ব্রেইন-ডেড রোগীর কিডনি নিয়ে বেঁচে থাকা শামীমা আহমেদ, হাসিনা আক্তার এখন কেমন আছেন?
মিরপুরের ভাড়া বাসায় রুমের মধ্যে এখন হাঁটতে পারেন শামীমা আহমেদ (৩৪)। এখন আর সপ্তাহে দুই দিন ডায়ালাইসিস করতে হয় না তার। নিয়মিত ওষুধ ও টেস্টে ধীরে ধীরে সেরে উঠছেন তিনি।
চলতি বছরের ১৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বিএসএমএমইউ) কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয় শামীমা আহমেদের।
কিডনি প্রতিস্থাপনের দেড় মাস পর গত ২৮ ফেব্রুয়ারি তাকে হাসপাতাল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। তার শারীরিক অবস্থা ভালো আছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
বিএসএমএমইউতে বিনামূল্যে সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা সুবিধা পাচ্ছেন শামীমা আহমেদ; শুধু ওষুধের খরচ বহন করছে তার পরিবার।
দেশের প্রথম ব্রেইন-ডেড অঙ্গদানকারী সারাহ ইসলামের একটি কিডনি প্রতিস্থাপন করা হয় শামীমা আহমেদের শরীরে। দেশের ইতিহাসের এমন অস্ত্রোপচারের ঘটনা এটিই প্রথম।
২০ বছর বয়সী সারাহ ইসলাম মৃত্যুর আগে তার কিডনি দান করে গিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকে সারাহ টিউবারেস স্ক্লেরোসিস রোগে আক্রান্ত ছিলেন। গত ১৮ জানুয়ারি তাকে ক্লিনিক্যালি ডেড বা মৃত ঘোষণা করেন ডাক্তাররা।
শামীমা আহমেদের মত সারাহ ইসলামের আরেকটি কিডনি একই দিনে কিডনি ফাউন্ডেশনে প্রতিস্থাপন করা হয় হাসিনা আক্তারের শরীরে। হাসিনা আক্তারের ইনফেকশন হওয়ায় ও হার্টের সমস্যা থাকায় তিনি এখনো কিডনি ফাউন্ডেশনের পোস্ট-ট্রান্সপ্ল্যান্ট ইউনিটে আছেন। তার সুস্থ হতে কিছুটা সময় লাগবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকেরা। হাসিনা আক্তারের চিকিৎসার সব খরচ বহন করছে কিডনি ফাউন্ডেশন।
কিডনি প্রতিস্থাপনের এই অস্ত্রোপচারগুলো দেশের ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত করেছেন ডাক্তাররা; তারা বলছেন, এর মাধ্যমে দেশের কিডনি রোগীদের দুর্ভোগ কমানোর পথ অনেকটাই প্রশস্ত হলো।
বিএসএমএমইউ কর্তৃপক্ষ ইতোমধ্যেই একটি জাতীয় কমিটি গঠনের পরিকল্পনা করছে; যে কমিটির দায়িত্ব হবে, ব্রেইন-ডেড রোগীদের কিডনি প্রতিস্থাপনকে উত্সাহিত করা।
চিকিৎসকরা বলছেন, রোগীদের জন্য কিডনি প্রতিস্থাপনই স্থায়ী সমাধান। এছাড়া, ডায়ালাইসিসের চেয়ে প্রতিস্থাপনে খরচ কম এবং এই চিকিৎসা বেশি কার্যকর। তবে, এ ধরনের ট্রান্সপ্ল্যান্ট সার্জারি দেশে এখনও জনপ্রিয় নয়, কারণ এরজন্য দাতা খুঁজে পাওয়া খুবই কঠিন।
বিএসএমএমইউর রেনাল ট্রান্সপ্লান্ট বিভাগের প্রধান ডাঃ হাবিবুর রহমান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "উন্নত দেশগুলোয় প্রায় ৯০ শতাংশ কিডনি প্রতিস্থাপন হয় 'ব্রেইন-ডেড' রোগীর থেকে। তবে এখন যেহেতু দেশেও এই প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, ব্রেইন-ডেড রোগীদের কাছ থেকে কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টের হার আরো বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। ব্রেইন-ডেড রোগীর কিডনি দান বাড়ানো গেলে, যেসব রোগীর দাতা নেই তারা ব্রেইন-ডেড রোগীর কিডনি নিয়ে সুস্থ্যভাবে বাঁচতে পারবে।"
"কিডনি প্রতিস্থাপনের পর মাসে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকার ওষুধের প্রয়োজন হয়, আর নিয়মিত টেস্ট করতে হয়। এটি ডায়ালাইসিসের তুলনায় কম," যোগ করেন তিনি।
