উন্নয়ন প্রকল্প সামনে রেখেই আওয়ামী লীগের নির্বাচনী কৌশল
বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্প সামনে রেখেই আগামী দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনী প্রচারণার 'উপযুক্ত কৌশল' হিসেবে নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ।
দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা জানিয়েছেন, একটানা ১৪ বছরের শাসনামলে পদ্মা সেতু, বঙ্গবন্ধু এক্সপ্রেসওয়ে, রাজধানীর মেট্রোরেল, কর্ণফুলী ট্যানেলসহ দেশে যে পরিমাণ উন্নয়ন প্রকল্প হয়েছে, সেই সফলতার প্রচারণা এবং নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে জনগণকে আবারো আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দিতে আকৃষ্ট করার কৌশল অবলম্বন করছে দলটি।
এরই ধারাবাহিকতায় গত চার মাস (গত বছরের নভেম্বর থেকে এই বছরের ফেব্রুয়ারি) পর্যন্ত ৫৮৮টি নতুন উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গত ১৪ বছরের মধ্যে এতো কম সময়ে এতো বেশি প্রকল্প উদ্বোধন নজিরবিহীন বলে মনে করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
এসব প্রকল্প উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী আবারো নৌকায় ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আনার আহ্বান জানিয়েছেন।
একইসাথে আওয়ামী লীগের কেন্দ্র থেকে স্থানীয় নেতাদের কে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, সরকারের উন্নয়ন কর্মকান্ড তুলে ধরে আগামী নির্বাচনের জন্য জনগনের কাছে ভোট চাইতে।
জনগণকে এসব উন্নয়ন প্রকল্পের মাধ্যমে আকৃষ্ট করার কারণ হিসেবে রাজনীতিবিদরা বলেছেন, আগামী নির্বাচন হবে বেশ কঠিন। কারণ ২০১৪ ও ২০১৮ এর নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে প্রশ্ন উঠেছে। এবারের নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে।
গত ৭ ফেব্রুয়ারি রাতে আওয়ামী লীগের সংসদীয় কমিটির সভায় প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেছেন, "আগামী জাতীয় নির্বাচন বেশ কঠিন হবে। ফাঁকা মাঠে গোল দেওয়ার সুযোগ নেই। এই নির্বাচনে নানা ধরনের ষড়যন্ত্র হবে, নানা অপপ্রচার চালানোর চেষ্টা করা হবে। এসব বিষয়ে আমাদের সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হবে।"
পাশাপাশি আওয়ামী লীগ সরকারের যেসব উন্নয়ন আছে সেসব ব্যাপকভাবে প্রচারণা চালানোর জন্য দলীয় এমপিদের নির্দেশনা দেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতবছরের নভেম্বর থেকে ও এ বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দেশের ৯ স্থানে সরাসরি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজের উদ্বোধন করেছেন। যেসব অনুষ্ঠানে লাখো জনতার উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। এছাড়াও প্রধানমন্ত্রী ভার্চুয়ালি যোগদানের মাধ্যমে ৫টি অনুষ্ঠানে আরো কিছু প্রকল্প উদ্বোধন করেছেন।
আগামী ডিসেম্বরের আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে এরকম আরো অন্তত ২০টি অনুষ্ঠান রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর। যেগুলোর প্রতিটি সমাবেশে অন্তত দশ লাখ লোকের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে চায় দলটির কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতারা। যেসব জনসভার মাধ্যমে আরো অন্তত ৫০০টি প্রকল্পের উদ্বোধন করা হবে বলে জানিয়েছে দলটির একাধিক নেতা।
গত চার মাসে যত প্রকল্প
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে 'আবদুল হামিদ সেনা নিবাস' উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী। যেখানে দশ লাখের বেশী লোক উপস্থিত ছিল বলে জানায় আওয়ামী লীগ। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী হাওর অঞ্চলে অল-ওয়েদার সড়ক, বড় বড় সেতু ও সড়ক নির্মাণসহ বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কথা তুলে ধরেন। আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসলে হাওর অঞ্চলে উড়ালসড়ক নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। জনসভায় আওয়ামী লীগকে আবারো ভোট দেওয়ার জন্য উপস্থিত জনগণের কাছে প্রতিশ্রুতি নেন শেখ হাসিনা।
