‘ঘর সামলাই, ব্যবসাও সামলাই’ বিজ্ঞাপন নিয়ে কেন এত বিতর্ক!
'ঘর সামলাই, ব্যবসাও সামলাই'। নারী দিবসকে সামনে রেখে টেলিকম অপারেটর গ্রামীণফোনের ফেসবুক পেজে পোস্ট করা এক নারী উদ্যোক্তার ছবির সঙ্গে থাকা এই লেখা নিয়ে ঝড় উঠেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
গতকাল ৫ মার্চ রাতে গ্রামীণফোনের অফিসিয়াল পেজে পোস্ট করা এই ছবির ক্যাপশনে লেখা হয়েছে: 'গৎবাঁধা চাকরির গণ্ডিতে থাকতে চাননি তিনি। স্বাধীনভাবে কাজ করতে, উদ্যোক্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখেন ফোয়ারা ফেরদৌস। ফেসবুকে Poter BiBi : পটের বিবি নামে পেইজ খুলে শুরু করেন ব্যবসা। একদিকে সংসার সামলে,অন্যদিকে সামলেছেন ব্যবসা। শুধু তিনিই না, তার এ উদ্যোগে ঘুরে দাঁড়িয়েছেন অনেকেই। বন্ধ হতে যাওয়া ৩০ বছরের পুরোনো ব্লকের কারখানা চালু হয়েছে আবারও! কে বলে মেয়েরা ব্যবসা বোঝে না!'
সোমবার সকাল থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই পোস্টের পক্ষে-বিপক্ষে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। 'ঘর সামলাই, ব্যবসাও সামলাই' লেখার মাধ্যমে নারীদের ওপর বাধ্যতামূলক ঘরের কাজের অতিরিক্ত বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার মানসিকতাকেই প্রচার ও বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে বলে ভাবছেন নারী অধিকার বিষয়ে সচেতন মহল।
নারী অধিকারকর্মী ও লেখক সুপ্রীতি ধর তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন, 'কোনোকিছু সামলানোর মধ্য দিয়েই কেন নারীকে গ্লোরিফাই করতে হবে? যে "একটা" সামলায় বা কোনোকিছুই যাকে সামলাতে হয় না বা পারে না, তাকে কেন অবজ্ঞার চোখে দেখা হচ্ছে? কেন পারতেই হবে নারীকে? নারীর ক্ষমতায়ন মানেই কি নারীর সব বিষয়ে "দক্ষ" হয়ে উঠা? তা-ই যদি হয় তবে পুরুষের দক্ষতা নিয়ে কথা কেন বলা হচ্ছে না? কেন পুরুষকে সব কাজে, ঘরে বাইরে পারদর্শী হয়ে ওঠার কথা বলা হচ্ছে না? বা পুরুষদের উৎসাহিত করা হচ্ছে না ঘরের কাজে? নারী দিবস এলেই এই যে "কোন একটা কিছু" বানিয়ে ফেলতে হবে সাত-পাঁচ না ভেবে, এ থেকে উত্তরণ ঘটাতে হবে মানসিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে। নারীর ওপর থেকে এই দ্বিগুণ, ত্রিগুণ, চতুর্গুণ বোঝা লাঘব করা হোক।'
একই সুর দেখা যায় অভিনেত্রী ও উন্নয়নকর্মী রাফিয়াত রশিদ মিথিলার ফেসবুক স্ট্যাটাসেও। তিনি লিখেছেন, 'আজ পর্যন্ত আমি কোনো পুরুষের ছবিতে এমন ক্যাপশন দেখিনি, "ব্যবসা/চাকরি সামলাই, ঘরও সামলাই"। কারণ অবশ্যই "ঘর-সংসার" হলো নারীর দায়িত্ব। (বিরক্তির ইমোজি) এটা ২০২৩, আর এই সময়ে এসেও আমরা বৈষম্য ও নারীর উপর তিন গুণ বোঝা চাপিয়ে দেওয়াকে মহিমান্বিত করছি।'
গ্রামীণফোনের এই বিজ্ঞাপন বিষয়ে মতামত জানতে যোগাযোগ করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েনের সঙ্গে। তার ভাষ্যে, 'আগে তো সিনেমা, নাটকে যেসব মেয়েরা চাকরি করে, তাদেরকে ভিলেন চরিত্রে দেখানো হতো। আর যারা ঘরে থাকত, তাদেরকে দেখানো হতো ভালো মেয়ে হিসেবে। তারপর একটা সময়ে এসেছে যে নারীদেরকে শুধু ঘরের ভালো মেয়ে হিসেবে দেখানো সম্ভব হচ্ছে না। তখন পিতৃতন্ত্র আর পুঁজিবাদের চুক্তি হিসেবে নারীদের দেখানো হয় ঘরে-বাইরে সমানভাবে পারদর্শী। পুরুষতন্ত্রকে এভাবে আশ্বস্ত করা হয় যে নারী বাইরে কাজ করলেও তার ঘর ঠিক থাকবে। ফলে সবসময় পুরুষতন্ত্রকে তুষ্ট করতে নারীকে দেখাতে হয় ঘর ও বাইরে সমান কাজ করা। তারই ধারাবাহিকতা হিসেবে এ-জাতীয় বিজ্ঞাপনগুলো আসে।'
আক্ষেপের সুরে তিনি আরও যোগ করেন, 'আস্তে আস্তে তো দিন পাল্টাচ্ছে। আর কতকাল এমন দেখানো হবে! কোনো পুরুষকে দিয়ে তো কোনো বিজ্ঞাপনে দেখানো হচ্ছে না, "আমি ঘর-বাহির দুটোই সামলাই!" এখনও ধরেই নেওয়া হয়, পুরুষের কর্মক্ষেত্র ঘরের বাইরে। আর নারীর দায়িত্ব প্রথমে ঘরে, এরপর বাইরের কাজ। সমাজের বিদ্যমান স্ট্যাটাস ক্যুয়ো-কে বলবৎ রাখার জন্যই এ-জাতীয় বার্তাগুলো প্রচার করা হয়। ঘরের কাজ তো নারী-পুরুষের সমানে সমানে করার কথা। তাই এ ধরনের বিজ্ঞাপনের বিরুদ্ধে আমাদের সরব হওয়া দরকার।'
যার ছবির সঙ্গে প্রচারিত বার্তা নিয়ে এত আলোচনা, পটের বিবি-র কর্ণধার ফোয়ারা ফেরদৌসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, 'আসলে এটা গ্রামীণফোনের তিন পর্বের একটা ক্যাম্পেইন। প্রথম পর্বটুকু শুধু একটা টিজার হিসেবে ছাড়া হয়েছে। একটা চলমান ক্যাম্পেইন নিয়ে আমি এখনই কিছু বলতে পারছি না। ক্যাম্পেইনের প্রথম পর্ব নিয়ে মানুষ নানা ধরনের মতবিনিময় করছে, হয়তো দ্বিতীয় পর্ব প্রচারিত হলে এই মতগুলো বদলেও যেতে পারে। এ কারণে পুরো ক্যাম্পেইনটা প্রচারিত হওয়ার পরই আমি মন্তব্য করতে চাই।'