মাখোঁকে নেপোলিয়নের পরিণতির কথা স্মরণ করিয়ে দিল রাশিয়া, কী ঘটেছিল?
রাশিয়াকে হারতে দেখতে চায় বলে মন্তব্য করার পর, রাশিয়া গতকাল রোববার ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁকে তিরস্কার করে বলে, রাশিয়া এখনো নেপোলিয়নের কথা মনে রেখেছে। ফরাসি প্রেসিডেন্টকে ক্রেমলিনের সাথে দ্বিমুখী কূটনীতি বজায় রাখার জন্যেও তিরস্কারও করে রুশরা।
মাখোঁ এক ফরাসি পত্রিকায় ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ সম্পর্কে মন্তব্য করেন, তিনি রাশিয়াকে হারতে দেখতে চান, কিন্তু কখনোই চান না তারা একেবারে ধ্বংস হয়ে যাক।
রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র মারিয়া জাখারোভা জানান, "মাখোঁই প্রথম ফরাসি নন, যে রাশিয়াকে ধ্বংস করতে চেয়েছিল। প্যারিসের কেন্দ্রে এখনো তার সমাধি রয়েছে, ফরাসিদের কাছে পরম পূজনীয় 'নেপোলিয়ন'। ফ্রান্সের বোঝা উচিৎ।"
মারিয়ার মতে, মাখোঁর এই মন্তব্য থেকে বোঝা যায় যে, পশ্চিমারা রাশিয়ার শাসক পরিবর্তন করার চিন্তা করছে। এদিকে মাখোঁ রাশিয়ার নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ক্রমাগত। ন্যাটো মিত্রদের কাছ থেকেও তিরস্কারের শিকার হয়েছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে কোনো পক্ষ সম্পর্কেই সরাসরি কিছু বলছেন না তিনি। অনেকেই মনে করছেন পশ্চিমা মিত্র দলগুলোর মধ্যে ফ্রান্স একটি দুর্বল সংযোগ।
গত শুক্রবার মাখোঁ ইউক্রেনের প্রতি সামরিক সহায়তা বাড়ানোর অনুরোধ করেন, তবে রাশিয়ার নেতৃত্ব পরিবর্তন নিয়েও তিনি একমত নন। তার মতে, এখানে আলোচনার প্রয়োজন রয়েছে।
"এখানে বিষয়টি স্পষ্ট করা প্রয়োজন, আমি কখনোই এক সেকেন্ডের জন্যেও ভাবিনি যে রাশিয়ার শাসক পরিবর্তন হবে। এবং যারা এই শাসককে পরিবর্তন করতে চাচ্ছেন, তাদেরকে আমি প্রশ্ন করতে চাই, 'কী পরিবর্তন করবেন আপনারা? কে হবে এরপরের নেতা? আপনাদের নেতা কে?'"
তার মন্তব্যকে আরও স্পষ্ট করে মাখোঁ বলেন যে দীর্ঘ সময় ধরে চলা রাশিয়ার বর্তমান শাসনব্যবস্থার পর রাশিয়ার সিভিল সোসাইটি থেকে কোনো গণতান্ত্রিক উপায় বের হয়ে আসার সম্ভাবনা নেই। পুতিনের কোনো বিকল্প নেই, যাকে অবশ্যই আলোচনার বৈঠকে আনতে হবে বলেও জানান তিনি। "পুতিন ছাড়া বর্তমান ব্যবস্থায় যারা আছে তারা পুতিনের চেয়েও খারাপ," বলে মন্তব্য করেন মাখোঁ।
কিন্তু রাশিয়া কেন মাখোঁকে নেপোলিয়নের নাম বলে সতর্ক করে দিয়েছে? 'দিগ্বিজয়ী' হিসেবে খ্যাতি পাওয়া নেপোলিয়ন কীভাবে রাশিয়ায় পর্যুদস্ত হয়েছিলেন?
