মাটির টালির বিদেশ যাত্রা
২০০২ সালে সম্ভাবনা নিয়ে শুরু হয় সাতক্ষীরার কলারোয়া সদরের মুরারিকাটির মাটির তৈরি টালির ইতালিতে রপ্তানি। ২০ বছরের ব্যবধানে এখন শুধু ইতালি নয়, বরং টালি যাচ্ছে ইউরোপ, আমেরিকার বিভিন্ন দেশে। তবে পৃষ্ঠপোষকতার অভাবসহ নানা কারণে টালি কারখানার সংখ্যা ৪১টি থেকে কমে ১০টিতে দাঁড়িয়েছে। তারপরও বিদ্যমান এসব কারখানা থেকে বছরে ১২-১৫ কোটি টাকার টালি বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে।
রপ্তানিযোগ্য টালি প্রস্তুত শুরুর কাহিনী
গাজীপুরের জাহাঙ্গীর আলমের কট্ট-কলম্বো কারখানায় ম্যানেজার পদে চাকুরি করতেন বরিশালের বাসিন্দা রুহুল কুদ্দুস। চাকুরিকালীন সময়ে ওই কারখানায় ইতালির বায়ার রাফাইলি আলদো আসেন প্লেইন টালি রপ্তানির জন্য চুক্তি করতে। চুক্তি অনুযায়ী, কারখানাটি টালি প্রস্তুত করে ইতালিতে রপ্তানি করে। তবে ইটভাটায় পোড়ানো টালি ভালো না হওয়ায় বায়ারের পছন্দ হয়নি। ফলে তিনি অভিযোগ তোলেন।
এরপর ভাটা মালিক জাহাঙ্গীর আলম ম্যানেজার রুহুল কুদ্দুসের মাধ্যমে কলারোয়ার পালপাড়ায় ঘরের ছাউনি দেওয়ার টালি তৈরি হয় বলে জানতে পারেন। ভাটা মালিক জাহাঙ্গীর আলম এখান থেকে টালি প্রস্তুতকারী কিছু শ্রমিক ও মালিকদের তার ইটভাটায় ডেকে পাঠান। ২০০০ সালে রাফাইলি আলদো আবারও টালির জন্য গাজীপুরের কট্ট-কলম্বো ফ্যাক্টরিতে আসেন। কলারোয়ার পালপাড়ায় টালি প্রস্তুত হয় খবর শুনে সেখানকার টালি কারখানাটি দেখতে আসেন তিনি। তিনি পালপাড়ার গোষ্ঠ চন্দ্র পালের কারখানা থেকে ১৫ পিস চারকোনা ছাদ টালি পছন্দ করেন ও সঙ্গে নিয়ে যান। সেগুলো জার্মানিতে পরীক্ষা করেন ও রিপোর্ট ভালো পেয়ে পছন্দ হয় তার। এরপর সরাসরি পালপাড়া থেকেই ছাদ টালি ইতালিতে নিতে আগ্রহ প্রকাশ করেন।
গোষ্ঠ চন্দ্র পালের টালির ইতালি যাত্রা
ইতালীয় বায়ারের আগ্রহের পরও বিদেশে পাঠানোর জন্য টালি প্রস্তুত করতে কলারোয়া সদরের মুরারিকাটি পালপাড়ার কেউই রাজি হয়নি। তবে গোষ্ঠ চন্দ্র পাল, শংকর পাল, লক্ষণ পাল ও শ্রীকান্ত রাজি হন। ২০০২ সালে পালপাড়া থেকে দশ হাজার পিস ছাদ টালি ইতালিতে রপ্তানি করেন গোষ্ঠ চন্দ্র পাল। ২০০৪ সাল থেকে পুরোদমে শুরু হয় রপ্তানি। সে সময়ে গাজীপুরের জাহাঙ্গীর আলম ও ম্যানেজার রুহুল কুদ্দুসের মাধ্যমে বিদেশে টালি পাঠাতেন কলারোয়ার প্রস্তুতকারকরা।
ম্যানেজার রুহুল কুদ্দুস পরে নিজেই পালপাড়ায় একটি কারখানা দেন। টালি প্রস্তুতকারী গোষ্ঠ চন্দ্র পাল জানান, '২০০৫ সালের দিকে গাজীপুরের কট্ট-কলম্বো ফ্যাক্টরি ম্যানেজার কলারোয়ার মুরারিকাটি এসে বসতি গড়ে তোলেন ও টালি ফ্যাক্টরি গড়েন। তখনও তার মাধ্যমে আমরা বিদেশে টালি পাঠিয়েছি। তারপর ২০০৭ সালের দিকে বায়ারদের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ করে আমরা নিজেরাই ইতালিতে টালি পাঠানো শুরু করি।'
গড়ে ওঠে টালি কারখানা মালিক সমিতি
ইতালিতে ছাদ টালি ব্যাপকভাবে রপ্তানি হওয়ার কারণে গড়ে ওঠে কলারোয়া টালি কারখানা মালিক সমিতি। সমিতির অর্ন্তভূক্ত হয় ৪১টি কারখানা। সমিতির সভাপতি হন গোষ্ঠ চন্দ্র পাল।
