তিন গোয়েন্দা দেখতে কেমন? যেভাবে মিলল তাদের চেহারা!
বয়স তখন দশ বা এগারো হবে বোধ হয়। আমাদের বাসায় নানান রকম বইয়ের সাথে ছোট ছোট সাইজের পেপারব্যাক কয়েকটা বই ছিলো। তার মধ্যে দুটো বই - 'হারানো জাহাজ' আর 'ঘড়ির গোলমাল'। বাবার চাকরির সুবাদে আমরা থাকতাম খুলনা শিপইয়ার্ড অফিসার্স কলোনিতে। কাজেই বড় বড় জাহাজ দেখাটা আমাদের কাছে নিত্যদিনের ব্যাপার ছিল। সেজন্যই বোধহয় হারানো জাহাজ নামটা এক ধরনের আকর্ষণ তৈরি করতো। কিন্তু হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখা পর্যন্তই সীমাবদ্ধ থাকতাম।
তারপর একদিন দেখলাম পাড়ার বড় ভাইরা কী এক বই নিয়ে খুব আলোচনা করছে। আরেহ! এরা তো ওই বইগুলোর কথাই বলছে! তিন গোয়েন্দা...কিশোর ক্লাসিক...সেবা প্রকাশনী! এই প্রথম সত্যি সত্যি পড়ে দেখার আগ্রহ হলো। বাসায় গিয়ে আবার নিলাম বই দুটো। কিন্তু 'হারানো জাহাজ' নয়, সাতপাঁচ না ভেবেই শুরু করলাম 'ঘড়ির গোলমাল'। তখনো জানি না রহস্য-রোমাঞ্চ আর অ্যাডভেঞ্চারের এক নতুন দুনিয়ায় প্রবেশ করে ফেলেছি যার মাঝে কেটে যাবে শৈশব কৈশোরের চমৎকার বছরগুলো। সেই যে শুরু করলাম, আর থামতে পারিনি।
বলছি আমাদের সবার প্রিয় সেবা প্রকাশনীর তুমুল জনপ্রিয় সিরিজ রকিব হাসানের 'তিন গোয়েন্দা'র কথা। বাংলাদেশের পাঠকদের একটা বড় অংশের বই পড়ার হাতেখড়ি এই তিন গোয়েন্দা দিয়েই। যদিও সেবার এক নাম্বার সিরিজ নিঃসন্দেহে মাসুদ রানা, কিন্তু তিন গোয়েন্দাও কম যায় না কোন অংশেই। অন্তত ১২-১৫ বছর বয়সে বই পড়ার যে সহজ, সাবলীল, রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা আমরা খুঁজতাম, তা তিন গোয়েন্দা দিতে পেরেছে সম্পূর্ণরূপে।
তিন গোয়েন্দা পড়তে গিয়ে ওদের চেহারা কল্পনা করেননি, এমন পাঠক একজনও পাওয়া যাবে না। আমি তো রীতিমত কল্পনার রাজ্যে ওদের সাথেই থাকতাম, ঘুরে বেড়াতাম। ওরা দেখতে কেমন, বয়স আসলে কত, এই নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা চলত। আশেপাশের অনেকের চেহারার সাথে কিশোর, রবিন, মুসাদের মেলাবার চেষ্টা করতাম। অথচ কিশোর বাদে সবাই তো বিদেশি। মিলবে কোত্থেকে?
অবশেষে মিডজার্নি এসে কল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেবার পথ দেখিয়ে দিলো। এখানে যে পোস্টারটা রয়েছে তাতে মিডজার্নির সহায়তায় আমার কল্পনার কিশোর, মুসা, রবিন আর জিনাকে তৈরি করার চেষ্টা করেছি। শতভাগ সন্তুষ্ট না হলেও এটা আমার ভাবনার তিন গোয়েন্দার সাথে অনেকটাই মেলে। তারপর ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত নামলিপি আর ব্যাকগ্রাউন্ড ইমেজ সম্বল করে ফটোশপের সাহায্যে বানিয়ে ফেললাম এই পোস্টার। একজন অন্ধ ভক্তের পক্ষ থেকে সেবা প্রকাশনী, রকিব হাসান আর তিন গোয়েন্দার জন্য এটাই আমার ভালোবাসার নিবেদন।
কোন ঘোরের ভেতর দিয়ে একটার পর একটা তিন গোয়েন্দা গোগ্রাসে গিলেছি ভাবলেও অবাক লাগে। রিকশা ভাড়া কিংবা টিফিনের টাকা বাঁচিয়ে তিন গোয়েন্দার বই কেনার অভিজ্ঞতা মনে হয় আমার মত সব ভক্তেরই আছে। আমাদের ওখানে একটা মাত্র দোকানে সেবার বই পাওয়া যেত। সিড়ির নিচের ছোট্ট একটা দোকান, কিন্তু রাজ্যের মণিমাণিক্যে ঠাসা। সময়ের বিবর্তনে হাজারো স্মৃতির সেই দোকানটিও এখন আর নেই।
আমার তিন গোয়েন্দা পড়ার শুরু নব্বই দশকের শেষ ভাগে হলেও, এই সিরিজের তুঙ্গস্পর্শি জনপ্রিয়তা আরো দুই জেনারেশন আগে থেকে। ১৯৮৫ তে শুরু হওয়া এই সিরিজ এখনো চলছে সমানতালে। এখনকার ছেলেমেয়েরাও যে তিন গোয়েন্দাকে একইভাবে ভালোবাসে, বইমেলায় সেবার স্টলে গিয়ে এখনো তারা তিন গোয়েন্দা হাতে তুলে নেয়, সেটাই এই সিরিজের স্বার্থকতা। আর পুরনো পাঠকরা, যারা কৈশোর পেরিয়ে এসেছেন বহু আগে, তারাও কি চাইলেই পারবেন এই নস্টালজিয়া থেকে বের হতে? তবে রকিব হাসান এখন আর তিন গোয়েন্দা লিখেন না। বয়স ও অসুস্থতা তার কলম থামিয়ে দিয়েছে।