নেপোলিয়নের রাশিয়া অভিযান
১৭৯৯ সালে ফ্রান্সের ক্ষমতার কেন্দ্রে চলে যাওয়ার পরপরই বেশ কয়েকটি যুদ্ধে জিতে ইউরোপের বড় একটি অংশ চলে যায় নেপোলিয়নের দখলে। বর্তমান সময়ের বেলজিয়াম এবং নেদারল্যান্ডসকে ফ্রান্সের মধ্যে ঢুকিয়ে নেন, সাথে ছিল বর্তমান ইতালি, ক্রোয়েশিয়া এবং জার্মানির বড় অংশ। সুইজারল্যান্ড, পোল্যান্ড এবং জার্মানির বেশ কিছু রাজ্যকে ফ্রান্সের পক্ষে চুক্তিবদ্ধ হতে বাধ্য করেন। স্পেনও তার বশ্যতা স্বীকার করে নেয় অনেকখানি, তবে মাঝেমধ্যেই গেরিলা আক্রমণ করে বিদ্রোহের জানান দেওয়া হতো। অস্ট্রিয়া, প্রুশিয়া আর রাশিয়াও বেশ কিছু যুদ্ধে হেরে মিত্রতা চুক্তিতে সায় দেয়। কেবল গ্রেট ব্রিটেন ছিল নেপোলিয়নের হাতের বাইরে।
১৮০৬ সালে নেপোলিয়ন ব্রিটিশদেরকে শায়েস্তা করার জন্য তাদের ওপর অবরোধ জারি করে। কিন্তু ১৯১০ সালে রাশিয়ার জার প্রথম আলেকজান্ডার রাশিয়ার বাণিজ্যের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব এবং রুবলের দাম কমতে থাকায় ফরাসিদের এই নিয়ম মানোট অস্বীকার করে। লেসের মতো ফরাসি বিলাসী পণ্যের ওপরেও বিশাল কর আরোপ করেন আলেকজান্ডার, সাথে তার এক বোনকে নেপোলিয়নের বিয়ে করার ইচ্ছাও প্রত্যাখ্যান করেন।
রাশিয়া আর ফ্রান্সের এই দ্বন্দ্বের শুরু হয়েছিল ১৮০৭ সালে ডাচি অফ ওয়ারশ তৈরির সময়। যদিও নেপোলিয়ন প্রুশিয়ার জমি ব্যবহার করে এই নতুন অঞ্চল তৈরির ঘোষণা দিয়েছিলেন, তারপরেও প্রথম আলেকজান্ডার মনে করেছিলেন এর ফলে পোলিশ জাতীয়তাবাদ তৈরি হবে। মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাদারল্যান্ডের মতে, "এই কারণে এখনো ফরাসি আর পোলিশদের মধ্যে এখনও চমৎকার সম্পর্ক টিকে রয়েছে।"
চুক্তিকে থাকতে অস্বীকার করা রাশিয়াকে শায়েস্তা করার জন্য নেপোলিয়ন খুব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন। সারা ইউরোপ থেকে রাশিয়া অভিযানের জন্য সৈন্য সংগ্রহ করা শুরু করলেন, জুনের ২৪ তারিখ যার প্রথম বহর ফ্রান্সে প্রবেশ করে। সাদারল্যান্ডের মতে, 'ক্রুসেডের পর এত বিশাল বৈচিত্র্যপূর্ণ ইউরোপীয় সৈন্য এর আগে একত্রিত হয়নি।' বিশেষজ্ঞদের মতে, সাড়ে চার লক্ষ থেকে সাড়ে ছয় লক্ষ সৈন্য নিমান নদী পার হয়ে রাশিয়ার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। এর বিপরীতে রাশিয়ার সৈন্য সংখ্যা ছিল দুই লক্ষ।
