স্বাস্থ্যে বড় সংস্কারের পরিকল্পনা, ৫ বছরে ব্যক্তির নিজ পকেটের চিকিৎসাব্যয় ২৯% কমানোর লক্ষ্য
চিকিৎসায় ব্যক্তির নিজের পকেট থেকে ব্যয় আগামী পাঁচ-ছয় বছরে ২৯ শতাংশ কমিয়ে আনতে চায় স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়। ব্যাপক সংস্কার ও বাজেট বরাদ্দ দ্বিগুণ বাড়িয়ে স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন কর্মসূচির মাধ্যমে এই কাজটি করতে চায় মন্ত্রণালয়।
ব্যক্তির নিজ পকেট থেকে স্বাস্থ্যসেবার খরচ (আউট-অভ-পকেট এক্সপেন্ডিচার) দেশের নিম্ন ও মধ্য-আয়ের মানুষের জন্য বড় ধরনের আর্থিক বোঝায় পরিণত হয়েছে। এ ব্যয়ের কারণে দারিদ্র্যের ফাঁদে আটকা পড়ছে তারা। ২০১২ সালে স্বাস্থ্যসেবার মোট খরচের ৬২ শতাংশ আসত ব্যক্তির নিজের পকেট থেকে, এখন তা বেড়ে ৬৯ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।
চলমান চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচির (এইচপিএনএসপি) জন্য বরাদ্দকৃত বাজেট ১ লাখ ৪৫ হাজার ৯৩৫ কোটি টাকা। পঞ্চম স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচির (৫ম এইচপিএনএসপি) জন্য এই বরাদ্দ বাড়িয়ে ২ লাখ ৯০ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
৫ম এইচপিএনএসপিতে নগর অঞ্চলের পিছিয়ে পড়া মানুষকে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ডাক্তার, নার্স ও অন্যান্য কর্মীর ঘাটতি কমিয়ে এবং বিনামূল্যে ৭০ শতাংশের বেশি অত্যাবশ্যক ওষুধের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করে গ্রামীণ স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোকে আরও উন্নত করতে চায় ।
মন্ত্রণালয় আগামী ছয় বছরের মধ্যে এসব সরকারি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রগুলোতে ৯০ শতাংশ চিকিৎসক ও নার্সের পদ পূরণ করতে চায়।
৫ম এইচপিএনএসপির খসড়া প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থাপনা উন্নত করবে এমন কিছু ক্ষেত্রে পদক্ষেপ নেওয়ার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
কর্মসূচিটির খসড়া রূপরেখা অনুসারে, এই ব্যবস্থাগুলোর মাধ্যমে মন্ত্রণালয় একটি স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে শিশু জন্ম নেওয়ার হার বাড়াতে এবং শিশু ও মাতৃমৃত্যুর হার কমাতে চায়।
বিদেশি অর্থায়নে চ্যালেঞ্জ
খসড়া প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৫ম এইচপিএনএসপির জন্য মোট বরাদ্দের ৪০ শতাংশ উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে নেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
৫ম এইচপিএনএসপির কৌশলগত বিনিয়োগ পরিকল্পনার অন্যতম পরামর্শদাতা ড. মোহাম্মদ আবদুস সবুর ৫ম এইচপিএনএসপি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে উন্নয়ন অংশীদারদের কাছ থেকে তহবিল পাওয়াটাকে মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
বিশ্বব্যাংকের কাছে ৯০০ মিলিয়ন ডলার তহবিল চাওয়া হয়েছিল। আর এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি) বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে যৌথভাবে ৫০০ মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকও (এডিবি) অন্তত ৫০০ মিলিয়ন ডলার অর্থায়ন করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
