অতিরিক্ত অক্সিজেনের চাপেই সিলিন্ডার বিস্ফোরণ, দাবি শ্রমিকদের
চট্টগ্রামের সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টে 'কম্প্রেসার মেশিন থেকে অক্সিজেনের অতিরিক্ত চাপের কারণে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ হয়েছে বলে ধারণা করেছেন কারখানাটির শ্রমিকরা। তবে কারখানা কর্তৃপক্ষ ও ফায়ার সার্ভিস শ্রমিকদের এ অভিযোগের বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হয়নি।
বিস্ফোরণে আহত হয়েছেন অক্সিজেন প্ল্যান্টের অক্সিজেন 'কম্প্রেসার অপারেটর মো. ওসমান। বর্তমানে তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন।
রোববার তিনি দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'গত ১৫ বছর ধরে এই কারখানায় কাজ করছি। কোনোদিন এমন ঘটনা ঘটেনি। প্ল্যান্টে তৈরী অক্সিজেন ৮০ কেজির সিলিন্ডারে ভরা হয়। দুর্ঘটনার আগে প্ল্যান্টের কম্প্রেশার মেশিন থেকে অতিরিক্ত অক্সিজেন সিলিন্ডারে রিফিল হতে থাকে। সেই চাপের কারণে এই বিস্ফোরণ হয়েছে।'
ওসমানের বাড়ি চট্টগ্রাম নগরের কর্নেলহাট এলাকায়। বিস্ফোরণে তার দুই পায়ের গোড়ালিতে লোহার টুকরা ঢুকে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন।
৬ নম্বর ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন কারখানার ফিলিংম্যান আব্দুল মোতালেবও মনে করেন মূলত সিলিন্ডারে অতিরিক্ত অক্সিজেনের চাপের কারণে এই বিস্ফোরণ হয়েছে। তিনি বলেন, 'কম্প্রেসার মেশিনে সমস্যা থেকে ৮০ কেজির বেশি অক্সিজেন সিলিন্ডারে চলে গিয়েছিলো।'
তবে এ নিয়ে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের ম্যানেজার আবদুল হালিম। ঘটনাস্থলে এসে তিনি বলেন, 'অক্সিজেন তৈরীর সব ধরনের লাইসেন্স ও দক্ষ জনবল রয়েছে। যেহেতু অনেক বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে। তাই এখনই মন্তব্য করা যাচ্ছে না।'
তিনি বলেন, 'আমাদের অক্সিজেন কারখানায় সিলিন্ডারের মেয়াদ আছে কি না তা নিয়মিত যাচাই করা হয়। কারখানায় সিলিন্ডার পরীক্ষা করার সকল যন্ত্রপাতি রয়েছে। কী কারণে দুর্ঘটনা ঘটেছে, তা এখনো বুঝতে পারছি না।'
একই মত দিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স ও বিস্ফোরক পরিদপ্তর। ফায়ার সার্ভিস চট্টগ্রামের উপ-সহকারী পরিচালক (ডিএডি) আবদুল হামিদ মিয়া দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, 'বিস্ফোরণের বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। প্রাথমিকভাবে সিলিন্ডার থেকে এই বিস্ফোরণ ঘটেছে বলে ধারণা করছি। তবে সিলিন্ডার কেন বিস্ফোরিত হয়েছে সেটা বলা যাচ্ছে না। জেলা প্রশাসন ও ফায়ার সার্ভিস গঠিত কমিটি বিষয়গুলো খতিয়ে দেখবে।'
চট্টগ্রামের সহকারী বিস্ফোরক পরিদর্শক এস.এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, 'এখনই নির্দিষ্ট করে বলা যাচ্ছে না। আমরা কাজ শুরু করেছি। তদন্ত শেষে বলতে পারব।'