কিশোর, মুসা আর রবিন সুদুর লস এঞ্জেলসের রকি বিচে থেকেও যেন পাশের বাড়ির বন্ধুর মত ছিলো। তাদের সাথে প্রায়ই পেয়ে যেতাম জিনাকে। সাথে অবশ্যই থাকবে জিনার পোষা কুকুর রাফিয়ান। ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে এই চারের কম্বিনেশন মারাত্মক লাগতো। কিশোর আসলে এই সিরিজে সব বাংলাদেশি কিশোরেরই প্রতিনিধিত্ব করে। সব ছেলেই মনে হয় কখনো না কখনো নিজেকে কিশোর ভেবে রোমাঞ্চিত হয়েছে। কোঁকড়া চুলের প্রখর বুদ্ধিদীপ্ত কিশোর পাশাকে ভালো না বেসে উপায় নেই।
ভীতুর ডিম মুসাকে আমার ভীষণ পছন্দ, কারণ সে খেতে পছন্দ করে। ভীতু হলে কি হবে, শক্তিতে সে সবার বস। আর মুসার মুদ্রাদোষ 'খাইছে' তো আমার এখন পর্যন্ত কথার মাঝে নিজের অজান্তেই চলে আসে। শান্তশিষ্ট, বইপড়ুয়া রবিনকে ভালো লাগতো তার পড়ার অভ্যাস এবং জ্ঞানের পরিধির কারণে। রবিন হচ্ছে বেশি বুদ্ধিমান কিশোর আর কম বুদ্ধির মুসার মাঝে একটা পারফেক্ট ব্যালেন্স। আর জিনা এদের তিনজন থেকে একেবারেই আলাদা। একরোখা, টমবয়সুলভ জিনার বন্ধুদের জন্য ভালোবাসা আর কখনো হার না মানার স্পিরিট তাকে আলাদা মাত্রা দেয়।
অন্যান্য যে চরিত্রের কথাই বলি, সবাই আলাদা ভালোবাসার জায়গা জুড়ে আছে। বিশেষ করে মেরী চাচি, রাশেদ চাচা, চিত্র পরিচালক ডেভিস ক্রিস্টোফার, তুখোড় গোয়েন্দা ভিক্টর সাইমন, পুলিশ চীফ ক্যাপ্টেন ইয়ান ফ্লেচার, বেদুঈন বৈমানিক ওমর শরীফ, বিখ্যাত চিত্রচোর মসিয়ে শোঁপা, শোফার হ্যানসন, ব্যাভারিয়ান দুই ভাই বোরিস আর রোভার, 'ঝামেলা' ফগর্যাম্পারকট, ফগের ভাতিজা বব আর তিন গোয়েন্দার চির শত্রু টেরিয়ার ডয়েল ওরফে শুটকি টেরি, এরা সবাই যেন আমাদের ভীষণ কাছের মানুষ।
যাই হোক, তিন গোয়েন্দা যে পুরোপুরি মৌলিক কাহিনী নয় সে সম্পর্কে সচেতন হয়েছি অনেক পরে। যদিও বা 'বিদেশি কাহিনীর ছায়া অবলম্বনে' লেখা থাকতো, তা নিয়ে কে মাথা ঘামায়? আমরা তো তখন পাশা স্যালভেজ ইয়ার্ডের জঞ্জালের তলে গোপন হেডকোয়ার্টার থেকে অথৈ সাগরের উত্তাল ঢেউ পাড়ি দিয়ে কোন এক ভীষণ অরণ্যের গহীনে হারিয়ে যেতে মগ্ন। কিন্তু এখন জানি, আলফ্রেড হিচকককের "থ্রি ইনভেস্টিগেটরস" সিরিজ থেকে করা। এ সিরিজের বাইরেও রকিব হাসান বিভিন্ন লেখককের কিশোর রোমাঞ্চপোন্যাস থেকেও কাহিনী নিয়েছেন। এনিড ব্লাইটনের "ফেমাস ফাইভ" সিরিজের কিছু বইও তিন গোয়েন্দা হয়েছে।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে, এই মৌলিকতার অভাব কোনদিনই পাঠকদের বিমুখ করতে পারেনি। কারণ রকিব হাসানের লেখার মাঝে এতোটাই স্বকীয়তা আর সাবলীলতা ছিল যে প্রতিটা গল্পই নতুন মাত্রায়, ঠিক বাঙালি কিশোরদের মনের মত করে পাঠকের কাছে ধরা দিতো। আর তখন তো আমাদের কাছে ইংরেজি বইয়ের জগতটা এখনকার মত উন্মুক্ত ছিলো না, তাই তিন গোয়েন্দার রহস্যের জগতে ডুবে যেতে খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।
কাকাতুয়া রহস্যের মাথা ঘোরানো ধাঁধার জট কিংবা দক্ষিণের দ্বীপে মুক্তা খোঁজার অসাধ্য অভিযান, টেরর ক্যাসেল এর গা ছমছমে ভূতের রহস্য কিংবা জিনার সেই দ্বীপের টোড পরিবারের কাণ্ডকীর্তি, সোনালী জালের মাঝে বসা রূপালী মাকড়সা খোঁজার টান টান উত্তেজনা থেকে ভ্যাম্পায়ারের দ্বীপে এসে রক্তচোষা পিশাচের কবলে পড়া, প্রতিটা বই আমাদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছে বছরের পর বছর।