তবে উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে চাহিদা অনুযায়ী অর্থায়ন পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে অনিশ্চয়তা রয়েছে।
সূত্রমতে, ৫ম এইচপিএনএসপি বাস্তবায়নের জন্য বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে ৯০০ মিলিয়ন ডলার আর্থিক সহায়তা চাওয়া হলেও, বিশ্বব্যাংক স্বাস্থ্য সেবা বিভাগকে জানিয়েছে যে তারা ৩৫০ মিলিয়ন ডলার দেবে।
এ অবস্থায় অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগী সংস্থার কাছ থেকে চাহিদা অনুযায়ী অর্থায়ন পাওয়া যাবে কি না, তা নিয়েও অশ্চিয়তা রয়েছে বলে জানিয়েছে সূত্র।
পরিকল্পনাটির পরামর্শদাতা ড. সবুর বলেন, কর্মসূচিটিকে যদি শক্তিশালী দেখানো যায় এবং পারফরম্যান্স ভালো হয়, তবে দাতারা টাকা দেবে।
এছাড়া বাজেট বাস্তবায়নে দুর্নীতি ও অদক্ষতাও বড় চ্যালেঞ্জ। স্বাস্থ্য বাজেট প্রায়ই অনেকটা খরচ করা হয় না উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাজেট ঠিকমতো খরচ করতে পারলে উন্নয়ন সহযোগীরা অর্থ দেবে।
তিনি বলেন, উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকে প্রতিশ্রুতি প্রাপ্তি নির্ভর করবে চতুর্থ এইচপিএনএসপি বাজেটের বাস্তবায়ন এবং ব্যয়ের ওপর।
তবে ৪র্থ এইচপিএনএসপি বাজেটের কত টাকা এখন পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তথ্য দিতে পারেননি।
পাঁচ বছরে বাস্তবায়ন হবে
৫ম এইচপিএনএসপির মেয়াদ পাঁচ বছর—এটি শুরু হবে ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে। এর আওতায় ২০৩২ সালের মধ্যে সর্বজনীন হেলথ কাভারেজের লক্ষ্য এবং ২০৩০ সালের মধ্যে স্বাস্থ্য-সংক্রান্ত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যগুলো (এসডিজি) অর্জনের সুযোগটি কাজে লাগাতে হবে। যদিও সময় কম এবং এ লক্ষ্য অর্জনে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সর্বজনীন হেলথ কাভারেজ, স্বাস্থ্য ও পুষ্টি কর্মসূচিগুলোর বাজেট উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়াতে হবে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুদের মধ্যে বয়সের তুলনায় খর্বকায় ও ক্ষীণকায় হওয়ার প্রবণতা এবং অসংক্রামক রোগে ৪৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সি মানুষের মৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে চায়।
প্রতিবেদনে ৫ম এইচপিএনএসপি-র জন্য তিন ধরনের বাজেট বরাদ্দের প্রস্তাব করা হয়েছে—নিম্ন পরিস্থিতিতে (লো সিনারিও) ২ লাখ ৬২ হাজার ৫৪২ কোটি টাকা, মাঝারি পরিস্থিতিতে (মডারেট সিনারিও) ২ লাখ ৭৫ হাজার ৮২৭.২১ কোটি টাকা এবং আশাব্যঞ্জক পরিস্থিতিতে (অপটিমিস্টিক সিনারিও) ২ লাখ ৯০ হাজার ৩৭০.৪০ কোটি টাকা।
স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (পরিকল্পনা উইং) মো. জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, স্বাস্থ্য খাতের গুরুত্ব ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এই তিন ধরনের অর্থায়নের প্রস্তাব করা হয়েছে। এখান থেকে যেকোনো একটি চূড়ান্ত করবে সরকার।
বিশেষজ্ঞরা অবশ্য টিবিএসকে বলেছেন, শুধু বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোই কাঙ্ক্ষিত ফল অর্জনের জন্য যথেষ্ট হবে না।
তারা সরকারকে যথাযথ মনিটরিং নিশ্চিত করতে এবং স্বাস্থ্য কর্মকর্তাদের দুর্নীতিমুক্ত ও স্বচ্ছ উপায়ে অর্থ ব্যয়ের সক্ষমতা গড়ে তোলার সুপারিশ করেন।
