মাতারবাড়ি বন্দরে নির্মিত হলো দেশের প্রথম ব্রেকওয়াটার বাঁধ
মেরিটাইম সেক্টরে বাংলাদেশের গভীর সমুদ্রবন্দরের যাত্রা শুরু হচ্ছে ২০২৬ সালে। কক্সবাজার জেলার মহেশখালীতে গড়ে উঠছে এই সমুদ্রবন্দর। তবে প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার আগেই সেখানে নির্মিত হয়েছে দেশের প্রথম ব্রেকওয়াটার (ঢেউ নিরোধক বাঁধ)।
তৈরি করা হয়েছে ১৪ দশমিক ৩ কিলোমিটার লম্বা অ্যাপ্রোচ চ্যানেল ও দুটি জেটি। এ লক্ষ্যে চ্যানেলের উত্তর দিকে ২ হাজার ১৫০ মিটার এবং দক্ষিণে ৬৭০ মিটার লম্বা ব্রেকওয়াটার তৈরি করা হয়েছে। সাগরের উত্তাল ঢেউয়ের মধ্যে পাথরের ব্লক ফেলে তৈরি করা হয়েছে এটি।
মাতারবাড়ি কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালামাল নিয়ে ইতোমধ্যে দুটি জেটিতে ভিড়েছে শতাধিক জাহাজ। দুটি জেটি, ১৬ মিটার গভীরতা এবং ১৪ কিলোমিটার দীর্ঘ চ্যানেল বা প্রবেশ পথ, ব্রেকওয়াটার নির্মিত হয়েছে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের অধীনে। কয়লা ভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মালামাল আমদানির জন্য ওই এলাকায় দুটি জেটি নির্মাণ করা হয়।
মাতারবাড়ি বন্দর বঙ্গোপসাগরের তীরে হওয়ায় উত্তাল ঢেউ প্রতিরোধ করতে ব্রেকওয়াটার নির্মাণ করা হয়েছে। এর ফলে জাহাজ জেটিতে থাকা অবস্থায় স্থির থাকবে, দুলবে না। এতে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস নির্বিঘ্ন হবে।
জলরাশি শান্ত, স্থির রাখা, পলি জমে চ্যানেল ভরাট হওয়ার ঝুঁকি কমানোর লক্ষ্যে মূলত ব্রেকওয়াটার তৈরি করা হয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের জেটিতে জাহাজগুলো গড়ে ২ হাজার টিইইউস কনটেইনার বহন করে, অথচ মাতারবাড়ি বন্দরের জেটিতে ৮ হাজার থেকে ১০ হাজার টিইইউস কনটেইনারবাহী জাহাজ প্রবেশ করতে পারবে।
সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরের এক অনুষ্ঠানে ২০২৬ সালে মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের কার্যক্রম শুরু হওয়ার ঘোষণা দেন নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। গত ২২ জানুয়ারি পরিবহন মন্ত্রণালয় সংসদীয় কমিটির সদস্যরা প্রকল্প এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করে একই তথ্য জানান।
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এম শাহজাহান মাতারবাড়ি বন্দর প্রসঙ্গে বলেন, মাতারবাড়ি বন্দর চালু হলে এটি ব্যবসা-বাণিজ্যের রিজিওনাল হাব হিসেবে পরিণত হবে। বিশ্বের বিভিন্ন বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে সরাসরি জাহাজ চলাচল করতে পারবে।
মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্পের সাথে যুক্ত বন্দর কর্মকর্তারা জানান, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের টার্মিনাল নির্মাণের জন্য টেন্ডার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। ২০২২ সালের নভেম্বরে দরপত্র খোলা হয়েছে। শীঘ্রই ঠিকাদার নিয়োগের মাধ্যমে শুরু হবে জেটি নির্মাণ কাজ। নির্মাণ করা হবে ৭৬০ মিটার লম্বা জেটি।
এর মধ্যে ৪৬০ মিটার লম্বা জেটিতে ভিড়তে পারবে ৩৫০ মিটার লম্বা কন্টেইনার জাহাজ এবং ৩০০ মিটার লম্বা জেটিতে ভিড়তে পারবে ২০০ মিটার লম্বা জাহাজ। নৌপথে গভীরতা ১৬ মিটার। এই গভীরতা ব্যবহার করে ১৪.৫ মিটার থেকে ১৫ মিটার ড্রাফটের (জাহাজের পানির নিচের অংশ) জাহাজ ভেড়ানো সম্ভব হবে।
মাতারবাড়ি টার্মিনাল থেকে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক পর্যন্ত ২৭ কিলোমিটার সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ শুরু হবে আগামী মার্চে।
মাতারবাড়ি বন্দর উন্নয়নে ব্যয় ধরা হয়েছে ১৭ হাজার ৭৭৭ কোটি টাকা। এর মধ্যে জাইকার ঋণ ১২,৮৯২ কোটি, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নিজস্ব তহবিল ২ হাজার ২১৩ কোটি টাকা এবং বাংলাদেশ সরকারের ২,৬৭১ কোটি টাকা। প্রকল্প নির্মাণের মেয়াদ ২০২১ সাল থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত।
মাতারবাড়িতে ১,২০০ মেগাওয়াটের মাতারবাড়ি আল্ট্রা সুপার ক্রিটিক্যাল কোল-ফায়ারড পাওয়ার প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করছে দ্য কোল পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেড (সিপিজিসিবিএল)।
২০১৪ সালে অনুমোদিত প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩৫,৯৮৪ কোটি টাকা কিন্তু পরে তা বেড়ে ৫১,৮৫৫ কোটি টাকায় দাঁড়ায়। ২০২৬ সালের জুলাইয়ে এটি শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
সিপিজিসিবিএলের নির্বাহী পরিচালক আবুল কালাম আজাদ টিবিএসকে বলেন, "এখন পর্যন্ত প্রকল্পের ৭৫% কাজ সম্পন্ন হয়েছে। আমরা দুটি জেটি ব্যবহার করে দ্রুত আমদানিকৃত পণ্য আনলোড করতে সক্ষম হয়েছি। মার্চে ৬০ হাজার থেকে ৮০ হাজার মেট্রিক টন পর্যন্ত কয়লা নিয়ে বড় জাহাজ জেটিতে ভিড়বে। ২০২৫ এর শেষ অথবা ২০২৬ এর শুরুর দিকে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হবে।"
২০২০ সালের ২৯ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো প্রকল্পের জন্য যন্ত্রপাতি বহনকারী একটি বিদেশি জাহাজ পৌঁছায় মাতারবাড়ি জেটিতে, দ্বিতীয়টি আসে পরের বছরের ১৫ জুলাই। এখন পর্যন্ত ১১২টি জাহাজ কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের জন্য সামগ্রী এনেছে।
এসব জাহাজকে পাইলটেজ সেবা, টাগবোট সাপোর্ট, রেডিও কন্ট্রোল ও ভিটিএমআইএস (ভেসেল ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম), আইএসপিএস (ইন্টারন্যাশনাল শিপ এন্ড পোর্ট ফ্যাসিলিটি সিকিউরিটি কোড) আর স্টিভডোরিং সেবা দিয়েছে চট্টগ্রাম বন্দর।
এসব জাহাজে পণ্য হ্যান্ডলিং হয়েছে প্রায় ১.৩৭ লাখ মেট্রিক টন। এতে চট্টগ্রাম বন্দরের রাজস্ব আয় হয়েছে ৬ কোটি ৮৪ লাখ টাকা।