এক রুমের কারখানা থেকে এজি প্লাস্টিকের এখন দিনে উৎপাদন দুই লাখ পিস বোতল
শুরুটা ২০১২ সালের দিকে। জমানো কিছু টাকা বিনিয়োগ করে নগরীর সপুরা এলাকার বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প এলাকার ভাড়া একটা কক্ষে কারখানা স্থাপন। শুরুতে একটি মেশিন ও দুইজন কর্মচারী নিয়ে কারখানা চালু। তারপর আর ফিরে তাকাতে হয়নি। তরতর করে বেড়ে চলেছে ব্যবসা। প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে সোয়া দুই লাখ পিস বোতল উৎপাদন হয়। বিক্রি হয় গড়ে দুই লাখ পিস বোতল। দুইজন কর্মচারী থেকে এখন এ কারখানায় কাজ করেন শতাধিক কর্মচারী। দেশের বিভিন্ন স্থানে পাঠানো হয় কারখানায় উৎপাদিত প্লাস্টিকের বোতল। আকিজ ভেনচারের মতো প্রতিষ্ঠান এখান থেকে সরিষার তেল ও আচারের বোতল কিনে। ব্যবসার ক্রমাগত উন্নতির ফলে প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের একটা কারখানাও স্থাপন করেছেন এর উদ্যোক্তা। তার দাবি, দেশের শীর্ষ পাঁচটি প্লাস্টিক বোতল তৈরির কারখানার কথা এলে মানসম্মত পণ্য উৎপাদনের কারণে সেই তালিকায় তার প্রতিষ্ঠানের নাম থাকবে।
এজি প্লাস্টিকের কারখানায় প্রতিদিন কাঁচামাল লাগে ৫ থেকে ৬ মেট্রিক টন। যেখান থেকে প্রতিদিন গড়ে দুই থেকে সোয়া দুই লাখ পিস প্লাস্টিকের বোতল তৈরি হয়। বিক্রি হয় সিলেট, খুলনা, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, যশোর থেকে শুরু করে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায়। আগে বোতল তৈরির কাঁচামাল 'পেট রেজিন' ভারত, চীন, তাইওয়ান ও মালয়েশিয়া থেকে আমদানি করা হলেও ডলার সংকটের কারণে এলসি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এখন মেঘনা গ্রুপের কাছ থেকে কাঁচামাল ক্রয় করা হয়। এছাড়া এজি প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের আরেকটা কারখানায় প্রতিদিন এক মেট্রিক টন কাগজের কার্টন তৈরি করা হয়, যা স্থানীয় বড় বড় ইন্ডাস্ট্রিগুলো ক্রয় করে।
উদ্যোক্তার নাম আব্দুল গনি। এজি ইন্ডাস্ট্রির প্রোপাইটার। নিজের নামের আদ্যক্ষর থেকে 'এজি'। আব্দুল গনির ব্যবসায়ে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিলো না। পড়ালেখাও পরিসংখ্যান বিভাগে। তবে ব্যবসার মাধ্যমে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার ইচ্ছা ছিলো সবসময়। সে জায়গা থেকেই পড়ালেখা শেষ করার পর ব্যবসার দিকে ঝুঁকেন। রাজশাহী শহরে থেকে পড়ালেখা শেষ করে ফিরে যান বাঘা উপজেলার গ্রামের বাড়িতে। সেখানেই বাজারে বিভিন্ন মোবাইল অপারেটরের এজেন্সি নেন।
