নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহের জন্য ডলার চান বিদ্যুৎ উৎপাদকরা
গ্রীষ্মের মাসগুলোতে ব্যাপক থাকে বিদ্যুতের চাহিদা, তার আগেই বিদ্যুৎ উৎপাদন বাধামুক্ত রাখতে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের সংগঠন– বাংলাদেশ ইনডিপেন্ডেন্ট পাওয়ার প্রডিউসারস অ্যাসোসিয়েশন (বিপ্পা) বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোয় ডলার সরবরাহের অনুরোধ করেছে। বুধবার (১৫ ফেব্রুয়ারি) একইসাথে, অন্য তিন দাবিও জানায় তারা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংককে দেওয়া এক চিঠিতে বিপ্পা ডলার সরবরাহের অনুরোধ করে, যাতে তা দিয়ে আউটস্ট্যান্ডিং ঋণপত্র নিষ্পন্ন করা যায়। দেশে ডলার সংকট দেখা দেওয়ার পর থেকেই এবিষয়ে সমস্যার মধ্যে রয়েছে তারা।
বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহৃত হেভি ফুয়েল অয়েল (এইচএফও), লিউব অয়েল এবং যন্ত্রাংশ আমদানির জন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে এলসি প্রক্রিয়ায় সহায়তা দিতেও বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের সংগঠনটি।
বিপ্পার চিঠিতে সতর্ক করে বলা হয়, আবহাওয়া উষ্ণ হওয়ার সাথে সাথে বিদ্যুতের চাহিদাও ঊর্ধ্বমুখী হবে।
'এছাড়াও বোরো মওসুমের শুরুতে এবং আসন্ন রমজানে বিদ্যুতের চাহিদা তীব্রভাবে বাড়বে। আমরা মনে করি, বাংলাদেশ ব্যাংকের সহযোগিতা পেলে, গুরুত্বপূর্ণ এসময়ে দেশ ব্যাপক লোডশেডিংয়ের মধ্যে পড়ার আগেই আমরা আলোচিত বিষয়গুলোকে কিছুটা প্রশমিত করতে পারব'।
এছাড়া, বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতের জন্য সিঙ্গেল বোরোয়ার লিমিট (একক ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের অনুকুলে ঋণ সীমা) বাড়ানোর অনুরোধও করেছে। বর্তমানে সিঙ্গেল বোরোয়ার এক্সপোজার লিমিট ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক মূলধনের ২৫ শতাংশ রয়েছে।
ডলারের দর বৃদ্ধির মধ্যে, গত বছরের জুলাইয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বিদ্যুৎ উৎপাদকদের ক্ষেত্রে ছয় মাসের জন্য সিঙ্গেল বোরোয়ার এক্সপোজার লিমিট প্রত্যাহার করে।
গত ১২ ফেব্রুয়ারি বিপ্পার সভাপতি ফয়সাল খান স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে 'বিপুল পরিমাণ দেনা পরিশোধে' সহায়তা দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিল সংগঠনটি।
পিডিবির কর্মকর্তারা জানান, বর্তমানে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকদের কাছে সরকারের দেনা প্রায় ১৬ হাজার কোটি টাকা। গত মাসে যা ছিল প্রায় ২২ হাজার কোটি টাকা।
বিপ্পা উল্লেখ করে যে, বাজারে ডলার স্বল্পতার কারণে বিদ্যুতের চাহিদা মেটানোর মতো এইচএফও, লিউব অয়েল ও যন্ত্রাংশের মজুদ নেই এর সদস্য কোম্পানিগুলোর, ফলে তারা উৎপাদনের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারবে না।
একইসঙ্গে চলমান আর্থিক সংকট এবং ডলারের ঘাটতি অব্যাহত থাকায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এসব পণ্য আমদানির ঋণপত্র খুলতেও অসম্মতি জানায়।
'পিডিবির থেকে মাসিক বিদ্যুৎ বিল পেতে দীর্ঘসময় লেগে যাওয়ায় আমাদের সদস্য কোম্পানিগুলো চরম অর্থ-প্রবাহের সংকটে রয়েছে। চলতি মূলধনের চাহিদা এবং মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে আমাদের সদস্যরা ব্যাপক আর্থিক লোকসানের মধ্যে পড়েছে'।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মেজবাউল হক বলেন, 'আমরা চিঠিটি পেয়েছি এবং বিষয়টি খতিয়ে দেখবে। সরকার যেসব খাতে গুরুত্ব দিচ্ছে, আমরা সেগুলো পর্যালোচনা করে দরকার মতো ডলার সরবরাহ করব'।
বিপ্পার সভাপতি ফয়সাল খান দ্য বিজনেস ট্যান্ডার্ডকে জানান, এইচএফও আমদানির জন্য কী পরিমাণ ডলার প্রয়োজন সেবিষয়ে তারা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নরের সাথে একটি বৈঠক করেছেন।
'তিনি আমাদের আশ্বস্ত করেছেন যে, এলসি খোলা ও নিষ্পত্তির জন্য দরকারি বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ করবেন' বলেন ফয়সাল।
