বিদ্যুৎ-জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ আইন বাতিলের প্রস্তাব সিপিডির
বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ আইন বাতিল করার প্রস্তাব করেছে সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)। বেসরকারি খাতের এই গবেষণা সংস্থা বলছে, আইনটি বাতিল করলে সরকারের ওপর থেকে বাড়তি ব্যয়ের চাপ কমবে। অন্যদিকে গ্রাহকরাও স্বস্তি পাবেন। একইসঙ্গে আগামী দিনের জ্বালানি ও বিদ্যুতের নীতি কাঠামো নবায়নযোগ্য জ্বালানির নীতি কাঠামোকে ভিত্তি ধরে করার সুপারিশ করেছে সিপিডি।
তবে নবায়নযোগ্য জ্বালানির খসড়া নীতিমালায় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে ক্লিন এনার্জি হিসেবে অন্তর্ভুক্তির যে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা থেকেও সরে আসার আহ্বান জানিয়েছে সিপিডি।
বৃহস্পতিবার 'নতুন নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতি-২০২২ (খসড়া): এটি কি পরিচ্ছন্ন জ্বালানির লক্ষ্যপূরণ করতে সক্ষম হবে' শীর্ষক মিডিয়া ব্রিফিংয়ে এসব কথা বলেছেন সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সিপিডির নিজস্ব কার্যালয়ে আয়োজিত ব্রিফিংয়ে নবায়নযোগ্য নীতি-২০২২, বাংলাদেশে এ ধরনের জ্বালানির প্রয়োজনীয়তা, সম্ভাবনা, অন্যান্য দেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতে কী ধরনের নীতি নিয়েছে তা নিয়ে আলোচনা করা হয়।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ২০০৯ সালে দেশে বিদ্যুৎ খাতের দুরবস্থা এবং ২০২২ সালের বিদ্যুৎ খাতের পরিস্থিতি ভিন্ন। ফলে বিদ্যুৎ জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ আইনটির আর প্রয়োজন নেই। এতে গ্রাহকের বাড়তি চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। অদক্ষভাবে বিভিন্নভাবে জ্বালানি বিদ্যুৎ উৎপাদন ও সরবরাহের জন্য সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। এ থেকে সরকারের সরে আসা দরকার।
সিপিডি মনে করে অনতিবিলম্বে এখান থেকে সরে আসতে হবে। এতে প্রতিযোগিতামুলক কাঠামো তৈরি হবে। বিদ্যুৎ খাতের অপচয়, বাড়তি ব্যয় সমন্বয় হচ্ছে ভোক্তার ওপর চাপিয়ে দিয়ে। কিন্তু এর কারণ হচ্ছে বিপুল পরিমাণে ক্যাপাসিটি চার্জ। নো ইলেকট্রিসিটি, নো পেমেন্ট পদ্ধতিতে গেলে এই বাড়তি ভর্তুকি দিতে হত না।
গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি রাজনৈতিক ও সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছে নীতিগতভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে। তবে বাস্তবায়ন পর্যায়ে ঘাটতি রয়েছে। জ্বালানি নিরাপত্তা কতটা দক্ষতার সাথে হচ্ছে, সরকারের আর্থিক দায়ভার কতটা বাড়িয়ে দিচ্ছে এ বিষয়ে আরও পর্যালোচনা দরকার। বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতে যেসব চুক্তি হচ্ছে সেগুলো কতটা স্বচ্ছতা ও দক্ষতার সাথে হচ্ছে তার ওপর নির্ভর করছে সমন্বিত জ্বালানি ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা।
সিপিডি বলছে, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালা প্রাসঙ্গিক উদ্যোগ। এটিকে ২০০৮ সালের নীতিমালার সংশোধন বলা ঠিক হচ্ছে কি না তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে সিপিডির। তবে এই নীতিমালার লক্ষ্য ঠিক আছে বলে মনে করে সংস্থাটি। এই নীতিমালায় সৌর বিদ্যুৎ, বায়ু বিদ্যুৎ, জলবিদ্যুৎ, হাইড্রোজেন পাওয়ারসহ নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়ে অগ্রসর চিন্তাভাবনা আছে। যার আলোকে একটি মাস্টার প্লান তৈরি করা হবে। নীতিমালায় ২০২৫ সালের মধ্যে বিদ্যুতের মোট চাহিদার ১০ শতাংশ নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে পাওয়ার আশা করা হয়েছে। একইভাবে ২০৩০ সালের মধ্যে ২০ শতাংশ এবং ২০৪০ এর মধ্যে ৪০ শতাংশ বিদ্যুৎ আসবে এ খাত থেকে। এই টার্গেটিং ইতিবাচক মনে করে সিপিডি। তবে অতি উচ্চ টার্গেটিং যাতে না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখার সুপারিশও করেছে সংস্থাটি।