২০১১ সাল পর্যন্ত মোবাইল অপারেটরের ব্যবসায় ভালো কমিশন পেলেও তারপর থেকে অবস্থার অবনতি হতে শুরু করে। সেইসময় মোবাইল অপারেটর থেকে ৪০ লাখ টাকার মতো কমিশন পান। এরপর ২০১১ সালের শেষের দিকে এসে রাজশাহীতে পাকাপাকিভাবে বসবাস করতে শুরু করেন। রাজশাহীতে এসে তিনি আবার নতুন করে ব্যবসার কথা ভাবতে শুরু করেন। কিন্তু কোন ব্যবসায় নামবেন তা ভেবে পাচ্ছিলেন না। এজন্য তিনি ঢাকায় এক বন্ধুর কাছে যান। তাকে সাথে নিয়ে ঢাকার বিভিন্ন ধরনের কারখানা ঘুরে দেখেন। এরপর ঢাকার লালবাগে অবস্থিত প্লাস্টিক তৈরির কারখানা ঘুরে সিদ্ধান্ত নেন তিনি মানসম্মত বোতল তৈরির কারখানা করবেন। শুরু থেকেই প্রোডাক্টের গুণগত মান নিশ্চিত করতেন। একদম ভার্জিন 'পেট রেজিন' সংগ্রহ করে তা থেকে বোতল তৈরি করতে শুরু করেন গনি।
আব্দুল গনি জানান, ঢাকা থেকে ফিরে এসে কারখানা ও মার্কেট জরিপ করে দেখেন রাজশাহীতে প্লাস্টিকের বোতল তৈরির কোনো কারখানা নেই। আবার যেসব প্লাস্টিকের বোতল বাজারে চলে তার মানও ততটা ভালো না। তখন তিনি সিদ্ধান্ত নেন প্লাস্টিকের বোতল তৈরির কারখানা দিবেন। সে অনুযায়ী বিসিকে ভাড়া কক্ষে দুইজন কর্মচারী নিয়ে বোতল তৈরির কারখানা স্থাপন করেন। শুরুতে একটা মেশিন দিয়েই উৎপাদন করা শুরু হয়। উৎপাদিত পণ্য তিনি নিজেই বিভিন্ন কোম্পানির কাছে নিয়ে যান। তাদের কাছে বিক্রির চেষ্টা করেন। গুণগত মান ভালো হওয়ায় ধীরে ধীরে তার পণ্যের গ্রাহক বাড়তে থাকে। এখন তার কারখানায় ১৪টি প্লাস্টিকের বোতল তৈরির মেশিন রয়েছে। ৭২ জন লোক সেখানে কাজ করেন।
আব্দুল গনি জানান, তাদের কারখানায় দেড়শোর মতো ডিজাইনের বোতল তৈরি করা হয়। ৫০ মিলিলিটার থেকে শুরু করে ৫ লিটার সাইজের বোতল তৈরি করা হয়। সাইজ অনুযায়ী, তাদের প্রতি পিস বোতল বিক্রি হয় আড়াই টাকা থেকে শুরু করে ৩৬ টাকা পর্যন্ত। ভোজ্য তেল, ওষুধ, মধু, লাবাং, মাঠা, তারপিন, কসমেটিকসহ বিভিন্ন আচার জাতীয় পণ্য বিক্রিতে তাদের বোতল ব্যবহৃত হয়।
এজি প্লাস্টিকসে সম্পূর্ণ অটোমেটিক মেশিনে বোতল তৈরি করা হয়। খুচরা ও পাইকারি উভয় পদ্ধতিতে বিক্রি করা হয়। উৎপাদিত পণ্য গ্রাহকদের অর্ডার মোতাবেক কুরিয়ারের মাধ্যমে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছানো হয়। এমনকি পাঁচটি বোতল যিনি নিতে চান তাকেও ফেরান না তারা। তাদের ব্যবসায়িক মোটিফই ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের উৎসাহিত করা। রাজশাহীর প্রায় সব ইউনানী ও আয়ুর্বেদিক কারখানা তাদের বোতল ক্রয় করে। এর মধ্যে এসবি ল্যাবরেটরিজ, মুসলিম মেডি হেলথ, টিম ফার্মাসিউটিক্যালসের মতো প্রতিষ্ঠান বেশি প্রোডাক্ট ক্রয় করে। এজি প্লাস্টিকের ৩০০ জন লিস্টেড কাস্টমার রয়েছেন যারা প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের বোতল নেন। এদের মধ্যে রাজশাহীর এসবি ল্যাবরেটরিজ প্রতি মাসে গড়ে ১৫ লাখ টাকার বোতল ক্রয় করে। এছাড়া আকিজ ভেনচার গড়ে ২০ লাখ টাকার বোতল ক্রয় করে। এসিআই কোম্পানিও তাদের বোতল নেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করেছে বলে আব্দুল গনি জানান।
আব্দুল গনি জানান, 'যারা পাঁচ পিস বোতল নিতে চান আমরা তাদেরকেও ফেরাই না। আমরা মনে করি একদিন তারা ৫০০০ পিস বোতল নিবে। তবে খুচরা বোতল কিনতে সরাসরি তাদের কারখানায় যেতে হয়।'
