গত অর্থবছরে ১০১টি উন্নয়ন প্রকল্পে অগ্রগতি শূন্য
গেল অর্থবছরে দেশের প্রায় ১০১টি উন্নয়ন প্রকল্পের ভৌত কাজে কোনো অগ্রগতি হয়নি বলে উঠে এসেছে বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে। ভৌত কাজে অগ্রগতি না হওয়ার এ বিষয়টি প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে একটি দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা হিসেবেই ইঙ্গিত দেয়।
প্রতিবেদনে দেখা গেছে, কিছু প্রকল্প বাস্তবায়নে কোনো অগ্রগতিই হয়নি; এসব প্রকল্পে কেবল কর্মীদের বেতন ও অফিস খরচ বাবদ অর্থ ব্যয় করা হয়েছে।
৬৯টি প্রকল্পে ভৌত অগ্রগতি হয়েছে সাকুল্যে ২৫ শতাংশেরও কম, যা অত্যন্ত হতাশাজনক। একইভাবে, ৯৯টি প্রকল্পে অগ্রগতি রয়েছে ২৬ থেকে ৫০ শতাংশের মধ্যে এবং আরও ২০৮টি প্রকল্পের কাজ এগিয়েছে ৫১ থেকে ৭৫ শতাংশ; তবে এসব প্রকল্পের বাস্তবায়ন এখনও অসন্তোষজনক নয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
আজ বুধবার (১ মার্চ) প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (এনইসি) সভায় প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করা হবে।
একেবারেই অগ্রগতি হয়নি এমন প্রকল্পগুলোর মধ্যে একটি হল সিলেটে একটি কিডনি হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্প; ২০২০ সালের জুলাইয়ে শুরু হয়েছিল প্রকল্পের কাজ। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক পরামর্শক নিয়োগে বিলম্ব হওয়ায় অগ্রগতি থমকে আছে প্রকল্পটির; গত অর্থবছরে প্রকল্পের জন্য বরাদ্দকৃত ২০ লাখ টাকার কিছুই খরচ হয়নি। ফলে কোনো ভৌত অগ্রগতিও হয়নি প্রকল্পটির।
"পরামর্শক নিয়োগের জটিল প্রক্রিয়ার কারণে এই প্রকল্পের অগ্রগতি হয়নি। এ কারণে বরাদ্দকৃত অর্থও ব্যয় করা সম্ভব হয়নি," প্রকল্পের তৎকালিক প্রকল্প পরিচালক নিবাস রঞ্জন দাশ দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে এ কথা বলেন।
৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ পেয়েও গত অর্থবছরে (২০২১-২২) কোনো কাজ হয়নি পটুয়াখালী মেডিকেল কলেজ এবং হাসপাতাল নির্মাণ প্রকল্পে।
গত অর্থবছরে কোনো কাজ না হওয়া আরও একটি প্রকল্প হল, ভারতের সঙ্গে রেল সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে চিলাহাটি এবং চিলাহাটি বর্ডারের মধ্যে ব্রড গেজ রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প।
এই প্রকল্পের পরিচালক আবদুর রহিম জানান, ২০১৮ সালে বাস্তবায়নে যাওয়া প্রকল্পটি ২০২২ সালে শেষ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ঠিকাদার নিয়োগ, ভূমি অধিগ্রহণ জটিলতাসহ নানান সমস্যার কারণে প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ হয়নি।
"গত বছর সংশোধন করে প্রকল্পের মেয়াদ বাড়ানো হয়। সংশোধন প্রস্তাব অনুমোদন প্রক্রিয়ায় বিলম্ব হওয়ার কারণে গত অর্থবছরে প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ করা সম্ভব হয়নি," যোগ করেন তিনি।
রেলওয়ের ৩৫টি প্রকল্পের মধ্যে ৮টিতে কোনো অগ্রগতিই হয়নি গত অর্থবছরে। এরমধ্যে রয়েছে আখাউড়া-সিলেট প্রকল্পে একটি মিটারগেজ রেললাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরের কাজ।
