২০২২ সালে পাওনা আদায় মামলা করে সরকারের রেকর্ড ১৮৫০০ কোটি টাকা আদায়
সরকারি সংস্থাগুলোর দায়ের করা অর্থ আদায় মামলাগুলোর নিষ্পত্তি ত্বরান্বিত করার জন্য সরকারের নেওয়া উদ্যোগগুলো ফল দিতে শুরু করেছে। ২০২২ সালে রেকর্ড প্রায় ১৩ হাজার মামলায় সরকারের প্রায় ১৮ হাজার ৫০০ কোটি টাকা পাওনা আদায় হয়েছে।
আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর উইং সূত্রে জানা গেছে, ব্যক্তি বা সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিভিন্ন সরকারি সংস্থার পাওনা টাকা আদায়ের জন্য দায়ের করা মামলা নিষ্পত্তির হার আগের বছরগুলোতে অনেক কম ছিল।
২০২১ সালে বিভিন্ন আদালতে এরকম ৪ হাজার ৩২৬ টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে, যেখান থেকে সরকার আদায় করতে পেরেছে ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকার মতো। ২০২০ সালে ৩ হাজার ৮৮৪ টি মামলা নিষ্পত্তি হয়ে আদায় হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা।
অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ২০১৯ সাল থেকে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও তাদের অধীনস্থ সংস্থা, অধিদপ্তর ও প্রতিষ্ঠানগুলো অর্থ আদায়-সংক্রান্ত মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির উদ্যোগ নেয়।
এজন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে বিভিন্ন সময় নির্দেশনাও জারি করা হয়। এছাড়াও এরকম মামলা দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য অ্যটর্নি জেনারেলের অফিস ও আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিচারিক আদালতের সরকারি আইনজীবীদের সঙ্গে লিয়াজো করতে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।
সে অনুযায়ী মামলাগুলোর যথাযথ তথ্য সংগ্রহ করে সেগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য উদ্যোগ নিতে মন্ত্রণালয় ও প্রতিষ্ঠানগুলো দক্ষ আইনজীবী নিয়োগ দেয়।
আদালতগুলো যাতে এই মামলাগুলো অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করেন, সেজন্য আইন মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বিভিন্ন সময় কাজ করেছে বলেও জানান অ্যাটর্নি জেনারেল।
মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেন টিবিএসকে বলেন, সরকারের মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে একটি মনিটরিং টিম গঠন করা হয়েছে। সেই টিম বেশ সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। পুরোনো মামলাগুলো যাতে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে নিষ্পত্তি করে একটি কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়া যায়, এখন সেটি নিয়েই কাজ করা হচ্ছে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও মনে করেন, সরকারি মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগনসহ সরকারের সংশ্লিষ্টরা যে উদ্যোগ নিয়েছে, আদালতে সেটির প্রতিফলন হিসেবে রেকর্ড পরিমাণ মামলা নিষ্পত্তি হয়ে এসব টাকা আদায় হয়েছে।
'এই ধারা অব্যাহত থাকবে,' টিবিএসকে বলেন আইনমন্ত্রী।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার বলেন, 'আরো যে মামলাগুলো পেন্ডিং রয়েছে, সেগুলোর নিষ্পত্তি হলে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীন সংস্থা এবং সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের লাভ হবে। এই টাকাগুলো মূলত জনগণের টাকা। এ টাকা পেলে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের অধীনে পরিচালিত উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পরিধি বাড়াতে পারবে।