'বর্তমানে আমরা বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য দরকারি জ্বালানির মাত্র ৭০ শতাংশ আমদানি করতে পারছি। কিন্তু, বাকি ৩০ শতাংশ জ্বালানি আমদানি নিশ্চিত করা না গেলে তেল-ভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর উৎপাদন পরিস্থিতির উন্নতি হবে না বা গ্রীষ্মকালীন উচ্চ চাহিদা মেটানোর মতো যথেষ্ট হবে না'- যোগ করেন তিনি।
সৌজন্য সাক্ষাৎ চেয়েও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের কাছে চিঠি দিয়েছে বিপ্পা।
সাধারণত, মোট বিদ্যুৎ চাহিদার ২৬ শতাংশ পূরণে বিপ্পার মাসে সাড়ে ৩ লাখ টন ফার্নেস অয়েল প্রয়োজন হয়।
বর্তমানে দেশে কৃষকদের পরিচালিত ১৫ লাখ সেচ পাম্প সচল রয়েছে। এর এক-তৃতীয়াংশ বিদ্যুৎ-চালিত, বাকিগুলো ডিজেল-চালিত।
বগুড়ার সারিয়াকান্দি এলাকার কৃষক আলিমুদ্দিন বিশু বৈদ্যুতিক পাম্পের মাধ্যমে প্রায় ৬০ বিঘা জমিতে সেচ দেন। কিন্তু কিছুদিন হলো লোডশেডিং খুব বেড়েছে। দিনে এখন ৫ থেকে ৭ সাত বার লোডশেডিং হয়। ফলে তিনি রাতে সেচ দিতে বাধ্য হয়েছেন।
বিশুর জমির পাশে ডিজেল চালিত পাম্প দিয়ে পানি সেচ দেন আরেক চাষী সাজু প্রামাণিক। ৫ বিঘা জমিতে তিনি এবার বোরা ধান চাষ করছেন।
পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ লিমিটেড (পিজিসিবি) বগুড়া কার্যালয় জানায়, বগুড়ায় তিনটি গ্রিডে পিক আওয়ারে বিদ্যুতের চাহিদা ১২০ মেগাওয়াট।
'এখন সরবরাহ করা হচ্ছে এর ৮০ থেকে ৯০ শতাংশ' বলেন পিজিসিবি বগুড়া কার্যালয়ের সহকারী প্রকৌশলী ইকবাল হোসেন। বিদ্যুতের চাহিদা গরমকালে আরো ৩০ শতাংশ বাড়ে বলেও জানান তিনি।
এদিকে পিডিবির মূল্য পরিশোধে দেরি হওয়ায় বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদকরা আর্থিক ক্ষতির মধ্যে পড়েছে; চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে তালিকাভুক্ত আটটি পাওয়ার কোম্পানির মধ্যে চারটি-ই লোকসানের কথা জানিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর কর্মকর্তাদের মতে, বিদ্যুৎ সরবরাহ করার ৪৫ দিনের মধ্যে জ্বালানি আমদানি ও ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধের কথা পিডিবির; কিন্তু এসব চার্জ ডলারে দিতে হয় আর ডলার সংকটের কারণে রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাটি তা সময়মতো দিতেও পারছে না।
দেরিতে এই মূল্য পরিশোধের কারণে কীভাবে – ব্যাংক ঋণ বৃদ্ধি এবং বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারে লোকসান – এ দুই ধরনের সমস্যার মধ্যে তারা পড়েছেন সেকথা এরআগে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেছিলেন বিপ্পার সাবেক সভাপতি ইমরান করিম।
তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, এপ্রিলের বকেয়া বিল তারা সেপ্টেম্বর মাসে পান, এরপর ব্যাংককে জ্বালানি আমদানির মূল্য পরিশোধ করেন। 'আমরা এপ্রিলে ডলারের যে দর ছিল সেই হারে বিদ্যুতের দাম পাই। কিন্তু, সেপ্টেম্বরে বিল পাওয়ার পর ব্যাংককে ডলারের আরো উচ্চ দরে জ্বালানি মূল্য পরিশোধ করতে হয়'। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হারের উত্থান কীভাবে তাদের খরচ বাড়াচ্ছে তার ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন তিনি।
গত মাসে তাদের সংগঠনটি আসন্ন গ্রীষ্মকালের বর্ধিত বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে এবং ব্যয়বহুল তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস আমদানির বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ে– এইচএফও বা ফার্নেস অয়েল-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর ব্যবহার বৃদ্ধির প্রস্তাব দেয়।
বিদ্যুৎ বিভাগকে দেওয়া এই প্রস্তাবনায়, হিসাব দেওয়া হয় যে, চলতি বছর ফার্নেস অয়েল-চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবহার ৪০-৬৬ শতাংশ বাড়ানো যাবে এবং এতে ব্যয়বহুল স্পট এলএনজি আমদানির প্রয়োজনীয়তা কমে আসায় সরকারের বিদ্যুৎ ব্যয় সাশ্রয় হবে।