এবার এক হামলায় ৬ কিঞ্জাল: রাশিয়ার এ হাইপারসনিক মিসাইল কেন ইউক্রেনের উদ্বেগের কারণ?
কয়েক সপ্তাহের মধ্যে রাশিয়া গত বৃহস্পতিবার (৯ মার্চ) ইউক্রেনে সবচেয়ে বড় বিমান হামলা চালিয়েছে। ইউক্রেনের বিমানবাহিনী জানিয়েছে, হামলায় রাশিয়া ছয়টি কিঞ্জাল হাইপারসনিক মিসাইল নিক্ষেপ করেছে। খবর দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর।
হামলায় এতগুলো হাইপারসনিক মিসাইল ব্যবহারের ফলে বেশ কিছু প্রশ্ন উঠেছে। দীর্ঘপাল্লার এ মিসাইলগুলো শব্দের চেয়ে পাঁচগুণ বেশি দ্রুত তথা মাক ৫ গতিতে ছুটতে পারে।
এত উচ্চগতির কারণে গতানুগতিক আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাগুলো হাইপারসনিক মিসাইলের বিরুদ্ধে কোনো কাজে আসে না। কারণ ভূমিতে থাকা রাডার যখন এগুলোকে শনাক্ত করতে পারে, ততক্ষণে মিসাইলগুলো লক্ষ্যবস্তুর কাছাকাছি পৌঁছে যায়।
চীন ও যুক্তরাষ্ট্র পাল্লা দিয়ে চেষ্টা করছে হাইপারসনিক মিসাইল তৈরি ও পরিচালনা করতে। এছাড়া এ প্রযুক্তি নিয়ে আর যেসব দেশ কাজ করছে সেগুলো হলো অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, ফ্রান্স, জার্মানি, ভারত, ইরান, ইসরায়েল, জাপান, উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া।
কিঞ্জাল মিসাইলের নিক্ষেপণ ব্যবস্থা একটু ভিন্ন। একটি সাধারণ দীর্ঘপাল্লার মিসাইলের শীর্ষে হাইপারসনিক ভেহিকল মূল ওয়্যারহেডটি বহন করে মহাশূন্যের নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছায়। এরপর মিসাইল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে অভিকর্ষজ ত্বরণ ব্যবহারের মাধ্যমে তীব্র গতিতে পৃথিবীর দিকে পড়তে থাকে মিসাইলটি।
এক্ষেত্রে ভেহিকলটি হতে পারে একটি গ্লাইডিং যন্ত্র, আবার কোনো ক্রুজ মিসাইলও। গ্লাইডিং যন্ত্রে কোনো কৃত্রিম শক্তি উৎস থাকে না, তবে ক্রুজ মিসাইলে 'স্ক্র্যামজেট' নামক এক ধরনের ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয় যা মিসাইলটিকে বাড়তি কয়েকশ মাইল দূর পর্যন্ত বহন করতে পারে।
রাশিয়ান সেনাবাহিনীর স্বল্পপাল্লার ইস্কান্দার ব্যালিস্টিক মিসাইলের মডিফাইড সংস্করণ কিঞ্জাল। ভূমি থেকে উৎক্ষেপণ না করে আকাশ থেকে নিক্ষেপ করা হলে মিসাইলের জ্বালানি খরচ কম হয়, যা এর দ্রুতি বাড়াতে সাহায্য করে।
কিঞ্জাল চলার সময় এর গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে বলে ধারণা করা হয়। ফলে এটি প্রতিহত করা আরও কঠিন হয়ে পড়ে। কিছু কিছু ইস্কান্দার মিসাইল লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানার পূর্বমুহূর্তে শত্রুর আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে বোকা বানানোর জন্য ছোট ছোট নকল মিসাইলও নিক্ষেপ করে।