'এছাড়াও এখন [অর্থনৈতিক] সংকটের কারণে সরকারের নানা উন্নয়ন প্রকল্প আটকা আছে, সেগুলোর জন্যও কাজে দেবে উদ্ধার করা টাকাগুলো।'
আইন মন্ত্রণালয়ের সলিসিটর উইংয়ের তথ্য অনুসারে, বিভিন্ন ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান ও সংস্থার কাছ থেকে টাকা আদায়ে দেশের বিভিন্ন আদালতে আরও প্রায় ১ লাখ ৬ হাজার মামলার বিচার চলমান। মামলাগুলোর সঙ্গে সরকারের প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা পাওনা টাকা জড়িত। এই মামলাগুলোর মধ্যে ১০ বছর বা তার চেয়েও পুরোনো মামলা আছে প্রায় ১৭ হাজার।
বিভিন্ন ঠিকাদারের কাছ থেকে সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাওনা, চালকল মালিকদের কাছ থেকে সরকারের পাওনা, বিভিন্ন জমি ইজারা-সংক্রান্ত ব্যক্তি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পাওনা, বিভিন্ন ক্রয়-সংক্রান্ত পাওনাসহ নানা রকমের পাওনা পরিশোধ এসব মামলার সঙ্গে জড়িত।
আদালত সূত্র টিবিএসকে জানান, গত বছর নিষ্পত্তি হওয়া মামলাগুলোর মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে নিষ্পত্তি হয়েছে ২ হাজার ৩০০টি মামলা। যেগুলোর সাথে সরকারের পাওনা জড়িত ছিল প্রায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ না থাকায় সাড়ে ৫ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ করেছে বিবাদীরা।
এছাড়াও হাইকোর্ট গত বছর প্রায় ৮ হাজার আপিলের রায় দিয়েছেন। এর মধ্যে বিবাদীরা প্রায় ৫ হাজার রায়কে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। বাকি ৩ হাজার রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না করায় এসব মামলায় জড়িত প্রায় ৪ হাজার ৭০০ কোটি টাকা সরকারের কাছে জমা দিয়েছে বিবাদীরা।
অন্যদিকে গত বছর বিচারিক আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে প্রায় ২৯ হাজার মামলা। এসব মামলার রায়ের মধ্যে প্রায় ২১ হাজার ৩০০ টি রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেছে বিবাদীরা। বাকি ৭ হাজার ৭০০টি রায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপিল হয়নি। ফলে এই ৭ হাজার ৭০০টি মামলায় জড়িত ৮ হাজার ৩০০ কোটি টাকা সরকারের কাছে জমা দিয়েছে বিবাদীরা।
এসব মামলার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা জানান, নিষ্পত্তি হওয়া এসব মামলা বেশি পুরনো হওয়ায় আদালত বিবাদীদের জরিমানা মওকুফের সুযোগ দিয়েছেন। এছাড়াও দীর্ঘমেয়াদি কিস্তিতে এসব পাওনা টাকা সরকারের সংশ্লিষ্টদের কাছে জমাদানের সুযোগ দেওয়ায় অনেক বিবাদী সেই সুযোগ নিয়েছে।
কয়েকটি উদাহরণ
১৯৯৮ সালে নওগাঁর জেলায় স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) একটি সড়ক নির্মাণের কাজে অনিয়মের অভিযোগে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স ভাই ভাই কর্পোরেশনের এর কাজ বন্ধ করে দিয়ে অন্য একজন ঠিকাদারকে ওই কাজ দেয়।
চুক্তি বাতিলের সময় ভাই ভাই কর্পোরেশনের কাছে সরকারের পাওনা ছিল ১ কোটি ৮ লাখ টাকা। নিয়ম অনুযায়ী ওই টাকা ফেরত না দেওয়ায় ১৯৯৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করে এলজিইডি।
