সীতাকুণ্ডে অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণ: নিহত ৬, আহত আরও ৩০
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার কদম রসুল এলাকায় 'সীমা অক্সিজেন' নামে একটি অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় আরো ৩০ জন আহত হয়েছেন বলে জানা গেছে। বিস্ফোরণের ফলে আশপাশের দুই কিলোমিটার এলাকার ঘরবাড়ি, দোকানপাট, কারখানাসহ বিভিন্ন স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ভবনের কাঁচের জানালা, দরজা, টিনের ছাদ ও ঘর ভেঙে গেছে।
শনিবার (৪ মার্চ) বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের সীতাকুণ্ড ও কুমিরা স্টেশনসহ ৯টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। বিকাল ৫টা ৪০ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস। প্ল্যান্টটিতে সিলিন্ডারে অক্সিজেন রিফিল করার সময় বিস্ফোরণ হয় বলে জানিয়েছেন শ্রমিকরা। ফায়ার সার্ভিস বলছে, অক্সিজেন সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটেছে।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে এসে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক আবুল বাসার মোহাম্মদ ফখরুজ্জামান সাংবাদিকদের জানান, আহতদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল (চমেক) এবং আশপাশের হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।
তিনি আরো বলেন, "এ ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপারসহ সংশ্লিষ্টদের নিয়ে জেলা প্রশাসন থেকে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত শেষে এই কমিটি প্রতিবেদন দেবে। এছাড়া ফায়ার সার্ভিস একটি তদন্ত করবে।"
শনিবার রাত সোয়া ৮টার দিকে অভিযান স্থগিতের ঘোষণা দিয়ে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের চট্টগ্রাম বিভাগীয় উপ-পরিচালক মো. আব্দুল হালিম বলেন, "প্রাথমিকভাবে আমরা ধারণা করছি, অক্সিজেন সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়ে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিসের ৯টি ইউনিট কাজ করেছে। আজ অভিযান স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। রবিবার (আজ) সকাল থেকে আবার অভিযান শুরু হবে।"
নিহতদের মধ্যে মো. শামসুল আলম (৬৫) ও মো. ফরিদ (৩৩) দু'জনের নাম পাওয়া গেছে। আহতদের মধ্যে মো. নূর হোসেন (৩০), মো. আরাফাত (২২), মোতালেব (৫২), ফেনসি (৩০), মো. জসিম উদ্দিন (৪৫), নারায়ণ (৬০), মো. ফোরকান (৩৫), শাহরিয়ার (২৬), মো. জাহিদ হাসানকে চমেক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে নারী শ্রমিকও রয়েছেন।
চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ সুপার এসএম শফিউল্লাহ বলেন, উদ্ধার অভিযানে যেন কোন বাধা না আসে সেজন্য পুলিশ নিরাপত্তা দিয়েছে। ঘটনাস্থলে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।
কারখানাটির শ্রমিক মোসলেম উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "কারখানায় অক্সিজেন সিলিন্ডার রিফিল করার সময় ৪টা ১৫ মিনিটে বিকট শব্দে বিস্ফোরণ হয়। ৬-৭ মাত্রার ভূমিকম্পে আশপাশের ঘরবাড়িসহ পুরো এলাকা কেঁপে ওঠে। অন্ধকার হয়ে যায়। আশপাশের যেসব ভবনে থাই গ্লাস বা আধা পাকা ঘর ছিল- সেগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।"
