মানুষের স্থান-কালের ধারণাকে যেভাবে ভিন্ন করে তোলে প্রতিটি ভাষা
আমরা যে ভাষায় কথা বলি, সে ভাষাতেই ভাবি। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, এক ভাষার মানুষ কোনো মূর্ত বা বিমূর্ত বস্তুকে যেভাবে উপলব্ধি করে, অন্য ভাষার মানুষ কি একই বিষয়কে ভিন্নভাবে দেখে? ভাষার সঙ্গে স্থান ও কালের দর্শনের ধারণা নিয়ে এমন প্রশ্নের উত্তর দিয়েছে বিবিসি।
স্থান ও কাল নিয়ে পদার্থবিজ্ঞানে জটিল সব তত্ত্ব দিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের এ দুটি মাত্রা নিয়ে কাজ করছেন ভাষাতাত্ত্বিক, মনোবিজ্ঞানীরাও। আর তাদের গবেষণায় দেখা গেছে, আমরা যেভাবে স্থান ও কালকে দেখি বা বিবেচনা করি, তার ওপর প্রভাব রাখে আমাদের ভাষা।
কোনো কিছু নিয়ে চিন্তা করার ব্যাপারটা কি বৈশ্বিক এবং এ চিন্তা ভাষা থেকে মুক্ত নাকি আমরা যে ভাষায় ভাবি, আমাদের চিন্তা সে ভাষাই গড়ে দেয়? এ প্রশ্নটি নিয়ে বিতর্ক রয়েছে বিজ্ঞানীমহলে।
কিছু গবেষক মনে করেন, আমাদের চিন্তাপ্রক্রিয়া পুরোপুরি ভাষা দ্বারা নির্ধারিত হয়। কিন্তু আরেকদল বিজ্ঞানী একইসঙ্গে এটাও মনে করেন যে, আমাদের মননের ক্ষমতা আমাদের ভাষার বিকাশকে গড়ে দেয়। এটাকে তারা দ্বিমুখী প্রক্রিয়া হিসেবে দেখেন।
ভাষাবিদ, নিউরোসায়েন্টিস্ট, মনোবিজ্ঞানী ও অন্য বিশেষজ্ঞরা কয়েক দশক ধরে ভাষা আমাদের চিন্তাভাবনাকে কীভাবে প্রভাবিত করে তা নিয়ে গবেষণা করছেন। এ বিষয়ের একজন প্রখ্যাত গবেষক ও কগনিটিভ সায়েন্টিস্ট লিরা বরোডিটস্কি।
বরোডিটস্কি তার গবেষণায় দেখিয়েছেন, ইংরেজরা সময়কে সমতল লাইন হিসেবে দেখেন। সেজন্য ইংরেজি ভাষায় সময়কে 'আগে' বা 'পরে' নেওয়া হয়। যেমন ইংরেজরা কোনো মিটিং এগিয়ে আনেন (ফরোয়ার্ড) বা ডেডলাইন পেছান (ব্যাক)। এছাড়া তারা সময়কে দেখেন বাঁ থেকে ডানে যাওয়া একটি ধারণা হিসেবে।
এর খুব সম্ভাব্য কারণ, ইংরেজি ভাষা বাম দিক থেকে ডানে লেখা হয়। অন্যদিকে ইহুদিভাষীরা লেখা ও পড়া; দুটোই ডান থেকে বামে করেন। এজন্য ইহুদিদের কাছে সময়ের গতি ডান থেকে বামে। একজন ইহুদিকে কোনো কিছু সাজাতে বললে তিনি ডান থেকে বামেই সাজাবেন।
আরেকটি উদাহরণ দেওয়া যাক। মান্দারিন ভাষা বলা লোকেরা আবার সময়কে দেখেন উল্লম্বভাবে। এক্ষেত্রে অতীত থাকে ওপরে, আর ভবিষ্যৎ নিচে। তাদের ভাষায় ভবিষ্যৎ বোঝাতে তারা আক্ষরিকভাবে 'নিচু' (ডাউন) শব্দটি ব্যবহার করেন। অর্থাৎ, একজন মান্দারিন পরবর্তী সপ্তাহে বোঝাতে গেলে সেটাকে 'ডাউন উইক' হিসেবে বর্ণনা করেন। আর সময়ের এরকম ওপর-নিচ দৃষ্টিভঙ্গির কারণ হলো ঐতিহ্যগতভাবে মান্দারিন ওপর থেকে নিচে বলা ও পড়া হতো।