২০০২ সালে এক রায়ে এক মাসের মধ্যে ওই টাকা ফেরত দিতে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে নির্দেশনা দিয়ে রায় ঘোষণা করেন নওগাঁর বিচারিক আদালত। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানটি ওই রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করলে ২০০৮ সালে বিচারকি আদালতের রায়ই বহাল থাকে। এরপর হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করলে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে হাইকোর্টের রায় বহাল রাখেন এবং আরো ১৫ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণসহ এক মাসের মধ্যে এলজিইডির কাছে টাকা ফেরত দিতে রায় দেন।
সরকারিভাবে ১০৪ মেট্রিক টন বোরো চাল সংগ্রহের জন্য টাঙ্গাইলের সীমন রাইস মিল ২০০৭ সালে খাদ্য অধিদপ্তরের কাছ থেকে ৫৬ লাখ টাকা নিলেও মাত্র ৩০ টন চাল দেওয়ার পর আর কোনো চাল সরবরাহ করেনি। এই টাকা আদায়ে খাদ্য অধিদপ্তর ২০০৮ সালে টাঙ্গাইলের বিচারিক আদালতে সীমন রাইস মিলের মালিক আবুল হাসানের বিরুদ্ধে মামলা করে।
সেই মামলা বিচারিক আদালতের রায়ের পর হাইকোর্ট পর্যন্ত গড়ায়। গত বছরের মার্চ মাসে হাইকোর্টের রায় অনুযায়ী বাকি টাকা খাদ্য অধিদপ্তরকে ফেরত দিয়েছেন আবুল হাসান।
আবুল হাসান টিবিএসকে বলেন, 'একটি ভুল বোঝাবুঝির কারণে মামলাটি হয়। বিষয়টি হাইকোর্টে নিষ্পত্তি হওয়ার পর রায় মেনে নিয়ে প্রায় ৪০ লাখ টাকা ফেরত দিয়েছি। এ বিষয়ে আর কোনো মন্তব্য করতে চাই না।'
বিআইডব্লিউটিএ-র অধীনে চাঁদপুরের মেঘনা-ডাকাতিয়া এলাকার ১১ কিলোমিটার নদী ড্রেজিংয়ের জন্য ২০০৬ সালে ৭৬ কোটি টাকার কাজ পায় মিলন কর্পোরেশন নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কাজ না করেই ৪১ কোটি টাকার বিল উত্তোলন করে প্রতিষ্ঠানটি। কাজ না করে টাকা উত্তোলন ও প্রতারণার দায়ে ২০০৭ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে মামলা করে বিআইডব্লিউটিএ। এই মামলাটিয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী ইকরামুল হক টুটুলকে ২ বছরের কারাদণ্ড, ৪১ কোটি জমা ও আরও ১ কোটি টাকার ক্ষতিপূরণের আদেশ দিয়ে ২০০৯ সালে রায় ঘোষণা করেন চাঁদপুরের বিচারিক আদালত। হাইকোর্ট ও আপিল বিভাগও সেই রায় বহাল রাখেন। গত বছরের আগস্টে সব টাকা জমা দেন টুটুল।
সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পাওনা টাকা আদায়
বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণ পাওনা টাকা আদায়ের পাশাপাশি বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠান অন্যান্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকেও পাওনা টাকা আদায় করেছে গত বছর।
সিরাজগঞ্জে সরকারি কর্মকর্তাদের আবাসন নির্মানের জন্য ২০০২ সালে রেলওয়ে বিভাগের ৭ একর জায়গা গণপূর্ত অধিদপ্তর ইজারা নিলেও কোনো টাকা না দেওয়ায় ২০০৭ সালে গণপূর্ত অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে মামলা করে রেলপথ অধিদপ্তর। সেই মামলা আপিল বিভাগ পর্যন্ত গড়ায়। শেষ পর্যন্ত আপিল বিভাগের রায় অনুযায়ী গত বছরের জুলাইয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তর ২০ কোটি টাকা রেলওয়ে বিভাগকে বুঝিয়ে দেয়।
এরকম সড়ক ও জনপথ বিভাগের কাছ থেকে গত বছর পাওনা প্রায় ৮০ কোটি টাকা পেয়েছে রেলওয়ে।
এছাড়া বিআইডব্লিউটিএর কাছ থেকে মামলা করে প্রায় ২০০ কোটি টাকা আদায় করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
এরকম প্রায় সরকারি ৪৩টি সংস্থার মধ্যে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা পরিশোধ হয়েছে আদালতের আদেশ অনুযায়ী।