জমি অধিগ্রহণ জটিলতায় থমকে আছে শরীয়তপুর-চাঁদপুর আঞ্চলিক সড়কের কাজ
অধিগ্রহণ জটিলতায় থমকে আছে শরীয়তপুর-চাঁদপুর আঞ্চলিক সড়কের চার লেন উন্নীতকরণ কাজ। প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়েও শেষ হয়নি ১৫ শতাংশ কাজ। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার সাথে চট্টগ্রামের সহজ যোগাযোগের এই পথে ভোগান্তিতে চলাচলকারীরা। তাছাড়া খানাখন্দের সড়কে ধীরগতির কারণে শিকার হচ্ছেন ডাকাতির।
জমি বুঝে না পেয়ে আর নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির কারণে এরই মধ্যে কাজ ছেড়ে চলে গেছে তিনটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। অথচ অলস পড়ে আছে ৩৭৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা! এই জটের সুরাহা জানা নেই সড়ক ও জনপথ বিভাগের তবে ঈদে যানবাহন চলাচল স্বাভাবিক রাখতে মেরামতের কাজ করার কথা জানিয়েছে সংস্থাটি।
সরেজমিনে দেখা যায়, শরীয়তপুর-চাঁদপুর আঞ্চলিক সড়কজুড়ে খানাখন্দ। অনেক আগেই উঠে গেছে কার্পেটিং। সেখানে জায়গা পেয়েছে ইটের সলিং। ভারি যানবাহন চলায় তৈরি হয়েছে বড় বড় গর্ত। আঁকাবাঁকা সরু সড়ক দিয়ে হেলেদুলে চলছে যানবাহন! ভয় আর আতংক নিয়ে সড়ক পাড়ি দিচ্ছেন যাত্রীরা। এমন সড়ক দিয়ে চলতে গিয়ে চালক আর যাত্রীর মধ্যে নিয়মিত হচ্ছে বাকবিতণ্ডা। দেখে বোঝার উপায় নেই সড়কটি তিন বন্দরের পণ্য আনা-নেয়ার সহজ পথ।
এই পথে ভোমরা ও বেনাপোল স্থল বন্দরের সাথে চট্টগ্রামের দূরত্ব ৭০ কিলোমিটারের কম। তাই পথটি বেছে নেন চালক ও ব্যবসায়ীরা। কিন্তু ৩১ কিলোমিটার সড়ক পাড়ি দিতে সময় লাগছে ৪ থেকে ৫ ঘণ্টা। ভাঙাচোরা সড়ক দিয়ে চলতে গিয়ে গাড়ির যন্ত্রাংশ নষ্ট হচ্ছে। বেড়ে যাচ্ছে তেল খরচ। ধীরগতিতে চলতে গিয়ে শিকার হতে হয় ডাকাতির; পথচারীরা হারাচ্ছেন জান-মাল।
শরীয়তপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্র জানায়, ২০১৯ সালের ১২ মার্চ একনেকের সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চার লেন সড়ক নির্মাণের জন্য ৮৫৯ কোটি টাকার প্রকল্প অনুমোদন দেন। ওই বছর জুনে প্রশাসনিক অনুমোদনের পর জমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম শুরু করে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসন।
৩১ কিলোমিটারের চার লেন সড়কের জন্য ২২৭ একর জমি অধিগ্রহণ করা হচ্ছে। ওই জমি ও জমির ওপর থাকা স্থাপনার মূল্য বাবদ সওজ বিভাগ থেকে ৪৩১ কোটি টাকা জেলা প্রশাসকের অনুকূলে দেয়া হয়েছে। কিন্তু গত ৪ বছরে জেলা প্রশাসন থেকে ওই সড়কের মাত্র সাড়ে ৪ কিলোমিটার অংশের ৪২ দশমিক ৫৫ একর জমি অধিগ্রহণ শেষ করে সওজকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। বাকি সাড়ে ২৬ কিলোমিটার সড়কের ১৮৪ দশমিক ৪৫ একর জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। জেলা প্রশাসন গত চার বছরে ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ৫৩ কোটি ৩২ লাখ টাকা খরচ করেছে। বাকি ৩৭৭ কোটি ৬৮ লাখ টাকা জেলা প্রশাসকের হিসাব নম্বরে জমা রয়েছে।
জমি অধিগ্রহণের পাশাপাশি সড়ক নির্মাণের জন্য দরপত্র আহবান করে ঠিকাদার নিয়োগ করার প্রক্রিয়া শুরু করে সওজ বিভাগ। চার লেন সড়কের জন্য জমি অধিগ্রহণ করা হলেও এখন ৩৩ ফুট প্রশস্ত করে দুই লেনের সড়ক নির্মাণ করা হবে। ওই সড়কের মধ্যে থাকা ৭টি কালভার্ট চওড়া করা হবে ও নতুন ১৭টি কালভার্ট নির্মাণ করা হবে। এ সকল কাজের জন্য সওজ ৪টি গুচ্ছ প্রকল্পে ৪টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে কার্যাদেশ দেয়। প্রকল্পের কাজটি শেষ করার জন্য প্রথম দফার মেয়াদ ছিল ২০২১ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু ওই সময়ের মধ্যে কোন কাজ না হওয়ায় তা আরও দুই বছর বাড়িয়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত করা হয়।
নরসিংহপুর ফেরিঘাট হতে চরসেন্সাস মাদবরকান্দি পর্যন্ত ৫ দশমিক ৯ কিলোমিটার সড়কের কাজ পায় মীর হাবিবুল আলম এন্ড রানা বিল্ডার্স নামের একটি প্রতিষ্ঠান। ওই প্রতিষ্ঠানটি দুই কিলোমিটার অংশ পর্যন্ত ইটের খোয়া দিয়ে বালু ভরাট করেছে। আর দুইটি কালভার্ট নির্মাণ করেছে। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটির সড়কে কাজের অগ্রগতি নেই বললেই চলে। তারাও কাজ ছেড়ে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে।
মীর হাবিবুল আলম এন্ড রানা বিল্ডার্স ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপক মিলন শেখ বলেন, '২০২০ সালে যখন কাজ বুঝে পেয়েছিলাম তখন জমি বুঝিয়ে দেয়া হলে এতো দিনে কাজ শেষ হয়ে যেতো। কিন্তু সাড়ে ৩ বছর ধরে বসেই আছি, জমি বুঝে পাচ্ছি না। জমি অধিগ্রহণ না হওয়ায় মানুষ টাকা না পেয়ে জমি ছাড়তেও রাজি হয় না। কাজ করতে গেলে আমাদের বাধা দেয়। কাজ বন্ধ করে দেয়। এর মধ্যে মালামালের দাম বেড়ে গেছে অনেক। এখন আমরা কিছু কাজ করেছি। আর অন্যরা তো চলেই গেছে। লোকসান দিয়ে কত দিন থাকা যায়!'