বর্তমানে জেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালগুলোতে প্রায় ৬৪ শতাংশ চিকিৎসক এবং ৩৪ শতাংশ নার্সের পদ শূন্য রয়েছে। আর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এই হার যথাক্রমে ৮৩ শতাংশ ও ৭১ শতাংশ।
এই লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ৫ম এইচপিএনএসপির জন্য বাজেট বরাদ্দ দ্বিগুণ বৃদ্ধির প্রস্তাব করেছে।
দক্ষ জনবল তৈরির পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের
স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ১৯৯৮ সালে সেক্টর-ওয়াইড অ্যাপ্রোচ (সোয়াপ) গ্রহণ করে এবং ১৯৯৮ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে তিনটি সোয়াপ বাস্তবায়ন করে।
মন্ত্রণালয় বর্তমানে '৪র্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি সেক্টর কর্মসূচি' শীর্ষক চতুর্থ সোয়াপ বাস্তবায়ন করছে।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সব অংশীদারের সঙ্গে আলোচনা করে এবং তাদের মতামত নেওয়ার পর অনুমোদনের জন্য চার-পাঁচ মাসের মধ্যে খসড়া ৫ম এইচপিএনএসপি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদে (এনইসি) পাঠাবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, স্বাস্থ্য খাত অনেক বড়। ১৯৯৮ সালের আগে শত শত প্রকল্পে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ করা হয়। কিন্তু এই প্রকল্প পরিচালকদের মধ্যে কোনো সমন্বয় ছিল না, ফলে সম্পদ নষ্ট হচ্ছিল। ১৯৯৮ সালে সমগ্র স্বাস্থ্য খাতের সমস্যা সমাধানের জন্য একটি সেক্টরাল কর্মসূচির আওতায় বত্রিশটি অপারেশনাল পরিকল্পনা তৈরি করা হয়। এতে সম্পদের অপচয় কমে আসে।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. সৈয়দ আবদুল হামিদ মনে করেন, সেক্টরাল কর্মসূচি সঠিকভাবে কাজ করতে না পারায় এর পুরো সুফল পাওয়া যায়নি না।
তিনি টিবিএসকে বলেন, 'সেক্টরাল কর্মসূচি গ্রাম ভালো আইডিয়া ছিল। আমরা এর অর্ধেক সুফল পেয়েছি। কর্মসূচিটি ঠিকমতো কাজ করছে কি না, তা নির্ভর করে প্রকল্প পরিচালকদের যোগ্যতা, প্রশিক্ষণ এবং তাদের পর্যাপ্ত জনবল দেওয়া হয়েছে কি না এসবের ওপর। অর্থের পরিমাণ ঠিকমতো নির্ধারণ করা উচিত। কিন্তু দেখা যায়, পরামর্শদানের কার্যক্রম একজন ঠিক করেন, আর বাজেট বরাদ্দ করেন আরেকজন। কার্যক্রমের সঙ্গে বাজেটের সামঞ্জস্য থাকে না।'
অধ্যাপক হামিদ বলেন, স্বাস্থ্য খাতের প্রকল্প বাস্তবায়নে এ খাতে জ্ঞান থাকা ডাক্তারের প্রয়োজন। এ ধরনের দক্ষ জনবল তৈরি করতে বিসিএস স্বাস্থ্য শাখায় স্বাস্থ্য প্রশাসন ক্যাডার নিয়োগ দিতে হবে।
তিনি বলেন, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আনুষ্ঠানিকভাবে ৫ম এইচপিএনএসপিতে নগর স্বাস্থ্যসেবার দায়িত্ব নিচ্ছে, যা একটি ভালো সিদ্ধান্ত। এছাড়া ব্যক্তির নিজের পকেট থেকে স্বাস্থ্যব্যয় কমানোর পরিকল্পনাও রয়েছে।
এই অধ্যাপক আরও বলেন, 'ডিজিপির তুলনায় স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ অনেক কম। এছাড়া যে বরাদ্দ দেওয়া হয়, তা-ও ব্যয় করা সম্ভব হয় না। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৯ মাসে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগ বরাদ্দের মাত্র ১৫ শতাংশ অর্থ ব্যয় করতে পেরেছে, যা সর্বোচ্চ বরাদ্দ পাওয়া ১৫ মন্ত্রণালয় ও বিভাগের মধ্যে সর্বনিম্ন।'