বেশি টাকা মানেই কি বেশি সুখ, বেশি আনন্দ?
মানুষ টাকার পেছনে ছুটছে, মানুষ সুখের পেছনে ছুটছে। তাহলে কি 'টাকা' 'সুখের' সমার্থক? যার টাকা আছে, সেইই কি সুখী? নতুন একটি জরিপ এর উত্তর দিয়েছে; জরিপটি বলছে, বেশি টাকা মানে বেশি সুখ, বেশি আনন্দ। টাকাই পারে মানুষকে কল্যাণ দিয়ে ভরিয়ে দিতে। যদি তাই হয়, তবে টাকাওয়ালা অনেক মানুষ রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমাতে পারেন না কেন? ক্লাবে ক্লাবে ঘুরে অস্থির জীবনযাপণ করেন কেন? অনেক ধনী মানুষের সন্তান বখে যায় কেন? দাম্পত্য সম্পর্ক নষ্ট হয় কেন? সেইসব টাকাওয়ালা পরিবারে নারী ও শিশু নির্যাতিত হয় কেন? সর্বোপরি টাকা দিয়ে 'কল্যাণ ও শান্তি' কেনা যায় না কেন?
আসলেই কি টাকা সুখ কিনতে পারে? ২০১০ সালে নোবেল পুরস্কার জয়ী অর্থনীতিবিদ ও মনোবিজ্ঞানী ড্যানিয়েল কাহনিম্যান একটি থিওরি দিয়েছিলেন যে টাকার একটি হ্যাপিনেস প্ল্যাটু বা সুখ অনুভব করার শক্তি রয়েছে। তবে সেটাও নিয়ন্ত্রিত। তিনি বলেছেন, একবার যদি কেউ বছরে ২৪ লাখ টাকা আয় করেন, এরপর তিনি যতোই আয় বাড়াক না কেন, সুখ কিন্তু সেই অনুপাতে বাড়বে না।
আবার ২০২১ সালে এসে সুখ বিষয়ক গবেষক ম্যাথিউ কিলিংসওয়ার্থ ভিন্নমত ব্যক্ত করে বলেছেন, টাকা দিয়ে সুখ বাড়ানো সম্ভব। এখানে কোন প্ল্যাটু থিওরি কাজ করে না। অনেক আলোচনার পর সম্প্রতি অবশ্য দুজনে মিলে 'পরস্পরবিরোধী কিন্তু সহযোগিতামূলক' একটি গবেষণা উপস্থাপণ করেছেন, যেখানে দুজনের মতই কিছু না কিছু মাত্রায় সঠিক।
এদের মধ্যে কিলিংসওয়ার্থ অবশ্য বেশি সঠিক। অধিকাংশ মানুষের ক্ষেত্রেই বেশি টাকা, বেশি সুখ বয়ে নিয়ে আসে। অবশ্য এর মধ্যে কিছু সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। যেমন- কেউ যদি চরমভাবে অসুখী থাকেন, তাহলে হয়তো আয় বাড়লে সুখ কিছুটা বাড়বে, কিন্তু আকস্মিকভাবে তা বন্ধও হয়ে যেতে পারে। মানুষের কিছু সমস্যা আছে, যা টাকা দিয়ে মেটানো সম্ভব নয়। তবে যারা সুখ ও দুঃখের একটি মাঝামাঝি অবস্থানে রয়েছেন, তাদের সুখ আয় বাড়ার মাধ্যমে কিছুটা হলেও বৃদ্ধি পায়। আর যারা বেশ সুখী মানুষ, তাদের সুখ অনেক গুণ বেড়ে যায় আয় বৃদ্ধি হলে।
অবশ্য আমাদের দেশে যারা কোটি কোটি টাকা মেরে দিয়েছেন, যারা ব্যাংক ফাঁকা করে ফেলেছেন, যারা লন্ডনে বা কানাডায় বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন, যারা গরীবের টাকা আত্মসাৎ করেছেন, যারা বনবাদার-নদী-পাহাড়-সরকারি সম্পত্তি দখল করেছেন তারা আসলে কতটা সুখী, এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে কোনো মতামত পাওয়া যায়নি।