এর আগে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় একসাথে ৪৯টি উন্নয়ন প্রকল্পকাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে লাখো মানুষের উপস্থিতি ছিল নজরকাড়া।
তার আগে গত ২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর প্রথম পাতাল রেলের ডিপো ও ঢাকা-সিলেট ফোরলেনের কাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে লাখো জনগণের বিশাল জনসমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন শেখ হাসিনা।
গত ২৯ জানুয়ারি এক জনসভায় রাজশাহীতে একসাথে ২৬টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন অনুষ্ঠানেও ছিল ব্যাপক জনসমাগম। সেখানে প্রধানমন্ত্রী, অতীতের মতো আগামী নির্বাচনেও নৌকায় ভোট দিয়ে উন্নয়ন অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখার আহ্বান জানান এবং উপস্থিত জনগণের কাছে নৌকায় ভোট দেওয়ার প্রুতিশ্রুতি নেন।
গত ডিসেম্বরের শুরুর দিকে চট্টগ্রামে এক বিশাল জনসভা থেকে একসাথে ৩৩ টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। চট্টগ্রামের একদিন পর কক্সবাজারে এক জনসভায় একসাথে ৭২টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। এসব জনসভায় নৌকার পক্ষে ভোট চান।
গত ৩ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ময়মনসিংহে এক জনসভায় বিভাগটির মোট ১৯৬টি প্রকল্পের মধ্যে ১০৩টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ৯৩টি প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
১২ নভেম্বর ২৪ কিলোমিটার দীর্ঘ ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করেন।
এরপর ১২ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সড়ক ও জনপথ (সওজ) অধিদপ্তরের বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় নবনির্মিত চারটি প্রকল্প উদ্বোধন করেছেন।
৭ নভেম্বর একযোগে ২৫ জেলায় ১০০টি সড়ক সেতুর উদ্বোধন করেছেন প্রধানমন্ত্রী । গত ২১ ডিসেম্বর সারা দেশের ৫০টি জেলায় ১০০টি সড়ক ও মহাসড়ক উদ্বোধন করেছেন।
সর্বশেষ গত ২৮ ডিসেম্বর রাজধানীর মেট্রোরেলের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।
এবছর আরো যতো উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন
এ বছরের জুন নাগাদ প্রধানমন্ত্রীর বঙ্গবন্ধু সেতু-বগুড়া রেলওয়ে উদ্বোধনের কথা রয়েছে।
সিরাজগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি কে এম হোসেন আলী হাসান টিবিএসকে বলেন, বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে বগুড়া পর্যন্ত রেল প্রকল্পের উদ্বোধনের জন্য এখনো দিন-তারিখ নির্ধারণ হয়নি। এ উপলক্ষে জনসমাবেশে দশ লাখ লোকের অধিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্য আমরা এখন থেকে কাজ করছি। এ জন্য কেন্দ্রীয় নির্দেশনা অনুযায়ী সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল ও বগুড়ার আওয়ামী লীগের নেতারা সমন্বয়ে কাজ করছে।
তিনি বলেন, দলের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা জেলার বিভিন্ন দলীয় কার্যক্রম আর জনসভায় গত ১৪ বছরের শাসানামলের উন্নয়ন কর্মকান্ড তুলে ধরছি।
ফেনী-নোয়াখালী জাতীয় মহাসড়কের বেগমগঞ্জ থেকে সোনাপুর পর্যন্ত ৪ লেনের কাজ উদ্বোধন হতে পারে এ বছরের মাঝামাঝি। নোয়াখালী বিশাল জনসভায় এই প্রকল্প চালু হবে।
নোয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এ এইচ এম খায়রুল আনাম চৌধুরী বলেন, আওয়ামী লীগ কোনো ধ্বংসাত্মক রাজনীতি করে না। গত ১৪ বছর যে উন্নয়ন হয়েছে, তার ধারাবাহিকতা রাখতে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে আবারো ক্ষমতায় আনতে হবে। জনগণের কাছে আমরা সেই বার্তা দিচ্ছি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী।