রাশিয়া মূলত কিঞ্জাল তৈরি করেছে আমেরিকার মিসাইল প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ভাঙতে। রাশিয়ার দাবি, কিঞ্জাল মাক ১০ ও তার বেশি পর্যন্ত গতিতে ছুটতে পারে। পেন্টাগন জানায়, মিগ-৩১ যুদ্ধবিমান থেকে কিঞ্জাল নিক্ষেপ করা হয়।
জিরকন নামক আরেকটি হাইপারসনিক মিসাইল থাকার দাবিও করেছে রাশিয়া। এ ক্রুজ মিসাইলটি জাহাজ থেকে নিক্ষেপ করা সম্ভব। কিঞ্জাল অনেকবার বর্তমান যুদ্ধে ব্যবহার করা হলেও রাশিয়া এখনো কোনো যুদ্ধে জিরকন ব্যবহার করেনি। এমনকি পরীক্ষামূলক উৎক্ষেপণের কথাও জানা যায়নি।
কিঞ্জালকে ভূপাতিত করতে সক্ষম এমন কোনো অস্ত্র ইউক্রেনের কাছে নেই বলে জানিয়েছেন দেশটির বিমানবাহিনীর একজন মুখপাত্র ইউরি ইনাত।
আর বৃহস্পতিবার এ মিসাইল ব্যবহার করার কারণে রাশিয়ার মিসাইল লক্ষ্যবস্তুতে সফলভাবে পৌঁছানোর অনুপাত বেড়ে গেছে। এদিন রাশিয়া ৮১টি মিসাইল নিক্ষেপ করেছিল, যার মধ্যে ৪৭টি লক্ষ্যবস্তুতে হামলা করতে সক্ষম হয়। এ অনুপাত অন্যান্য সময়ের মিসাইল হামলার চেয়ে বেশি।
কিঞ্জালের অবশ্য কিছু সীমাবদ্ধতাও রয়েছে। উৎক্ষেপণের আগেই এ মিসাইলের অপারেটিং ব্যবস্থায় লক্ষ্যবস্তুর কোঅর্ডিনেট আপলোড করা হয়। তাই উচ্চগতিতে ধাবমান অবস্থায় এটির কোনো ডানায় অল্পবিস্তর নড়চড়ও লক্ষ্যবস্তু থেকে মিসাইলটিকে অনেক দূরে সরিয়ে দিতে পারে। এ কারণেই হয়তো বৃহস্পতিবারের হামলায় একটি কিঞ্জাল কিয়েভে একটি গাড়ির ওপর এসে পড়ে।
রাশিয়ার সাম্প্রতিক হামলাটি নিয়ে একটি বড় প্রশ্ন হচ্ছে, একক হামলাতেই দেশটি কেন এতগুলো হাইপারসনিক মিসাইল ব্যবহার করল।
ইউক্রেনীয় গোয়েন্দা সংস্থা জানিয়েছিল, বৃহস্পতিবারের হামলার আগে রাশিয়ার কাছে ৫০টির বেশি কিঞ্জাল থাকার কথা নয়। অস্ত্রাগারের এত বড় অংশ একবারেই কেন দেশটি খরচ করে ফেলল, তা এখনো অস্পষ্ট।
তবে যেহেতু ইস্কান্দার মিসাইলের মডিফাইড সংস্করণ এ কিঞ্জাল মিসাইলগুলো, তাই এটির ভান্ডারও খুব সহজে পূর্ণ করার সক্ষমতা রয়েছে রাশিয়ার। অন্যদিকে জিরকনের নির্মাণ একেবারে শূন্য থেকে শুরু করতে হয়।
তবে বর্তমান যুদ্ধের গতিপ্রকৃতি বদলে দেওয়ার ক্ষমতা নেই কিঞ্জাল হাইপারসনিক মিসাইলের। এমনকি রাশিয়া যদি দ্রুতগতিতে বেশিসংখ্যক কিঞ্জালও তৈরি করতে পারে, স্রেফ আকাশযুদ্ধ দিয়ে এ যুদ্ধের হাওয়াবদল সম্ভব নয়।
একদিক থেকে তুলনা করলে, হাইপারসনিক মিসাইলের তুলনায় রাশিয়া আর্টিলারির মাধ্যমে ইউক্রেনের বেশি ক্ষতিসাধন করছে।
অন্যদিকে, ভূমিতে রাশিয়ার আক্রমণ এখন একপ্রকার অচলাবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। অনেক বিশ্লেষকের মতে, রাশিয়ার বহুল-অনুমিত বসন্তকালীন অভিযান ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে, কিন্তু এটি এখনো খুব বেশি প্রভাব ফেলতে পারছে না। এর কারণ রুশ বাহিনীর সেনাবল ও অস্ত্রাগার দুটোই ক্রমে ফুরিয়ে আসছে।