গোষ্ঠ চন্দ্র পাল জানান, প্রথমদিকে ছোটবড় ৪১টি কারখানা গড়ে ওঠে। যারা প্রত্যেকে ১০-১৫ লাখ টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করে। একটি টালির মূল্য পেতাম আমরা পাঁচ টাকা। বছরে ৩০০-৩৫০ কন্টেইনার টালি রপ্তানি হতো। প্রতি কন্টেইনারে টালি যেত ১০-১৫ হাজার পিস।
টালির প্রকারভেদ
কলারোয়ায় মাটি দিয়ে এখন তৈরী হচ্ছে ছাদ বা রুফ টালি, ফ্লোর টালি, ওয়াল টালি ও টেরাকোটা টালি। এসব টালির বিভিন্ন আকার ও প্রকারভেদ রয়েছে। তবে বিদেশে বেশি রপ্তানি হচ্ছে ফ্লোর টালি, ওয়াল টালি ও তেরাকোটা টালি। অন্যদিকে রুফ টালির চাহিদা বেশি বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায়।
অসাধু বিশেষজ্ঞদের খপ্পরে পড়ে সর্বস্বান্ত
২০১৩-১৫ সালের দিকে ইউরোপে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দেয়। তখন টালির চাহিদা কমতে থাকে। ওই সময়ে কিছু অসাধু বিশেষজ্ঞ পালপাড়ার কয়েকজন কারখানা মালিকের প্রায় কোটি টাকা আত্মসাৎ করে, যে টাকা আজও উদ্ধার হয়নি। এর মধ্যে সাতক্ষীরার কটো ইনোভেটর পরিচালক মল্লিক মঞ্জুরুল আলম মারা গেছেন। অন্য দুজন হলেন- খুলনার রপ্তানিকারক জাকির হোসেন ও ঢাকার রুবেল হোসেন। তখন থেকে কমতে থাকে টালি তৈরির কারখানা।
বর্তমান রপ্তানি
বর্তমানে এখানকার টালি রপ্তানি হচ্ছে ইতালি, স্পেন, পর্তুগাল, নেদারল্যান্ড, ইংল্যান্ড, জার্মানি এবং দুবাইয়ে। বছরে এখান থেকে রপ্তানি হচ্ছে ১২-১৫ কোটি টাকার টালি। খুলনা ও ঢাকার বিভিন্ন রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান এসব টালি রপ্তানির সঙ্গে জড়িত।
কারখানা কমেছে, ব্যবসা ছেড়েছে পালরা
পূর্বে ৪১টি কারখানা থাকলেও এখন কারখানার সংখ্যা মাত্র ১০টি। এখন টালি তৈরিতে পালদের আধিপত্য নেই। চারটি কারণে ব্যবসা ছেড়ে দিয়েছেন অনেকে।
কারণগুলো ব্যাখ্যা করে টালি কারখানা মালিক ব্যবসায়ী সমিতি সভাপতি গোষ্ঠ চন্দ্র পাল জানান, ২০০৮-২০০৯ সালে একটি টালির মূল্য ছিল ৫ টাকা; এখন বিক্রি হচ্ছে ৬ টাকা। তখন শ্রমিকের মজুরি কম ছিল, এখন বেড়েছে। উৎপাদন খরচও বেড়েছে। তবে বিক্রির বেলায় দাম সেভাবে বাড়েনি। ব্যবসায় লাভ একেবারেই সীমিত। সেকারণে অনেকে বন্ধ করেছে। এছাড়া রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে এই ব্যবসায়।
তিনি বলেন, কিছু মানুষ রয়েছে রাজনৈতিক প্রভাব খাঁটিয়ে বায়ারদের ভীতসন্তন্ত্র করে ফেলে। আমার কাছ থেকে টালি নিতে হবে। অন্য কারো কাছ থেকে নেওয়া যাবে না। এই ব্যবসায় এখানে স্বাধীনতা নেই। রপ্তানিকারকরা তাদের ইচ্ছেমতো মাল নিতে পারেন না। একারণেও বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখন আমিসহ বাদল পাল, শ্রীকান্ত পাল এই তিনজন রয়েছি পাল বংশের। বাকি সাতটি কারখানা অন্যদের। যারা উৎপাদন শুরু করেছিল তাদেরই কারখানা এখন বন্ধ।
বড় কারখানা