অবৈধভাবে টাকা উপার্জনকারীদের অনেকেই হয়তো সুখী নন, অথচ সুখের ভান করেন। অনেকে টাকা আয় করেন, কিন্তু ভোগ করতে পারেন না। আবার কেউ কেউ টাকা আয় করে পারিবারিক কোন্দল ও লোভের শিকার হন। অবশ্য এমনও হতে পারে যে, কারো কারো কাছে যেকোনোভাবে অর্থ আয় আর সঞ্চয়টাই আনন্দের।
সাম্প্রতিক দুটি গবেষণার মূল কথাই হলো, সুখী হওয়ার জন্য হাজার কোটি টাকা, বিএমডাব্লিউ গাড়ি বা নিজের হেলিকপ্টার লাগে না। লাগে একটা নির্ভরযোগ্য আশ্রয়, নিরাপত্তা ও জীবনের স্থিতিশীলতা।
একজন মানুষের চাহিদা, সন্তুষ্টি, ভালোমন্দের ধারণা, সুখ সবই বয়স ও দায়িত্বের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়। শৈশব-কৈশোরের সুখের সাথে অর্থের তেমন কোনো সম্পর্ক না থাকলেও শিশুর বেড়ে ওঠার ও সুখে থাকার জন্য নূন্যতম কিছু সুযোগ সুবিধা প্রয়োজন। যৌবনে সুখ ও টাকার সম্পর্ক যেমন থাকে, মধ্যবয়সে তা আরো বেড়ে যায়। নিজে সংসার শুরুর আগে চাহিদা একরকম থাকে, বিয়ের পরে চাহিদা স্বভাবতই বৃদ্ধি পায়। বৃদ্ধ বয়সে অবশ্যই টাকার সাথে সুখ-সুবিধা বেশি সম্পর্কিত থাকে।
তবে মার্কিন গবেষকরা বলেন যখন একজন ব্যক্তি বাবা-মা হয়ে যান, তখন তাদের 'প্যারেন্টটিং হ্যাপিনেস গ্যাপ'টাও বেড়ে যায়। সন্তানের পড়াশোনা, ডে-কেয়ার, খাদ্য, বিনোদন, পোশাক ইত্যাদির পেছনে যে ব্যয় করতে হয়, তাতে করে বাবা মা ব্যক্তিগত সুখ, আহ্লাদ কমাতে বাধ্য হন। বাংলাদেশের উচ্চবিত্তদের মধ্যে না হলেও মধ্যবিত্তদের মধ্যে এই সুখের পরিমাণ কমতেই থাকে। আর দরিদ্র বাবা-মায়ের জন্য সুখ বিষয়টাই অপরিচিত একটি বিষয়। কারণ শিশুর নূন্যতম অভাব অভিযোগও তারা মেটাতে পারেন না।
যাক অন্য একটি প্রসঙ্গে আসি, দেখি চীনা দার্শনিক, শিক্ষক ও রাজনীতিবিষয়ক তাত্ত্বিক কনফুসিয়াস হাজার হাজার বছর আগে সুখী জীবনের জন্য কী কী সূত্র দিয়েছিলেন। এরমধ্যে সবচাইতে শক্তিশালী একটি হচ্ছে 'যা আপনি নিজের জন্য প্রত্যাশা করেন না, তা অন্যের ক্ষেত্রে করবেন না'। সুখী হওয়ার জন্য তিনি যে পাঁচটি উপায়ের কথা বলেছিলেন, সেগুলো হচ্ছে সততা-ন্যায়পরায়ণতা, সদাচার-ভদ্রতা, দানশীলতা-মানবতা, জ্ঞান-শিক্ষা এবং বিশ্বস্ততা-আনুগত্য'।
বিগত কয়েকবছর ধরে সুখের আন্তর্জাতিক ইনডেক্সে সুখ পরিমাপ করা হচ্ছে। জনকল্যাণের সাথে জড়িত ছয়টি মূল বিষয়ের ওপর নির্ভর করে এই সুখের মান নির্ধারণ করা হচ্ছে এবং সেই দৌঁড়ে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। এই ছয়টি বিষয় হলো - আয়, স্বাধীনতা, বিশ্বাস, সুস্বাস্থ্যসহ দীর্ঘায়ু, সামাজিক কল্যাণমূলক সহায়তা এবং সৌজন্য। আধুনিক বিশ্বে সুখ নির্ধারণের এই বৈশিষ্ট্যগুলোর সাথে খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে দেওয়া কনফুসিয়াসের সদগুণের কী অদ্ভূত মিল। এরমানে এইসব বৈশিষ্ট্য সর্বকালে সব সমাজের জন্যই প্রযোজ্য।