ক্রমাগত ব্যবসা বৃদ্ধির কারণে সপুরার বিসিকে আব্দুল গনি দুইটি প্লট ক্রয় করেছেন। একটি প্লটে ২০১৯ সালে এজি প্রিন্টিং অ্যান্ড প্যাকেজিংয়ের কারখানা ও অফিস তৈরি করেন। অন্য প্লটে তার প্লাস্টিকের কারখানা। এখন তার প্যাকেজিংয়ের কারখানায় দৈনিক এক মেট্রিক টন কাগজ লাগে যেখান থেকে বিভিন্ন সাইজের কার্টন তৈরি করা হয়। এই কারখানায়ও প্রায় অর্ধশতাধিক লোকজন কাজ করেন। তার কারখানায় উৎপাদিত কার্টন স্থানীয় বড় বড় কোম্পানি ক্রয় করে।
পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও ব্যবসায় সফলতা পাওয়ার বিষয়ে আব্দুল গনি বলেন, 'আমার বাবা একজন কৃষিজীবী ও ব্যবসায়ী। যেসব ব্যবসা কেউ করেন না সে ধরনের ব্যবসার প্রতি তার ঝোঁক ছিলো। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি, সাতজন পার্টনারশিপে বাবা আমের ব্যবসা করছেন এবং তাদের মধ্যে কখনো গন্ডগোল হতে দেখিনি। পরে ব্যবসায় নেমে বুঝতে পেরেছি লিডারশিপ এবং স্বচ্ছতা থাকলে কখনো কোনো সমস্যা হবার কথা না। এছাড়া ব্যবসায় হিসাব রাখাটাও গুরুত্বপূর্ণ। পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে হিসাব রাখার মাধ্যমেই উদ্যোক্তারা স্বচ্ছ হয়ে উঠেন। ছোটবেলা থেকেই বাবার ব্যবসার হিসাব খাতা লিখতে হতো। এছাড়া যখন রাজশাহী শহরে মেসে থেকে পড়াশুনা করেছি তখনও মেসের মিল চালানোর ম্যানেজার ছিলাম। তখনও সবচেয়ে কম খরচে কিভাবে উন্নতমানের খাবার মেসমেটদের দেওয়া যায় সেটাই চিন্তা করে বাস্তবায়ন করেছি। কাজ যতো ছোটই হোক না কেন, আমি সবসময় তা সৃজনশীলভাবে করতে চেয়েছি। এসব অভিজ্ঞতা আমার কাজে লেগেছে বলে মনে হয়।'
আব্দুল গনি জানান, 'আমরা যারা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী তাদের ঋণ পাওয়া থেকে শুরু করে নানা ধরনের সমস্যায় পড়তে হয়। বিসিক থেকে একটি এনওসি না দেওয়ায় ব্যাংক থেকে আমার ঋণ আটকে আছে। ব্যবসা যেভাবে বড় হচ্ছে সে অনুযায়ী বড় প্লট পাওয়া যাচ্ছে না। আমার যে দুইটা ফ্যাক্টরি, একটি বড় প্লট পেলে সেখান থেকেই কাজ চালানো সম্ভব। কিন্তু প্লট না পাওয়ায় আমাকে দুই জায়গা থেকে অপারেট করতে হচ্ছে। এজন্য খরচও বেশি পড়ছে। আবার প্লট ছোট হওয়ায় কারখানায় কর্মীবান্ধব পরিবেশ তৈরি করা সম্ভব হচ্ছে না। আবার এক্সিট পয়েন্টও বের করা সম্ভব হচ্ছে না। ভেবেছিলাম বিসিক শিল্পনগরী-২ এ যে প্লট তৈরি করা হয়েছে তাতে শিফট করবো। কিন্তু প্লটের যা দাম রাখা হয়েছে তা সারাদেশের তুলনায় বেশি।'
রাজশাহীর বিসিকের শিল্পনগরী কর্মকর্তা আনোয়ারুল আজিম জানান, 'এজি প্লাস্টিকের ব্যবসা ক্রমান্বয়ে প্রসার হচ্ছে। তারা মানসম্মত পণ্য তৈরি করায় দ্রুত কাস্টমারদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। তাদের আরো জায়গা প্রয়োজন সত্ত্বেও আমরা তা দিতে পারছি না। যদিও চেষ্টা করছি তাদের বড় প্লট দেওয়ার বিষয়ে।'