পাতা সংগ্রহ বন্ধ থাকায় চায়ের দামে প্রভাব পড়েছে বলে জানিয়েছেন খাত সংশ্লিষ্টরা।
দেশের চায়ের প্রধান আন্তর্জাতিক নিলাম কেন্দ্র চট্টগ্রামে সর্বশেষ ১৭তম নিলামে (৫ সেপ্টেম্বর) কেজিপ্রতি চায়ের গড় দাম ছিল ২২০ টাকারও বেশি। এর আগের নিলামে (২৯ আগস্ট) চায়ের গড় দাম ছিল ২১০ টাকা। যদিও ১০ থেকে ১৫তম নিলামে চায়ের গড় দাম ছিল ১৯০-২০০ টাকার মধ্যে।
গত সোমবার (৫ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত হওয়া ১৭তম চট্টগ্রাম নিলামে বিক্রির জন্য চা প্রস্তাব করা হয়েছে ২৫ লাখ ৫৪ হাজার কেজি চা। যা ২০২১ সালের একই নিলামের চেয়ে ৫ লাখ ১৫ হাজার কেজি কম। আগামী নিলামগুলোতেও একইভাবে তুলনামূলক কম চা বিক্রির জন্য প্রস্তাব করা হবে বলে জানিয়েছেন ব্রোকার্স প্রতিষ্ঠানগুলো। এর আগে প্রতিটি নিলামে গড়ে ৬০ থেকে ৬৫ শতাংশ চা বিক্রি হলেও সাম্প্রতিক নিলামগুলোতে ৮০ থেকে ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত চা বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। ফলে সরবরাহের চেয়ে চাহিদা বেশি হওয়ায় দামে প্রভাব পড়ছে বলে মনে করছেন ব্যবসায়ীরা।
ব্রোকার্স প্রতিষ্ঠান, পাইকারি ও খুচরা বিক্রয় প্রতিষ্ঠানের দেওয়া তথ্যে দেখা গিয়েছে, গত তিন নিলাম থেকেই চায়ের দাম বাড়ছে। এরই মধ্যে পঞ্চগড়সহ দেশের বিভিন্ন বাগানের মোটা চায়ের দাম কেজিপ্রতি বেড়েছে ২০ টাকা। অন্যদিকে ভালোমানের ক্লোনসহ বিভিন্ন গ্রেডের চায়ের দাম বেড়েছে কেজিপ্রতি সর্বোচ্চ ৪০ টাকা।
নিলামের তথ্যমতে, ভরা মৌসুমে আগের বছরের চেয়ে প্রতিটি নিলামে বাড়তি চা সরবরাহের ঘোষণা দেয়া হলেও সাম্প্রতিক নিলামগুলোতে চায়ের সরবরাহ ছিল কম। এমনকি বাজারে আসতে থাকা চায়ের গুণগত মানও কমে আসছে। শ্রমিকদের ধর্মঘটের প্রভাব আরও কয়েক সপ্তাহ থাকতে পারে এমন তথ্যে সাম্প্রতিক নিলামগুলো থেকে ভালোমানের চা সংগ্রহে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলো। যে কারণে গত তিন সপ্তাহে চায়ের গড় দাম ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
চা খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনুকূল আবহাওয়ার কারণে প্রতি বছর জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি চা উৎপাদন হয়। ফলে এই সময়ে নিলামে চায়ের দাম কিছুটা কমে যায়। কিন্তু সম্প্রতি শ্রমিক আন্দোলনের ফলে চা বাগানের অচলাবস্থার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে। ফলে বর্তমান নিলামে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে।
বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা জানান, ভালোমানের চা উৎপাদনের জন্য উত্কৃষ্ট হচ্ছে ৩ ইঞ্চি পরিমাণ পাতা। সাধারণত প্রতি ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে বাগানে চায়ের প্লাকিং করা হয়। কিন্তু শ্রমিক আন্দোলনের সময় প্রায় তিন সপ্তাহ প্লাকিং না করায় বাগানগুলোতে ৬ থেকে ১৫ ইঞ্চি পর্যন্ত পাতা গজিয়েছে। বাগানগুলোকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে যেতে বৃদ্ধি পাওয়া অংশগুলো কেটে ফেলা জরুরী। এ কারণে গুণগত মান কম হলেও এসব পাতা সংগ্রহ করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বাগান মালিকরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ টি ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সহ সভাপতি মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, সরবরাহ কমে গেলে স্বাভাবিকভাবেই চাহিদার কারণে দামে প্রভাব পড়বে। দেশে বছর বছর চায়ের উৎপাদন কিছুটা বাড়লেও জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধির তুলনায় এই উৎপাদন কম। তাছাড়া সাম্প্রতিক ধর্মঘটের ঘটনায় উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটেছে। অন্যদিকে বিগত বছরের মতো এ বছর বৃষ্টিপাত না হওয়ায় সেটিও উৎপাদনে প্রভাব ফেলেছে। ফলে নিলাম, খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে চায়ের বাজার ঊর্ধ্বমুখী হয়েছে।
জানতে চাইলে প্ল্যান্টার্স ব্রোকার্সের স্বত্বাধিকারী মো. করিম বলেন, বাজারে চা সরবরাহ আপাতত স্বাভাবিক রয়েছে। তবে গত কয়েকটি নিলামে চায়ের গড় দাম কিছুটা বেড়েছে। এক্ষেত্রে বাগানের চা শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধিজনিত উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ার বিষয়টি আরো পরে প্রভাব ফেলতে পারে। তবে নিলাম কিংবা বাগান মালিকরা লাভবান না হলেও খুচরা ও পাইকারি বাজারে এরই মধ্যে চায়ের দাম বেড়ে গিয়েছে। এটা মজুদপ্রবণতা কিংবা হুজুগের কারণেও হতে পারে।
চট্টগ্রামের নিলামে দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশেরও বেশি চা বিক্রি হয়। প্রস্তাব করা গড়ে ৭০ শতাংশ চা বিক্রি হয় নিলামে। তবে গত কয়েকটি নিলামে উত্তোলনকৃত চায়ের ৮৫-৯০ শতাংশই কিনে নিয়েছে ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো। অর্থাৎ নিলাম থেকে ফেরত গিয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ চা। আগামী নিলামগুলোতে চা সরবরাহ আরো কমে যাওয়ার আশঙ্কায় ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সংগ্রহ বাড়ানোর প্রতিযোগিতায় নেমেছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
চট্টগ্রামের মেসার্স পাবনা টি হাউজের স্বত্বাধিকারী মো. আবদুর রহমান বলেন, বছরের মাঝামাঝিতে বাগান থেকে সবচেয়ে ভালোমানের চা সরবরাহ হয়। বছরব্যাপী ব্র্যান্ডিং করে বিপণন করতে এ সময়ই সবচেয়ে বেশি চা সংগ্রহ করে মোড়কজাত কোম্পানি ও ব্যবসায়ীর। কিন্তু গত দুই নিলামে চাহিদা অনুপাতে চায়ের সরবরাহ কম থাকায় দাম বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বেড়েছে ভালোমানের ক্লোন চায়ের দাম।
এর আগে দৈনিক মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে ৯ আগস্ট থেকে ১৯ দিন প্রায় দেড় লাখ শ্রমিকের আন্দোলনে কার্যত অচল ছিল দেশের চা উৎপাদন খাত। ২৮ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাগান মালিকদের বৈঠকে শ্রমিকদের দৈনিক ন্যূনতম মজুরি ১৭০ টাকা নির্ধারণ করে দিলে কাজে ফেরে শ্রমিকরা।