বাংলাদেশে রাষ্ট্র, সমাজ, পরিবার ও ব্যক্তিজীবনে সততার অভাব প্রকট হয়েছে, মানবতাবোধ কমতে কমতে প্রায় নীচের দিকে, শিল্প, জ্ঞান ও শিক্ষায় আমরা পিছিয়ে পড়ছি। অন্যদিকে, দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে, জিডিপি বাড়ছে, ফরেন রিজার্ভ বাড়ছে। দেশে কোটিপতিও বাড়ছে দ্রুতগতিতে। ব্যাংকিং খাতে মোট আমানতের অনেকটাই কোটিপতিদের দখলে। কোটিপতির সংখ্যা দিয়ে যদি সুখ অর্জিত হতো, তাহলে বাংলাদেশ সুখী দেশগুলোর শীর্ষেই থাকতো।
অর্থনীতি বিষয়ক বিশ্লেষকরা বলেন, দেশে অর্থনীতির আকার ক্রমেই বড় হচ্ছে। প্রতিবছরই বাড়ছে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ও মাথাপিছু আয়। তবে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গুণগত মান না বাড়ায় সমাজের একটি শ্রেণির কাছেই বেশি সম্পদ ও অর্থ কেন্দ্রীভূত হয়ে পড়ছে। আর দেশের অধিকাংশ মানুষ জীবন-জীবিকার টানাপোড়েনে খাবি খাচ্ছে। মধ্যবিত্তরা দরিদ্র হচ্ছে, দরিদ্ররা দরিদ্রতর হচ্ছে। ঠিক এই জায়গায় এসে দেশের প্রবৃদ্ধি ধাক্কা খাচ্ছে।
বাংলাদেশে ধনীরা যেভাবে আরো ধনী হচ্ছে, বাকি জনগণের পকেট কিন্তু সেভাবে ভরছে না। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ইব্রাহীম খালেদ সাহেব এক মন্তব্যে বলেছিলেন, উন্নয়ন তো হচ্ছে, যে প্রবৃদ্ধির কথা সরকার বলছে, সেটিও হচ্ছে। কিন্তু এই জিডিপি থেকে যে টাকা আসছে, তার সুষম বণ্টন হচ্ছেনা। যে জাতীয় আয় যোগ হচ্ছে, তা শতকরা মাত্র ৫ জন মানুষের হাতে আসছে। সেই পাঁচ ভাগ মানুষ প্রতিবছর আরো বড়লোক হচ্ছেন। বাকি ৯৫ শতাংশের কাছে সেই টাকা আসছে না, অর্থাৎ টাকা ওপর থেকে নীচের দিকে নামছে না।
ইব্রাহিম খালেদ আরো বলেছিলেন, নরওয়ে, ডেনমার্ক, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড হলো সুষম বণ্টনের দেশ। সবচেয়ে অসম বণ্টনের দেশ হলো আমেরিকা। আমরা আমেরিকার মডেল অনুসরণ করছি বলে গরীব আরো গরীব হচ্ছে। এই কথার সূত্র ধরেই তাই হয়তো দেখতে পারছি সুখী দেশগুলোর তালিকায় সুষম বণ্টনের দেশগুলো এগিয়ে থাকলেও, আমেরিকা ধনী দেশ হওয়া সত্ত্বেও এর অবস্থান নীচের দিকে, কারণ সেখানে সম্পদের বণ্টন অসম।
সম্পদের অসম বণ্টনের কারণেই সমাজের একটা ক্ষুদ্র অংশের হাতে অনেক টাকা থাকে এবং তাদের জীবন চরম ভোগবাদিতায় পূর্ণ হয়। কিন্তু সেখানে সুখ থাকে খুব সামান্য। কারণ ভোগ করা মানেই সুখ অনুভব করা নয়। অন্যদিকে, বড় একটি অংশের হাতে অর্থ না থাকা বা কম থাকা সমাজে ভয়াবহ রকমের অসন্তোষ তৈরি করে। অধিকাংশ মানুষের অপ্রাপ্তি, দু:খ, কষ্ট, ক্ষোভ ও আশাহীন জীবন - একটি সমাজ ও দেশকে সুখী বানাতে পারেনা। সম্পদের অসম বণ্টনের কারণে দেশের অধিকাংশ নাগরিক যখন অসুখী হন, তখন তা মেটানোর দায়িত্ব সরকারেরই নেয়া উচিত এবং এটাই সুশাসনের লক্ষণ।