নেপোলিয়নের লক্ষ্য ছিল খুব দ্রুত রাশিয়া পরাজিত করে আলেকজান্ডারে আলোচনার বৈঠকে বসাতে বাধ্য করা। তবে রুশরা সরাসরি যুদ্ধে নামেনি, তার পরিবর্তে পিছু হটে। কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই ভিলনা শহর দখল করে নেয় গ্রান্দে আর্মি। অভিযানের পূর্বাভাস দিয়েই যেন, সেদিন রাতেই এক ঝড়ো শীতল বৃষ্টিতে মারা যায় গ্রান্দে আর্মির বহু সৈন্য এবং ঘোড়া। তবে আরও খারাপ বিষয় হলো, খাবার আর লুট করার উদ্দেশ্যে অনেক সৈন্যই সেনাবাহিনী ছেড়ে অন্যত্র চলে যায়।
তবে নেপোলিয়ন আত্মবিশ্বাসী ছিলেন। তার সামরিক পরামর্শদাতাদের কাছে ঘোষণা দিলেন, "আমি এই একবারই এসেছিল উত্তরের বর্বরদেরকে নিকেশ করে দিতে। তলোয়ার খাপ থেকে বের করা হয়েছে, তাদেরকে একেবারে তাদের বরফঢাকা জমিতে ফিরিয়ে দিতে হবে, যাতে তারা আগামী ২৫ বছর নিজেদেরকে নিয়েই ব্যস্ত থাকে এবং সভ্য ইউরোপ নিয়ে নাক না গলায়।"
জুলাইয়ের শেষদিকে রুশরা একইভাবে ভিতেবস্ক শহর থেকেও পালিয়ে যায়, যাওয়ার আগে সামরিক সরঞ্জামসহ যোগাযোগের সেতুতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে যায়। অনেক কৃষকই তাদের ফসলে আগুন লাগিয়ে দেয়, যাতা ফরাসিরা কোনো খাবার না পায়। প্রিন্সটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ডেভিড বেল জানান যে, "ফরাসি সৈন্যদেরকে কুপোকাত করতে এই স্কর্চড আর্থ নীতি ভালোই কাজ করেছিল।" গ্রীষ্মের রোদের সাথে সাথে পতঙ্গ থেকে হওয়া টাইফাস আর পানিবাহিত রোগ ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে গ্রান্দে আর্মির সৈন্য সংখ্যা কমতে থাকে।
স্মোলেন্সকে কয়েক হাজার সৈন্য মারা গেলেও রুশরা সেপ্টেম্বরের ৭ তারিখে হওয়া বোরোদিনের যুদ্ধের আগে সরাসরি যুদ্ধ প্রান্তরে নামেনি। বোরোদিনের যুদ্ধে ফরাসি আর রুশরা একে অপরের বিরুদ্ধে কামান আর ঘোড়া নিয়ে একের পর এক আক্রমণ-পাল্টাআক্রমণ চালাতে থাকে। প্রতি সেকেন্ডে তিনটি গোলা আর সাতটি মাস্কেটের শব্দ শোনা যাচ্ছিলো বলে জানা যায়। দুই পক্ষেই ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়। কমপক্ষে ৭০ হাজার সৈন্য নিহত হয় যুদ্ধে। দ্বিতীয় দিনের যুদ্ধের জন্য অপেক্ষা না করেই রুশরা পালিয়ে যায়, মস্কোর দরজা খুলে রেখেই।
সেপ্টেম্বরের ১৪ তারিখ ফরাসিরা রাজধানী মস্কোতে ঢুকে দেখতে পায় মস্কোতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে। বেশিরভাগ অধিয়াবসীরাই শহর ছেড়ে পালিয়েছে। খাবার তেমন না থাকলেও রেখে গিয়েছে বিশাল পরিমাণ মদ। একদিকে ফরাসি সৈন্যরা আনন্দে মদ গিলছে, অন্যদিকে নেপোলিয়ন অপেক্ষা করছে আলেকজান্ডারের কাছ থেকে পাওয়া শান্তিচুক্তির। কিন্তু কোনো প্রস্তাব আসলো না। অক্টোবরের ১৯ তারিখ মাথার ওপরে তুষারকণা পড়া শুরু হতেই নেপোলিয়ন সিদ্ধান্ত নিলেন এখানে আর থাকা যাবে না, খাবার-পানি ছাড়া এখানে থাকার অর্থ মৃত্যু।