কিডনি ফাউন্ডেশনের অসংক্রামক রোগ বিষয়ক গবেষক ডাঃ শেখ মইনুল খোকন জানান, "সারা পৃথিবীতে কিডনির এক নম্বর উৎস হলো ব্রেইন-ডেড রোগীর কিডনি। এটাকে বাংলাদেশে আরো উৎসাহিত করতে হবে। সরকারের উচিত হবে ব্রেইন-ডেড রোগীদের স্বীকৃতি দেওয়া ও সম্মানিত করা।"
"এছাড়া, কিডনি প্রতিস্থাপনকে সাবসিডি দিতে হবে। সরকার এখন কিডনি ডায়ালাইসিসে সাবসিডি দেয়। কিন্তু ডায়ালাইসিসে খরচ বেশি, রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেনা। কিডনি ট্রান্সপ্ল্যান্টে এই সাবসিডি দিলে অনেক রোগী সুস্থ্য হয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে পারবে," যোগ করেন ডাঃ শেখ মইনুল খোকন।
কিডনি ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও বাংলাদেশ রেনাল অ্যাসোসিয়েশন এর তথ্য বলছে, প্রতিবছর বাংলাদেশে প্রায় দুই কোটি মানুষ কিডনি রোগে আক্রান্ত হন। এরমধ্যে ৪০,০০০ মানুষের কিডনিই সম্পূর্ণ বিকল হয়ে যায়।
ব্রেইন-ডেড রোগী কারা?
চিকিৎসকদের মতে, ব্রেইন-ডেড রোগীর ব্রেইন পুরোপুরি অকেজো হয়ে যায়। যন্ত্র দিয়ে শুধু হৃৎপিণ্ড সচল রাখা হয়। এমন অবস্থায় রোগীর বেঁচে ফেরার কোনো সম্ভাবনা থাকে না।
লাইফ সাপোর্টে থাকা কোনো রোগীকে নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর 'ক্লিনিক্যালি ডেড' ঘোষণা করার জন্য রয়েছে ব্রেইন-ডেড কমিটি। মেডিসিন বা ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন, নিউরোলজি ও অ্যানেস্থেসিওলজির কমপক্ষে তিনজন চিকিৎসক নিয়ে গঠিত কমিটি রোগীকে ব্রেইন-ডেড হিসেবে ঘোষণা করতে পারেন।
দেশে ব্রেইন-ডেড কিডনি প্রতিস্থাপন কম হওয়ার পিছনের চ্যালেঞ্জ
চিকিৎসকরা বলেন, অনেকে জীবিত থাকা অবস্থায় কিডনি দান করে গেলেও মৃত্যুর পর স্বজনেরা কিডনি দিতে চায় না। ধর্মীয় ও সামাজিক কারণে, অবকাঠামোগত সমস্যায়, সব হাসপাতালে ট্রান্সপ্ল্যান্ট সুবিধা না থাকায়, দূরত্ব ও যানজটসহ নানান বাধার কারণে ব্রেইন-ডেড রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন করা যায় না।
ডাঃ হাবিবুর রহমান বলেন, "ব্রেইন-ডেড রোগীর কিডনি প্রতিস্থাপন না হওয়ার যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে, তা কাটিয়ে উঠতে ডাক্তার, সব ধর্মীয় নেতা, সাংবাদিক, সমাজকর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার সমন্বয়ে আগামী মাসে ন্যাশনাল কমিটি গঠন করা হবে। সে কমিটি মানুষকে সচেতন করতে ও ব্রেইন-ডেড রোগীর কিডনি দানে আগ্রহী করতে প্রচার-প্রচারণা চালাবে।"
"এছাড়া অবকাঠামোগত উন্নয়ন করা হবে। আগে কুমিল্লা বা দেশের অন্য কোনো প্রান্ত থেকে ব্রেইন-ডেড রোগীর কিডনি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নিয়ে এসে প্রতিস্থাপন করা কঠিন হতো। তবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে, এখন তারা দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে আমাদের ব্রেইন-ডেড রোগীর কিডনি এনে দেবে। এভাবে আস্তে আস্তে শতভাগ কিডনি প্রতিস্থাপন ব্রেইন-ডেড রোগীর থেকেই করার চেষ্টা করবো আমরা," যোগ করেন তিনি।
আজ ৯ মার্চ, সারাবিশ্বের চিকিৎসকরা বিশ্ব কিডনি দিবস পালন করছেন। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো, 'কিডনি হেলথ ফর অল- প্রিপেরিং ফর দ্য আনএক্সপেক্টেড, সাপোর্টিং দ্য ভালনারেবল'।