ভাষার সঙ্গে সময়ের ধারণার এ সম্পর্ক আমাদের বোধশক্তি বা কগনিটিভ ক্ষমতার ওপরও প্রভাব ফেলে। কোনো তথ্য যদি ব্যক্তির মাতৃভাষার সঙ্গে খাপ খায়, তাহলে সেটি ব্যক্তি দ্রুত অনুধাবন করতে পারেন।
কিন্তু যেসব মানুষ একাধিক ভাষায় দক্ষ তাদের ক্ষেত্রে স্থান ও কালের ধারণা কেমন? যুক্তরাজ্যের ল্যাংকাস্টার ইউনিভার্সিটির ভাষাবিদ প্যানোস আথানাসপোলাস বলেন, দ্বিভাষিক ব্যক্তি যদি তাদের ভাষা পরিবর্তন করার সঙ্গে তাদের আচরণও পরিবর্তন করে ফেলেন, তাহলে ভাষার সঙ্গে অবধারণগত ক্ষমতার একটি কার্যকারণ সম্পর্ক স্থাপন করা সম্ভব।
গবেষণায় দেখা গেছে, সিঙ্গাপুরে বাস করা যেসব মানুষ মান্দারিন ও ইংরেজি জানেন, তারা সময়কে বাঁ থেকে ডানে চিন্তা করাটাই পছন্দ করেন। আবার অনেক সময় ভিন্ন পরিবেশে তাদের সময়ের ধারণা মান্দারিনের মতো হয়ে যায়। এ থেকে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন, যেসব মানুষ কম বয়স থেকে দুটি ভাষা শিখতে শুরু করেন, তারা হয়তো সময়ের গতিকে দুটি দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেন।
ইংরেজিসহ আরও অনেক ইউরোপীয় ভাষায় অতীতকে পেছনে আর ভবিষ্যৎকে সামনে হিসেবে দেখা হয়। যেমন সুইডিশ ভাষায় ভবিষ্যৎকে বলা হয় 'ফ্র্যামটিড'। এটির আক্ষরিক অর্থ 'সম্মুখ সময়'। আবার বলিভিয়া, চিলি, পেরু ও আর্জেন্টিনার আন্দিজ পর্বতমালায় বসবাসকারী আয়মারা জনগোষ্ঠী ভবিষ্যৎ বলতে 'পেছনের সময়'কে বোঝায়। এর পেছনে যুক্তি হলো, যেহেতু আমরা ভবিষ্যৎ দেখতে পাই না, তাই এটি বোধহয় আমাদের পেছনে অবস্থিত।
যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কগনিটিভ সাইকোলজিস্ট ড্যানিয়েল কাসাস্যান্টো বলেন, মানুষ সময়ের মাত্রা নিয়ে কথা বলতে স্থানের উপমা ব্যবহার করে। যেমন 'লম্বা' মিটিং বা 'ছোট' ছুটি। একসময় এ বিজ্ঞানী মনে করতেন, সময় নিয়ে মানুষের এ দৃষ্টিভঙ্গি বৈশ্বিক। কিন্তু গ্রিসে এ বিষয়ে একটি কনফারেন্সে পেপার উপস্থাপনের সময় স্থানীয় এক গবেষক তার ধারণাকে চ্যালেঞ্জ করেন।
এরপর নতুন করে গবেষণায় তার ভুল ভাঙে। দেখা যায়, গ্রিকরা সময়কে একটি ত্রিমাত্রিক সত্তা হিসেবে দেখেন। সেজন্য তাদের কাছে মিটিং 'লম্বা' না হয়ে 'বড়' হয়। বিরতি 'সংক্ষিপ্ত' না হয়ে 'ছোট' হয়। একই ব্যাপার সত্য স্প্যানিশদের জন্যও।