দলটির একটি সূত্র জানিয়েছে, এ বছরের ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়ার আগে প্রধানমন্ত্রী দেশের বিভিন্ন স্থানের আরো প্রায় ৩০০টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও চালু করবেন। এ উপলক্ষে প্রায় ২০টি জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হবে।
সেসব সমাবেশে এসব উন্নয়ন প্রকল্প কেন্দ্রের প্রচারণার মাধ্যমে নির্বাচনী প্রচারণার কাজ হবে বলে জানিয়েছেন একাধিক নেতা। এছাড়াও এসব সমাবেশে আওয়ামী লীগ মনোনীত বিভিন্ন আসনের এমপি প্রার্থীদের পরিচিত করা হবে।
যা বললো আওয়ামী লীগ
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সংসদের উপনেতা মতিয়া চৌধুরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'গত ১৪ বছরে দেশে যে পরিমাণ উন্নয়ন হয়েছে, স্বাধীনতার পর এটি হলো উন্নয়নের সবচেয়ে বড় মাইলফলক।এটি শুধু বাংলাদেশের মানুষই বিশ্বাস করে না, বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থাও এটি বলছে। বাংলাদেশের অবকাঠামো ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন একবারেই বিস্ময়কর, যেটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সম্ভব হয়েছে।'
এই প্রবীণ নেতা বলেন, 'আওয়ামী লীগের সফলতার উপর নির্ভর করেই আগামী জাতীয় নির্বাচনে দেশের জনগণ নিরঙ্কুশভাবে এই দলকে আবার বিজয়ী করবে।'
তিনি বলেন, 'একটি বড় দল নানা কর্মসূচীর মাধ্যমে দেশের জনগণকে ভুল বোঝানোর চেষ্টা করছে। দেশে কোন উন্নয়ন হয়নি, এটিই তাদের মূল প্রচারের বিষয়। এর বিপরীতে আওয়ামী লীগ দেশে কতটা উন্নয়ন করেছে, সেই প্রচারের দরকার আছে বলে, আমরা সেটি করছি। জননেত্রী শেখ হাসিনা কোনো ভুয়া তথ্য বা আশ্বাস দিয়ে দেশ পরিচালনা করেন না।'
দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবুল আলম হানিফ বলেন, 'শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ আজ উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে। আওয়ামী লগের মিশন আগামী ২০৪১ সাল নাগাদ দেশকে উন্নত দেশে পরিণত করা। দেশের মাথাপিছু আয় বেড়েছে, যা তাক লাগানোর মতো বিষয়। এছাড়াও দেশের মানুষের জীবনমান উন্নত হয়েছে।'
তিনি বলেন, 'বিএনপি-জামায়াত আজ দেশে অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাদের শাসনামলে দেশের যে অপকর্ম করেছে, এতে করে দেশ শত বছর পিছিয়ে গিয়েছে। সেই দুর্দশা ধেকে দেশকে উদ্ধার করে শেখ হাসিনা গত ১৪ বছরে দেশকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে নিয়ে এসেছেন।'
তিনি আরো বলেন, 'বিএনপি-জামায়াত তাদের অপকর্ম চাপা দিতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে, আমরা সেগুলোর বিষয়ে সজাগ। তারাই ধারাবাকিতায় আওয়ামী লীগের সভাপতি জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আমরা কাজ করছি।'
দলের কার্যক্রম শক্তিশালী করতেই মূল ফোকাস
গত ২৪ ডিসেম্বর দলটির জাতীয় কাউন্সিলে বড় কোনো পরিবর্তন না করেই কেন্দ্রীয় কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। দলটির সূত্র বলছে, পুরাতন নেতারা বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পর্কে ভালো জানেন, তাদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে তেমন পরিবর্তন করেন নি আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
এছাড়াও দলটির কার্যক্রম শক্তিশালী করতে বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীর বিদ্রোহী প্রার্থী, যাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে, তাদেরকে আবারো দলে ফেরানো হচ্ছে।
একইসাথে দলটি ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে ৩৫টির কাউন্সিল সম্পন্ন করেছে।
দলটির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের মধ্যে নানা ধরনের বিরোধ মিটিয়ে আগামী নির্বাচনে দলের শক্তিশালী অবস্থান গড়তে দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা কাজ করছেন।
দলের বিভিন্ন বিতর্কিত এমপিদের আধিপত্যের লাগাম টেনে ধরে আগামী নির্বাচনে উপযুক্ত প্রার্থী বাছাইয়ে কাজ করছে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিট। এজন্য বিতর্কিত প্রায় ৫০ এমপির একটি তালিকাও করা হয়েছে।