সীমা অক্সিজেন লিমিটেড সীমা গ্রুপের একটি প্রতিষ্ঠান। সেটিতে জাহাজভাঙা কারখানায় লোহা কাটার কাজে ব্যবহৃত অক্সিজেন উৎপাদিত হতো। অক্সিজেন কারখানার মূল কাঁচামাল বাতাস। বাতাস থেকে অক্সিজেন আলাদা করাই কারখানার মূল কাজ। এরপর সিলিন্ডারে ভরে তা সরবরাহ করা হয় বিভিন্ন কারখানায়।
১৯৯১ সালে জাহাজভাঙা কারখানা দিয়ে সীমা গ্রুপের ব্যবসা শুরু হয়। জাহাজভাঙার লোহা কাটার জন্য দরকার অক্সিজেন। চাহিদার কারণেই ১৯৯৭ সালে অক্সিজেন কারখানা স্থাপন করেন চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ শফি। সীমা অক্সিজেন কারখানার উৎপাদিত অক্সিজেন একসময় কোম্পানির জাহাজভাঙা ইয়ার্ডে জাহাজ কাটার কাজে ব্যবহৃত হতো। তবে ২০১৯ সালের পর কোম্পানির জাহাজভাঙা কারখানা বন্ধ রয়েছে। এ কারণে এখন উৎপাদিত অক্সিজেনের প্রায় পুরোটাই অন্য কারখানার কাছে বিক্রি করা হয়।
সীমা অক্সিজেন প্ল্যান্টের ম্যানেজার আবদুল হালিম জানান, ১৯৯৭ সালে স্থাপিত কারখানাটিতে ২০১৮ সালে নতুন মেশিন স্থাপন করা হয়। বর্তমানে জাপানি প্রযুক্তিতে কারখানাটি পরিচালিত হচ্ছে। সর্বশেষ গত সপ্তাহে একটি জাপানি দল কারখানা পরিদর্শন করেন।
শনিবার বিকেলে সীতাকুণ্ড উপজেলার কদম রসুল এলাকায় অবস্থিত এ এটি অক্সিজেন প্ল্যান্টটিতে বিস্ফোরণ-অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় অন্তত সাতজন নিহত হয়েছেন। বিস্ফোরণের ধাক্কায় কয়েক মাইল দূরের ভবনগুলোও কেঁপে ওঠে। ভেঙ্গে যায় আবাসিক ভবনের দরজা-জানালাও।
সেদিন বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে। খবর পেয়ে ফায়ার সার্ভিসের সীতাকুণ্ড ও কুমিরা স্টেশনসহ ৯টি ইউনিট আগুন নিয়ন্ত্রণে কাজ করে। বিকাল ৫টা ৪০ মিনিটের দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয় ফায়ার সার্ভিস।
নিহতরা হলেন- ভাটিয়ারীর জাহানাবাদ কদমরসুল এলাকার ইসমাইল হোসেনের ছেলে শামছুল আলম (৫৬), বিএমএ গেট বানু বাজার এলাকার আবুল বাসার মিয়ার ছেলে ফরিদ (৩৬), নেত্রকোনার কলমাকান্দা থানার ছোট মনগড়া এলাকার মিকি রোঙ্গী লখরেটের ছেলে রতন লখরেট (৪৫), নোয়াখালীর মাইজদী থানার অলিপুর এলাকার মৃত মকবুল আহমেদের ছেলে মো. আবদুল কাদের (৫৮), লক্ষীপুরের কমল নগর থানার মহিদুল হকের ছেলে মো. সালাউদ্দিন (৩৩) ও অজ্ঞাত একজন। রবিবার রাতে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (সিএমসিএইচ) আরও একজনের মৃত্যু হয়েছে বলে বার্তা সংস্থা ইউএনবির খবরে বলা হয়েছে।
এ ঘটনায় ৭ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে জেলা প্রশাসন। এতে আহ্বায়ক করা হয়েছে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট রাকিব হাসানকে। কমিটিতে সদস্য করা হয়েছে- পুলিশ সুপারের প্রতিনিধি, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি), সীতাকুণ্ড উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও), উপজেলা ভূমি অফিসের সহকারী কমিশনার (এসিল্যান্ড), ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের প্রতিনিধি, বিস্ফোরক পরিদপ্তরের প্রতিনিধিকে। এছাড়া ফায়ার সার্ভিস চার সদস্যের আলাদা একটি তদন্তদল গঠন করেছে।