প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ শুরুর পর প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের নির্দেশে প্রকল্পের ব্যয় পর্যালোচনা করা হয়। পরে ব্যয় কমানোর প্রস্তাব দেওয়া হয় চীনের ঠিকাদারকে। ব্যয় না কমিয়ে প্রকল্পের বাস্তবায়ন কাজ বন্ধ করে দেয় ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান। এ জটিলতায় ২০১৯ সালের এপ্রিলে প্রকল্পের কাজ শুরু হলেও কাজে অগ্রগতি হয়নি। এ প্রকল্পে গত অর্থবছরে নামমাত্র ১ লাখ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
বিদ্যুৎ খাতের শাহজীবাজার ১০০ মেগাওয়াট গ্যাস টারবাইন প্রকল্পসহ মোট তিনটি প্রকল্পেরও গত অর্থবছরে কোনো অগ্রগতি ছিল না।
পরিকল্পনা বিভাগের সাবেক সচিব মোঃ মামুন-আল-রশিদ এসব উন্নয়ন প্রকল্পে অগ্রগতি না হওয়ার ব্যাখ্যা দিয়েছেন।
টিবিএস-এর সঙ্গে আলাপকালে তিনি জানান, প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শুরু হওয়ার আগে ডিজাইন অনুমোদন করতে হয়। ডিজাইন অনুমোদন না হলে অর্থ ব্যয় করা যায় না। আবার দরপত্র প্রক্রিয়ার শেষ না হলে অর্থ ব্যয় হয় না। এছাড়া, ভূমি অধিগ্রণের কাজ শেষ না হলে নির্মাণ কাজ শুরু করা যায় না।
আবার বাস্তবায়নের বিভিন্ন পর্যায়ে উন্নয়ন সহযোগীদের সম্মতির প্রয়োজন হয়ে, কিন্ত তাদের সম্মতি না পাওয়া গেলে কাজ করা যায় না। এভাবে বিভিন্ন কারণে প্রতিবছরই কিছু না কিছু প্রকল্পের অগ্রগতি আটকে থাকে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সাবেক এই পরিকল্পনা সচিব আরো জানান, প্রতিবছরই এ ধরনের প্রকল্প চিহ্নিত করা হয় এবং আগামীতে যেন একই সমস্যায় পড়তে না হয়, সেজন্য প্রয়োজনী ব্যবস্থা নিতেও বলা হয়। কিন্ত বছরের পর বছর একই সমস্যা রয়ে যাচ্ছে। এতে উন্নয়ন প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয়, দুটোই বাড়ছে।
গত অর্থবছরে শেষ হওয়া ৩৩৬টি প্রকল্প চিহ্নিত করেছে আইএমইডি। এরমধ্যে, ১৫০টি প্রকল্পের ভৌত কাজ সম্পূর্ণরূপে শেষ হয়েছে এবং অবশিষ্ট প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন বাদ রেখেই সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়েছে।
এছাড়া, প্রতিবেদনে বরাদ্দকৃত তহবিল ব্যবহারের ক্ষেত্রে বাস্তবায়নকারী সংস্থার ক্ষমতার ভিত্তিতে ২০২২ অর্থবছরের সংশোধিত এডিপিতে শুরু হওয়া ১ হাজার ৮৩৬টি প্রকল্পকে শ্রেণীবদ্ধ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৬১টি প্রকল্প গত অর্থবছরের সংশোধিত বার্ষিক উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার বিপরীতে বরাদ্দকৃত অর্থের কেবল শূন্য থেকে ২৫ শতাংশের নিচে ব্যয় করেছে, যা অত্যন্ত 'হতাশাজনক'।
প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, ৯৪টি প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দকৃত ১ হাজার ৫ কোটি টাকার একটি পয়সাও খরচ করা হয়নি এবং সংশোধিত এডিপিতে অন্য ৬৭টি প্রকল্পে বরাদ্দকৃত ১ হাজার ৭১৪ কোটি টাকার মধ্যে খরচ হয়েছে ২৫ শতাংশেরও কম।
আইএমইডির প্রতিবেদনে প্রকল্প ব্যয়ে এমন ধীরগতির কারণ হিসেবে যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হয়েছে, তা হল- জমি অধিগ্রহণের জটিলতা, দরপত্রে বিলম্ব, সম্ভাব্যতা যাচাই ও পরিকল্পনার অভাব এবং বৈদেশিক অর্থায়নের নিশ্চয়তা ছাড়াই প্রকল্প গ্রহণ।
আইএমইডির প্রতিবেদন অনুযায়ী, মোট ১ হাজার ৮৩৬টি প্রকল্পের মধ্যে ৭৯টি প্রকল্প বরাদ্দকৃত অর্থের প্রায় ২৬ থেকে ৫০ শতাংশ ব্যয় করতে পেরেছে। ১৬৫টি প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৫১ থেকে ৭৫ শতাংশ এবং ৭৫১টি প্রকল্প বরাদ্দকৃত অর্থের শতভাগই ব্যয় করেছে। শতভাগ ব্যয় সম্পন্ন করা প্রকল্পগুলোকে প্রতিবেদনে 'প্রশংসনীয়' হিসেবে উল্লেখ করেছে আইএমইডি।