ততদিনে নেপোলিয়নের বহরে সৈন্যসংখ্যা কমে এক লক্ষে নেমে এসেছে। বাকিরা হয় মারা গ্যেছে, অথবা আহত হয়েছে, অথবা শত্রুপক্ষের হাতে ধরা পড়েছে। কেউ পালিয়ে গিয়েছে আবার কেউ অভিযানে আসার পথেই ফিরতি পথ ধরে ফিরে গিয়েছে। নেপোলিয়ন ভেবেছিলেন সরাসরি দক্ষিণের রাস্তা ধরবেন। কিন্তু রাশিয়ার শক্ত সেনাবাহিনী মালোয়ারোস্লাভেটে বাধা দেওয়ার পর, নেপোলিয়ন যে পথে এসেছিলেন সে পথ দিয়েই ফিরতে বাধ্য হলেন।
যে পথে আসা হয়েছিল, সে পথের কোথাও কোনো গাছেই কোনো খাবার বাকি ছিল না। হাজারে হাজারে ঘোড়া মারা যেতে থাকলো। এদিকে গ্রান্দে আর্মির পেছন এবং পাশ থেকে ক্ষণে ক্ষণে হামলা চালাতে থাকলো রুশরা।
তবে এটুকুই নয়, সে বছর শীত আসলো আরও আগে, আরও জোরালো হাওয়া নিয়ে। তাপমাত্রা শূণ্যের ওপরে ওথাই ভুলে গেল, সাথে প্রচণ্ড তুষারপাত তো রয়েছেই। কোনো ঝড়ো রাতে হাজার হাজার ঘোড়া আর সৈন্য ওখানেই মারা গেল। সামান্য উষ্ণতার আশায় সৈন্যরা অন্য সৈন্যের মৃতদেহ কিংবা মৃত ঘোড়ার সাথে জড়িয়ে থাকা শুরু করলো। মানুষের তুলনায় প্রকৃতির সাথে যুদ্ধ হয়ে উঠলো আরও কঠিন ও মারণাত্মক।
নভেম্বরের শেষদিকে বেরেজিনা নদী পার হওয়ার সময় আহতদেরকে ফেলে রেখেই আসতে হলো বাকিদেরকে, নাহলে বাঁচার কোনো উপায় নেই। এরপর বেঁচে থাকতে হবে কেবল নিজের প্রচেষ্টাতেই, সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসবে না। ডিসেম্বরের ৫ তারিখ প্যারিসে সেনা অভ্যুত্থান হওয়ার গুজব শুনে জোয়াকিম মুরাতের দায়িত্বে সেনাবাহিনীর দায়িত্ব দিয়ে সেনাবাহিনী ছেড়ে দ্রুত প্যারিসের উদ্দেশ্য রওনা হলেন নেপোলিয়ন। নয় দিন পর বিধ্বস্ত শেষ হয়ে যাওয়া গ্রান্দে আর্মি নিমান নদী পার হলো।
ফরাসিদের এই পরাজয়ের সংবাদে উদবেলিত হয়ে উঠলো প্রতিপক্ষরা। অস্ট্রিয়া, প্রুশিয়া আর সুইডেন গ্রেট ব্রিটেন আর রাশিয়ার সাথে যোগ দিলো নেপোলিয়নের বিরুদ্ধে। যদিও ফরাসি সম্রাট আবারো খুব দ্রুত সেনাবাহিনী জড়ো করলেন, তারপরও অশ্বারোহী বাহিনী আর অভিজ্ঞতায় পিছিয়ে ছিল নতুন এই বাহিনী। প্রথমদিকে কয়েকটি যুদ্ধ জিতলেও ১৮১৩ সালের অক্টোবরে লাইপজিগের যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে হেরে বসেন তিনি।
পরের বছর মার্চেই প্যারিসে গ্রেপ্তার হন নেপোলিয়ন, নির্বাসনে পাঠানো হয় এলবা দ্বীপে। সেখান থেকে পালিয়ে এসে পুনরায় ক্ষমতা দখল করেন তিনি, তবে শেষ রক্ষা হয়নি, ওয়াটারলুর যুদ্ধে শেষ হয় নেপোলিয়নের জয়যাত্রা।
"দ্বাদশ চার্লস চেষ্টা করেছেন, নেপোলিয়ন চেষ্টা করেছেন, চেষ্টা করেছেন হিটলারও। কিন্তু কেউ রাশিয়ায় আক্রমণ করে জিততে পারেনি।"
সূত্র: হিস্টরিডটকম, রয়টার্স