১৯৮০ দশকে গড়ে ওঠা শিপ ব্রেকিং খাতকে ২০১১ সালে শিল্প ঘোষণা করা হয়। ওই সময় সীতাকুণ্ডের সাতটি মৌজায় জমি নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় শিল্পজোন হিসেবে। সেসময় এখানে প্রায় ১৬০টি শিপইয়ার্ড ছিল। মূলত স্ক্র্যাপ জাহাজ কাটার কাজে প্রচুর অক্সিজেন ব্যবহার করতে হয়। এজন্য ২০০০ সালে পর থেকে এখান শিল্পে ব্যবহৃত অক্সিজেন প্ল্যান্ট গড়ে উঠতে থাকে। ২০১৫ সালের হিসেবে এখানে ১৫টি অক্সিজেন প্ল্যান্ট ছিল। গত কয়েক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে অস্থিরতা, ডলারের বিনিময় হার বৃদ্ধিসহ নানা সংকটের ফলে প্রধান শিল্প শিপ ব্রেকিং থুবড়ে পড়ে। বর্তমানে মাত্র ২০ থেকে ২২টি শিল্প প্রতিষ্ঠান চালু আছে। জাহাজ কাটার কাজে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহের জন্য বর্তমানে মাত্র ৮টি অক্সিজেন প্ল্যান্ট রয়েছে। এরমধ্যে সীমা অক্সিজেনের প্ল্যান্ট অন্যতম।
সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের কর্ণধার স্থানীয় উদ্যোক্তা মোহাম্মদ শফিউদ্দিন মারা যাওয়ার পর তার তিন ছেলে মোহাম্মদ মামুন উদ্দিন, মোহাম্মদ পারভেজ উদ্দিন ও মোহাম্মদ আশরাফ উদ্দিন ব্যবসা দেখভাল করছেন। কারখানাটিতে প্রতিদিন ২৫০০ সিলিন্ডার অক্সিজেন উৎপাদন হয়। আর উৎপাদন কাজে নিয়োজিত থাকেন ২৫০-৩০০ জন শ্রমিক। তবে শিল্পটির দুরবস্থার কারণে উৎপাদন এবং শ্রমিক কমে এসেছে।
এর আগে গত বছরের ৪ জুন রাতে সীতাকুণ্ডের বিএম কন্টেইনার ডিপোতে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে ৫০ জনের প্রাণহানি হয়। আহত হন দুই শতাধিক মানুষ। চট্টগ্রাম সীতাকুণ্ড এলাকায় ভারী শিল্প গড়ে উঠেছে। এখানে জাহাজ ভাঙা শিল্প, অক্সিজেন প্ল্যান্ট, ইস্পাত শিল্প গড়ে উঠেছে।
আধ কিলোমিটার দূরে গিয়ে পড়েছে বিস্ফোরণের ধংসাবশেষ
বিস্ফোরণের শিকার সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের আধা কিলোমিটার দূরে কদম রসুলে একটি লাকড়ির দোকানে বসেছিলেন ষাটোর্ধ্ব শামসুল আলম। বিকেলে আত্মীয়ের দোকানে বসে গল্প করছিলেন। বিকাল সোয়া ৪টার দিকে অক্সিজেন প্ল্যান্টে বিকট শব্দে বিস্ফোরণের সময় প্রায় ৭০ কেজি ওজনের একটি লোহার টুকরা দোকানের ছাদ ছিদ্র করে তার ঘাড়ে এসে পড়ে। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মৃত্যু হয় তার। শামসুল আলমের ছেলে রায়হান উদ্দিন টিবিএসকে বলেন, "বিস্ফোরণের সময় লোহার টুকরা এসে আমার বাবার ঘাড়ে পড়ে। তিনি ঘটনাস্থলেই মারা যান।"
বিস্ফোরণস্থলের কয়েকশ ফুট পূর্বে কেশবপুর গ্রামের বাসিন্দা নিজাম উদ্দিন বলেন, বিস্ফোরণের সময় আমার স্ত্রী আমার এক বছরের কম বয়সী সন্তানকে পাশে বসিয়ে ভাত খাওয়াচ্ছিলেন। বিস্ফোরণে কেঁপে উঠলে আমার স্ত্রী অজ্ঞান হয়ে যান। বিস্ফোরণের ইস্পাতের টুকরা পড়ে আমার আধপাকা ঘর তছনছ করে ফেলেছে। আমি মাত্র ১০ মাস আগে প্রায় ১০ লাখ টাকা খরচ করে এই ঘর বানিয়েছি।
এই এলাকার তাজ ভিলার মালিক জয়নাল আবেদীন বলেন, বাড়ির কেয়ারটেকার তোফাজ্জলের গায়ে কারখানার ইস্পাতের টুকরা এসে পড়লে তিনি আহত হন।
প্ল্যান্টের দক্ষিণ পাশের চায়ের দোকানী কবির আহমেদ বলেন, ঘটনার সময় আমার ছেলে দোকানে ছিলেন। তখন ৫ জন দোকানে বসে নাস্তা করছিলেন। বিস্ফোরণে সবাই আহত হয়েছেন।
[প্রতিবেদনটি তৈরিতে আরও সহায়তা করেছেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের কন্ট্রিবিউটর মিজানুর রহমান ইউসুফ]