চট্টগ্রাম থেকে খুলনা যাওয়ার পথে কমফোর্ট পরিবহনের যাত্রী আমেনা বেগম সাথে কথা হয়। তিনি ক্ষোভের সাথে বলেন, 'এই রোড দিয়া যাইতে গেলে জীবনটা হাতে নিয়া যাইতে হয়। ফেরি পার হওয়ার পর থেকা মনে হয় গাড়ির মধ্যে ভূমিকম্প শুরু হয়ে গেছে। গাড়ি তো চলেই না। এক ঘণ্টার রাস্তা পার হইতে চার-পাঁচ ঘণ্টা লাগছে।'
ট্রাক ড্রাইভার আনোয়ার হোসেন বলেন, 'রাস্তা খারাপের কারণে গাড়ি আস্তে চালাতে হয়। রাতে গাড়িতে ডাকাতি হয়। মাল নিয়ে যায়। ধরে গাছের সাথে বেধে রাখে। আর রোডে বৃষ্টি শুরু হইলে কোথায় গর্ত কিছুই বোঝার উপায় নেই। প্রায়ই গাড়ি নিয়ে খাদে পড়ে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়। দেখছি দুই বছর ধরে রোডে শুধু কাজই হচ্ছে, কাজ তো শেষই হয় না।'
নোয়াখালি থেকে চুয়াডাঙ্গা যাচ্ছিলেন ট্রাকচালক লোকমান হোসেন। তিনি বলেন, 'এই রাস্তা দিয়ে গেলে আমাদের ৭০ কিলোমিটার রাস্তা কম হয়। বেনাপোল আর ভোমরা থেকে যতো মালামালের গাড়ি, পণ্যবাহী গাড়ি সবই এই রাস্তায় আসা-যাওয়া করতো। রাস্তার যে অবস্থা তেল খরচ আগের চেয়ে দ্বিগুণ। গাড়ির গিয়ার যত বার বদল হয় ততো বেশি তেল লাগে। তারপরও মাঝে মাঝে আসি। ঢাকা ঘুরে গেলে টোলের টাকা বেশি, আবার দূরত্ব বেশি। রাস্তাটা মেরামত হয়ে গেলে পণ্য আনা-নেয়ার জন্য এইটা আমাদের সহজ পথ।'
শরীয়তপুর সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ভূঁইয়া রেদওয়ানুর রহমান বলেন, 'টেন্ডার, ঠিকাদার নিয়োগসহ সব ধরনের কাজ প্রত্যাশী সংস্থা হিসেবে সঠিক সময়েই হয়েছে। অধিগ্রহণের অর্থও জেলা প্রশাসনকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। কিন্তু কেন দীর্ঘসূত্রিতা তা বোঝা যাচ্ছে না। জমি বুঝে না পেয়ে আবার নির্মাণ সামগ্রীর দাম বৃদ্ধির কারণে ঠিকাদাররা কাজ করতে অনীহা প্রকাশ করেছে। তবে সড়কটি সচল রাখতে এবং ঈদে ঘরমুখো মানুষের কথা বিবেচনায় নিয়মিত মেরামত কাজ করা হচ্ছে।'
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জেলা প্রশাসক মোঃ পারভেজ হাসান বলেন, 'রাস্তার অবস্থা অত্যন্ত খারাপ সেটা বুঝি। চারটি সংস্থা এই প্রকল্পের সাথে জড়িত। আসলে কোথায় সমস্যা তা এখনও বুঝে উঠতে পারছি না। দেরি হওয়ার কারণ বের করতে আমরা কাজ করছি। প্রকৃত সমস্যা বের করে তা দূর করে দ্রুত সময়ের মধ্যে শরীয়তপুর-চাঁদপুর আঞ্চলিক সড়কটির বিদ্যমান প্রকল্পের কাজ এগিয়ে নিয়ে যাবো।'