২৯ বছরেও সেই ভয়াল স্মৃতি ভুলেননি উপকূলবাসী
'শুক্রবার থেকে গুমোট পরিবেশে বাতাসসহ বৃষ্টি হচ্ছিল। খবর পেয়েছিলাম পাশের গ্রামে মেঝ মেয়েটি সন্তানসহ অসুস্থ। কাঁচা রাস্তা, তার ওপর বৃষ্টি হওয়ায় তাদের দেখতে যেতে পারিনি। এখনকার মতো মোবাইল যোগাযোগ ছিল না বলে আর খবরও নিতে পারিনি তাদের কি অবস্থা? অপেক্ষায় ছিলাম বৃষ্টিটা থামলে মেয়ের বাসায় গিয়ে নাতি ও তার সেবা করব। কিন্তু সোমবার জলোচ্ছাসের পর বৃষ্টি থামলেও চারপাশ ছিল লণ্ডভণ্ড। প্রায় ২০ ফুট উঁচু বয়ে যাওয়া জলোচ্ছ্বাসে অন্য উপকূলবাসীর মতো আমার মেয়ে ও নাতিরা তাদের দাদিসহ ভেসে গিয়ে প্রাণ হারায়। তাদের মরদেহটি পর্যন্ত আর দেখা হয়নি। ২৯ বছরে এলাকার অনেক কিছুর পরিবর্তন হয়েছে। জীবন সায়াহ্নে এসে মৃত্যর প্রহর গুণছি। গত মাস দেড়েক ধরে চারপাশে করোনা নামে একটি পোকার ভয়ে সব কিছু স্তব্দ। এরপরও মেয়ে এবং নাতি ও তাদের পরিবারের সবাইকে হারানোর স্মৃতি আমায় পিছু ছাড়েনি। আজ (২৯ এপ্রিল) তাদের কথা বেশি মনে পড়ছে।'
কক্সবাজার সদর উপজেলার উপকূলীয় পোকখালীর উত্তর গোমাতলীর বাড়িতে বসে ভয়াল ২৯ এপ্রিলের রাতে স্বজন হারানোর সেই স্মৃতি আওড়াতে গিয়ে বুধবার আবেগ তাড়িত হন নুর জাহান বেগম (৬৭)। তিনি সেদিন পাশের গ্রাম কাটাখালীতে বিয়ে দেয়া মেয়ে-নাতিসহ সবাইকে হারিয়েছিলেন।
শুধু তিনি নন, উপকূলের শত শত মানুষ তার মতো আপনজনকে হারিয়ে এখনো স্মৃতি হাতড়ে বেড়াচ্ছেন। প্রায় আড়াই যুগ সময় পিছনে ফেলে এসেছেন জলোচ্ছ্বাস আক্রান্ত মানুষ। কিন্তু হারানোর বেদনা তাদের কখনো নিস্তার দেয়নি। উপকুলবাসীর স্বজন হারানোর সেই ভয়াল ২৯ এপ্রিল আজকের দিনে ভারাক্রান্ত মনে কেউ মিলাদ পড়িয়ে, কেউ বা বিলাপে শান্তনা খোঁজার চেষ্টা চালাবেন।
১৯৯১ সালের এ দিনে স্মরণকালের ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস কক্সবাজারের দ্বীপাঞ্চলসহ উপকূলীয় এলাকা তছনছ করে মহাধ্বংসযজ্ঞ সৃষ্টি করেছিল। রাতের অন্ধকারে মুহুর্তে লণ্ডভণ্ড হয়েছিল উপকূলীয় এলাকা। দেশের মানুষ বাকরুদ্ধ হয়ে প্রত্যক্ষ করেছিল প্রকৃতির এই রুদ্ধরোষ। এর আগে প্রাকৃতিক দুর্যোগের এতবড় অভিজ্ঞতার মুখোমুখি উপকুলের মানুষ আর কখনো হয়নি। তাই ১৯৯১ সালের পর থেকে ২৯ এপ্রিল আসলে স্বজন হারা মানুষের কান্নায় এখনও ভারি হয় উপকূলের পরিবেশ। সেদিন জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়ে অকালে হারিয়ে যাওয়া স্বজনদের স্মৃতি উপকূলবাসীকে এখনো তাড়ায়। বেদনা অশ্রু ভারাক্রান্ত হন তারা।
ক্ষতিগ্রস্তদের মতে, সেদিন আবহাওয়া বিভাগ উপকূলীয় এলাকায় ৯নং সতর্ক সংকেত জারি করলেও অজ্ঞতার বশে লোকজন নিরাপদ স্থানে না যাওয়ায় মহা দূর্যোগের শিকার হন। রাত ১০টার পর ১০ থেকে ২০ ফুট উচ্চতায় সাগরের পানি মুহুর্তেই লোকালয়ে ঢুকে জলোচ্ছ্বাস ও ঘুর্ণিঝড়ের তাণ্ডবলীলায় অনেক মা হারায় সন্তান, স্বামী হারায় স্ত্রী, ভাই হারায় বোনকে। অনেক পরিবার আছে যাদের গোটা পরিবারই পানির স্রোতে হারিয়ে গেছে। সে ভয়াল স্মৃতি মনে করে এখনও কাঁদেন স্বজন হারানো উপকুলবাসী।