মুরারিকাটি গ্রামে টালি উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান মেসার্স শেখ ট্রেডার্স। এই প্রতিষ্ঠানটি এখন টালি তৈরির বড় কারখানা। প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক শেখ ইমাদ। তিনি পৌরসভার ৮ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর। তিনি জানান, ৬-৭ বছরের ব্যবধানে হারিয়ে যেতে বসেছে টালি শিল্প। শ্রমিক মজুরি বেড়ে যাওয়া, মাটির দাম বৃদ্ধিসহ নানান কারণে কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছে মালিকরা। এছাড়া বিদেশেও চাহিদা আর আগের মত নেই।
এদিকে এই কারখানা মালিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, সিন্ডিকেট করে হুমকি ও প্রভাব বিস্তার করে পালসহ অন্যদের কোণঠাসা করে ফেলেছেন তিনি। টালি ব্যবসাকে কুক্ষিগত করেছেন। পৌরসভার নামে ৩০০ টাকা চাঁদাও নেন তিনি। তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে বিষয়গুলো অস্বীকার করেছেন তিনি।
কলারোয়া টালি ঘরের পরিচালক কয়লা ইউনিয়নের ইউপি সদস্য আবুল হোসেন বলেন, "চাঁদাবাজি ও সিন্ডিকেটের কারণে ধ্বংস হচ্ছে টালি শিল্প। মেসার্স শেখ ট্রেডার্স প্রতিষ্ঠানটির পরিচালক শেখ ইমাদ প্রভাব বিস্তার করে ব্যবসাটিকে কুষ্ঠিগত করে ফেলেছেন। সিন্ডিকেট করে তার মাধ্যমেই টালি বিক্রি করতে হবে মর্মে নিয়ম করে ফেলেছেন। কোথাও অভিযোগ দেওয়ার সাহসও নেই কারো।"
কর্মসংস্থান
আগে ৪১টি কারখানায় কয়েক হাজার শ্রমিক কাজ করতো। এখন কলারোয়ার শ্রীপতিপুর, মির্জাপুর ও মুরারিকাটি এই তিনটি গ্রামে ১০টি কারখানায় সব মিলিয়ে ৩০০-৩৫০ জন শ্রমিক কাজ করছেন। এদের দৈনিক মজুরি ২০০ থেকে ৫০০ টাকা পর্যন্ত।
মুরারিকাটি গ্রামের মহিউদ্দীন জানান, আমি ৩৫ বছর ধরে পালপাড়ার টালি কারখানায় কাজ করছি। আমি যখন কাজ শুরু করি তখন টালি বিদেশে রপ্তানি হতো না। মিঠা মাটির টালি দিয়ে তৈরি করতে হয় এ টালি।
পালপাড়ার কর্মযজ্ঞ মোংলা বন্দরে
কলারোয়া টালি ঘরের মানেজার কাজী আমির হোসেন জানান, 'আমাদের দুটো কারখানা। একটা প্লেইন টালি যেটা রপ্তানি হয়, আরেকটা রুফ টালি- সেটা দেশের জন্য। প্লেইন টালি ও টেরাকোটা টালি বিদেশ যায়। দুটো কারখানায় পুঁজি রয়েছে ৬০ লাখ টাকা। শ্রমিক ৭০ জন, নারী শ্রমিক রয়েছে ২০ জন। প্রতি মাসে আমাদের ৫০ কন্টেইনার টালি বিদেশ যাচ্ছে। এখান থেকে ট্রাকে মংলা বন্দরে পাঠানো হয়। সেখানে প্যাকিং করার পর জাহাজে ওঠে। প্রতি গাড়িতে ১০০-২০০ পিস টালি ভেঙে যায়। সেগুলো আমরা অতিরিক্ত দিয়ে দেই। অধিকাংশ রপ্তানি হয় মোংলা বন্দর থেকে। বছরে ৫-৭টি ট্রাক চট্রগ্রাম নদী বন্দরে যায়।
নেই বিসিকের নিবন্ধন
সরকারি সুবিধা বঞ্চিত টালি কারখানা মালিকরা। কারণ তাদের বিসিকের নিবন্ধন নেই। টালি কারখানা মালিক ব্যবসায়ী সমিতি সভাপতি গোষ্ট চন্দ্র পাল বলেন, কেউ বিসিকের নিবন্ধন করেনি। কারণ তারা বোঝে না। আমি তিন মাস আগে বিসিকের নিবন্ধন করেছি।
সাতক্ষীরা বিসিক শিল্প নগরীর উপ ব্যবস্থাপক গোলাম সাকলাইন বলেন, কলারোয়ার টালি ইতালি, সুইডেনসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়ে আসছে। তবে এদের কোন নিবন্ধন নেই। আমরা এদেরকে নিবন্ধনের আওতায় নিয়ে আসার কার্যক্রম শুরু করেছি। নিবন্ধন না থাকায় সরকারি কোন সহায়তা তারা পাচ্ছে না। তবে একাজের সঙ্গে জড়িতদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাচ্ছে। এটি সাতক্ষীরার সম্ভাবনাময় একটি শিল্প।