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক বলেন, নীতিমালায় প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো উন্নয়নের উল্লেখ রয়েছে। যেটা ইতিবাচক। তিনি বলেন, সরকারের টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে (শ্রেডা) ১০০/২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার পাওয়ার প্লান্ট স্থাপনের অনুমোদন করার ক্ষমতা দেওয়া উচিত। শ্রেডাকে ফোকাল পয়েন্ট হিসেবে গড়ে তোলা উচিত। এর দক্ষতা বাড়াতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির ৩৬টি প্রকল্প শ্রেডা অনুমোদন দিয়েছিলো। এরমধ্যে ৮টি প্রকল্প কার্যক্রমে আছে। বাকি ২৬টি প্রকল্প কার্যক্রমে নেই। অনেকে বিনিয়োগেই যায়নি। এটা দুঃখজনক। যারা বিনিয়োগে আগ্রহী তাদের সক্ষমতা যাচাইয়ের ব্যবস্থা করতে হবে।
তিনি বলেন, জরুরি প্রয়োজনের কথা বলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির মূল্য নির্ধারণে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) নখদন্তহীন করে ফেলা হয়েছে। দক্ষ ও টেকসই জ্বালানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে এটি দুর্বলতা।
তিনি বলেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নীতিমালায় কার্বন নির্গমনের প্রক্ষেপণ থাকা উচিত। বিনিয়োগ আকর্ষণের বিষয়ে পরিষ্কার কোনো উদ্যোগ নেই। এনার্জি স্টোরিং মার্কেট নিয়ে আলোচনা আছে। এটি ভালো। তবে আরও বিস্তৃত করতে হবে। বায়ু বিদ্যুতের বিস্তারিত তথ্য থাকা দরকার অর্থাৎ কোথায় বায়ু বিদ্যুতের সম্ভাবনা কতটা সে বিষয়গুলো থাকতে হবে। বায়োমাস, বায়োফুয়েল এর ক্ষেত্রে ফিজিবিলিটি স্টাডির দরকার আছে। এসব দিকে বাংলাদেশ কতটা যাবে সেটা দেখা দরকার। নবায়নযোগ্য জ্বালানি পার্ক বিষয়ে বলা হয়েছে। পার্ক হলে ট্রান্সমিশন লাইনে বিনিয়োগকারীদের জন্য ইতিবাচক।
নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য রেলওয়ের জমি, কৃষি কাজে অনুপযুক্ত বালুময় নদী অববাহিকা ব্যবহারের প্রস্তাব করেছে সিপিডি। পাশাপাশি এনার্জি অডিট চালুর প্রস্তাবও করেছে। কে কতটা এনার্জি ব্যবহার করছে, দক্ষতার সাথে ব্যবহার হচ্ছে কিনা, অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার হচ্ছে কিনা দেখার জন্য অডিটের প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এখনই হাইড্রোজেনভিত্তিক বিদ্যুতে যাওয়ার সময় কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে সিপিডি।
খসড়া নীতিমালায় ক্লিন এনার্জির মধ্যে কোল বেজড পাওয়ারকে নিয়ে আসা হয়েছে। সিপিডি মনে করে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসা দরকার। ক্লিন এনার্জির নাম করে যেসব টেকনোলজিকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে সেখান থেকে সরে আসতে হবে।
বিনিযোগকারীদের এ খাতে আকৃষ্ট করতে 'হাই ডেপ্রিসিয়েশন কস্ট' অনুমোদন করার প্রস্তাব করেছে সিপিডি। আর প্রতিযোগিতামুলক পরিবেশ সৃষ্টির জন্য অকশন বেজ সোলার প্রজেক্ট করার প্রস্তাব এসেছে।
খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, "যদি ফসিল ফুয়েল ব্যবহার নিরুৎসাহিত করা না হয়, তাহলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদন উৎসাহ পাবে না। বাসার ৪০ ওয়াটের লাইটের মত টিমটিম করে জ্বলবে। এজন্য ফসিল ফুয়েলের প্রণোদনা কমিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে প্রণোদনা বাড়াতে হবে।"