ভাষাগুলোর ব্যাকরণেও লুকিয়ে আছে সময়। ইংরেজিতে ভবিষ্যতের জন্য আলাদা একটি ব্যাকরণগত কাল রয়েছে। আবার জার্মান ভাষার ব্যাকরণে বর্তমান কাল দিয়েই ভবিষ্যৎ বোঝানো যায়, সেখানে ভবিষ্যৎ তৈরি করার দরকার হয় না। এ নিয়মটি মান্দারিনসহ আরও অনেক ভাষার জন্য প্রযোজ্য।
কিন্তু ভাষায় বর্তমান-ভবিষ্যতের এ ভিন্নতা কি আমাদের চিন্তাকেও প্রভাবিত করে? ২০১৩ সালে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের আচরণগত অর্থনীতিবিদ কিথ চেন এ প্রশ্নেরই উত্তর জানতে চান।
তার গবেষণায় দেখা যায়, যেসব ভাষার ব্যাকরণে ভবিষ্যতের ধারণা নেই, সেসব ভাষার মানুষের ভবিষ্যৎ-সম্পর্কিত কাজে অংশ নেওয়ার সম্ভাব্যতা বেশি। যেমন, অর্থ সঞ্চয়ের ক্ষেত্রে তারা তুলনামূলকভাবে শতকরা ৩১ ভাগ এগিয়ে। এরকম আরও দেখা যায়, তারা ধূমপানও কম করেন, শারীরিকভাবে সচল এবং স্থূলতাও কম।
ভাষা মননের ক্ষেত্র ছাড়িয়ে শারীরিক দুনিয়াতেও প্রবেশ করতে পারে। যেমন, অস্ট্রেলিয়া এক আদিবাসী গোষ্ঠী কোনো ছোটখাটো বিষয়ে দিক নির্দেশ করতে চাইলে পরম প্রসঙ্গ কাঠামো ব্যবহার করেন। যেমন তারা বলেন, 'কাপটা তোমার হাতের দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে আছে। আবার অনেক ভাষায় স্থান নির্দেশ করতে 'সামনে', 'পেছনে' ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। এক্ষেত্রে প্রসঙ্গ কাঠামো একাধিক হয়।
অনেক ভাষার মানুষ পারিপার্শ্বিক অবস্থার চেয়ে ঘটনাকে বেশি প্রাধান্য দেন। এর উল্টোটা ঘটে অন্য কিছু ভাষাভাষী গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে। যেমন, একটি ঘটনা বর্ণনা করতে কোনো ইংরেজিভাষী যদি বলেন, 'একজন মানুষ হাঁটছে', তাহলে একই ঘটনা বর্ণনা করতে একজন জার্মান বলবেন, 'একজন মানুষ একটি গাড়ির দিকে হেঁটে যাচ্ছে'।
স্থান, কালের সঙ্গে ভাষার যোগাযোগ নিয়ে গবেষণা ক্রমশ বাড়ছে। তবে এর মানে এমন নয় যে একটি ভাষার চেয়ে আরেকটি ভাষা তুলনামূলকভাবে 'ভালো'। ভাষা ব্যবহারকারীর চাহিদা থেকেই বিকশিত হয়।
তবে ভাষা কীভাবে পার্থক্য তৈরি করে তা নিয়ে জানা থাকলে সেটি আপনার চিন্তায়, যোগাযোগে বেশ সাহায্য করবে। আর নতুন আরেকটি ভাষা শিখতে পারলে আমরা বিশ্বকে নিয়ে নতুন একটি দৃষ্টিভঙ্গিও অর্জন করতে পারব।