রাষ্ট্র এবং ব্যক্তিজীবনেও আমাদের চাহিদার লাগাম টানা দরকার। আমাদের অতৃপ্ত আত্মা যদি প্রতিনিয়ত জীবনকে চালিত করে, তাহলে সুখ কখনোই আসবে না ব্যক্তিজীবনে ও সমাজে। সুখী মানুষের জামা গায়ে দেওয়া একজন মানুষ বলেছিলেন, "সুখী হতে চাইলে উপরের দিকে দেখবে না। মানুষের কী আছে, তা নিয়ে ভাববে না, ভাববে তোমার চাইতেও অনেক কম কিছু নিয়ে মানুষ বেঁচে আছে। দেখার চেষ্টা করবে, তোমার চেয়েও কষ্টে আছে অসংখ্য মানুষ, যুদ্ধ করে তারা জীবন চালিয়ে নিচ্ছে। সেই দিকে তাকালে নিজেকে সুখী মনে হবে। এই সুখী মানুষের জামা পরা মানুষটি আর কেউ নন, আমার বাবা।"
আমেরিকান বিজনেস ম্যাগনেট ও অ্যাপলের সহ-প্রতিষ্ঠাতা স্টিভ জবস তার মৃত্যুর ছয় বছর আগে, সুখ কী এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন- "তোমার সময় সংক্ষিপ্ত, তাই অচেনা এক জীবন যাপন করতে গিয়ে এই সময় নষ্ট করো না।" তিনি বলেছিলেন, নিজের প্রিয় কাজ করতে পারলে বেঁচে থাকার প্রেরণা পাওয়া যায়, যা আমাদের পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নতুন উদ্যমে কাজ শুরু করতে সাহায্য করে। জীবনে সুখী হওয়ার জন্য নিজেকে প্রশ্ন করা উচিত যে, আমি যেরকম জীবন চাইতাম সেরকমই জীবনযাপন করছি কিনা? যে কাজ করতে চাইতাম, সেটাই করছি কিনা?
মৃত্যুর মুখোমুখি হয়ে স্টিভ জবস বলেছিলেন, "মৃত্যুর মুখোমুখি হলে আমাদের ভয়, ব্যর্থতা, গর্ব সবকিছু কেটে যায়; থাকে শুধু সেই জিনিস যা সত্যিই দরকারি। আপনার যে ভূমিকা পালন করার কথা ছিল তা কি আপনি করছেন?"
হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউয়ে প্রকাশিত গবেষণায় দেখা গেছে, কাজের মধ্যে থাকতে চাইলে এবং সুখী থাকতে চাইলে, সবার আগে আমাদের বিশ্বাস করতে হবে, আমার কাজটা গুরুত্বপূর্ণ এবং আমার কাজের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ কোনো উদ্দেশ্য হাসিল হতে পারে। তাই শুধু টাকা আয় করার মধ্য দিয়ে সুখকে খুঁজে বের করার পথ থেকে সরে আসতে হবে। টাকা একটি বড় শক্তি, কিন্তু সুখে থাকার জন্য কেবল এই শক্তি থাকলেই চলে না।
আর তাই অসংখ্য অপ্রাপ্তির ভেতরে বসবাস করেও যখন দেখি, জীর্ণ বস্তিতে বসে মা তার সন্তানকে বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করছেন, একজন প্রতিবন্ধী মানুষ আয় করছেন, দৃষ্টি প্রতিবন্ধী মেয়েটি সবকিছুকে পরাজিত করে বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখতে পারছেন, রিকশাচালক বাবা কষ্ট করেও তার সন্তানকে ডাক্তার বানাতে পারছেন- তখন বিশ্বাস করি ভয়, ব্যর্থতা, গর্ব সবকিছুই কেটে যায়; থাকে শুধু সেই জিনিস যা সত্যিই দরকারি, আর এর নামই সুখ।
- লেখক: যোগাযোগকর্মী
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।