প্রশাসনের হিসাব মতে, ২৯ এপ্রিলের ঘুর্ণিঝড়ে উপকুলীয় ১৯ জেলার ১০২ থানা ও ৯টি পৌরসভায় ১ লাখ ৩৮ হাজার ৮৮২ জন নিহত, ১২ হাজার ১২৫ জন নিখোঁজ, ১ লাখ ৩৯ হাজার ৫৪ জন আহত হন। মাছ ধরার ট্রলার, নৌকা, বৈদ্যুতিক খুটি, গাছ-পালা, চিংড়ি ঘের, স্কুল-মাদ্রাসা, পানের বরজ, লাখ লাখ গবাদি পশু, ব্রিজ, কালভার্ট ভেঙ্গে গিয়ে ক্ষতি সাধিত হয় কয়েক হাজার কোটি টাকার। তাই ২৯ বছর পরও অতীতের স্মৃতি মুছতে পারেনি উপকুলবাসী।
তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, ১৫৬১ সালের জ্বলোচ্ছাসেও উপকূলের বিপুল মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। এছাড়া ১৭৬২ সালে, ১৭৯৫ সালের ৩ জুন, ১৮৯৭ সালের ২৪ অক্টোবরে, ১৯০৫ সালের ২৯ এপ্রিলে, ১৯৬৩ সালের ২৭ মে, ১৯৭২ সালের অক্টোবরে, ১৯৯৭ সালের নভেম্বরে, ১৯৬৫ সালের ভয়াবহ ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে কুতুবদিয়াদ্বীপসহ উপকূলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। সর্বশেষ ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসে কুতুবদিয়া খুদিয়ার টেক নামক একটি এলাকাপুরো বিলীন হয়ে গেছে।
১৯৯১ সালের এ দিনে সবচেয়ে বেশী প্রাণহাণি ঘটে কক্সবাজারের দ্বীপ উপজেলা মহেশখালীর উপদ্বীপ ধলঘাটা-মাতারবাড়ি, পেকুয়ার মগনামা ইউনিয়ন, কুতুবদিয়ার প্রায় পুরো উপজেলা এবং সদরের বৃহত্তর গোমাতলী এলাকায়। ওখানে অধিকাংশ বাড়ি থেকে পরিবারের ৫-৬ জন লোক মারাযান। অনেক যৌথ পরিবারে এমনও রয়েছে একসঙ্গে ৪০ জন মারা গেছেন। তাই এ দিনটিতে এখনও স্বজন হারানোর বেদনায় নিরবে বা বিলাপে কান্না করেন অনেকে।
এতকিছুর পরও কক্সবাজারের উপকূলে পর্যাপ্ত ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নেই। বিদ্যমান ৫ শতাধিক আশ্রয় কেন্দ্রের অধিকাংশ ব্যবহার অনুপযোগী। শুধু সাইক্লোন সেল্টার নয়, উপকুলের কয়েকশ' কিলোমিটার বেড়িবাঁধ এখনো চরম ঝুঁকিতে রয়েছে। ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ে এসব উপকূলীয় বেড়িবাঁধ বিলীন হয়েছিল। ওই ভাঙা বাঁধ এখনো পরিপূর্ণ মেরামত হয়নি।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. কামাল হোসেন বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ আশ্রয়কেন্দ্রগুলোর সংস্কার ও অবৈধ দখল উচ্ছেদে কার্যক্রম নিয়মিত চলমান। এছাড়াও যেখানে প্রয়োজন সেখানে নতুন আরও কেন্দ্র স্থাপনের কাজ চলছে।
এদিকে, সারা দেশের মতো কক্সবাজারেও করোনার প্রাদূর্ভাবে লকডাউন পরিস্থিতি থাকায় অন্য সময়ের মতো শোক র্যালি বা ঘটা করে মিলাদ ও মোনাজাত না হলেও নিহত এবং নিখোঁজদের আত্মার মাগফেরাত কামনায় স্বজনরা নিজেদের মতো করে দোয়া করবেন তারা।