যথাযথ জমি অধিগ্রহণ ছাড়াই সুয়ারেজ প্রকল্প শুরুর অভিযোগ চট্টগ্রাম ওয়াসার বিরুদ্ধে
সম্প্রতি বন্দর নগরীর হালিশহরে চট্টগ্রাম ওয়াসার স্যুয়ারেজ প্রকল্পে যথাযথভাবে জমি অধিগ্রহণ করা হয়নি বলে অভিযোগ করেছেন প্রকল্প এলাকার জমির মালিকরা।
এ বিষয়ে জমির মালিকদের আবেদনের প্রেক্ষিতে চট্টগ্রামের একটি আদালত গত ৬ এপ্রিল পরবর্তী শুনানি না হওয়া পর্যন্ত প্রকল্পের কাজ স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন। এরপর ১১ এপ্রিল চট্টগ্রাম ওয়াসার কর্মকর্তারা আদালতে হাজির হয়ে তাদের যুক্তি উপস্থাপন করলে আদালত সরকারের ৩,৮০৮ কোটি টাকার অগ্রাধিকার প্রকল্পটি অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন।
একইসঙ্গে জমির ওপর বাদীর দাবি প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে তাদের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে উল্লেখ করে আদালত মামলার শুনানি অব্যাহত রাখার নির্দেশ দেন।
মামলায় চট্টগ্রাম ওয়াসা, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক ও পানি উন্নয়ন বোর্ডকে বিবাদী করা হয়েছে।
জমির মালিকদের পক্ষে মামলা দায়েরকারী সৈয়দ মুহাম্মদ এনামুল হক মুনিরী বলছেন, প্রয়োজনে মামলাটি নিয়ে হাইকোর্টে যাবেন তারা।
জমির মালিকদের তথ্যমতে, ১৯৬৩ সালে পানি সরবরাহ ও স্যুয়ারেজ প্রকল্পের জন্য চট্টগ্রাম নগরের হালিশহরে ১৬৪ একর জমি অধিগ্রহণ করেছিল পাকিস্তান সরকার। যা ১৯৬৭ সালে চট্টগ্রাম ওয়াসাকে হস্তান্তর করা হয়।
প্রকল্প বাস্তবায়িত না হওয়ায় ১৯৭০ সালের ৫ আগস্ট অধিগ্রহণকৃত জমির ১৩৪.১৪৫ একর জমি 'ডি-রিকুইজিশনের' আদেশ দেন চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক।
বাদী পক্ষের আইনজীবী ব্যারিস্টার আফরোজা আকতার দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "১৯৬৩ সালে এ জমি অধিগ্রহণ হয়েছিল। পরে তা 'ডিরিকুইজিশন' হয়েছিল। কিন্তু মালিকদের জমি ফেরত দেওয়া হয়নি। পরে ২০০১ সালে ভূমি মালিকরা হাইকোর্টে রিট করেন। ওই রিটের আদেশে হাই কোর্টে বলেছিল, এ অধিগ্রহণ যথাযথ হয়নি।"
পরে ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম ওয়াসা কর্তৃপক্ষের করা লিভ-টু-আপিল এর প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাই কোর্টের আদেশ বহাল রেখে আপিল নিষ্পত্তি করে।
"আপিল বিভাগের আদেশের পরও জোর খাটিয়ে ভূমি মালিকদের বঞ্চিত করে প্রকল্প শুরু করেছে ওয়াসা", বলেন ব্যারিস্টার আফরোজা আকতার।
এরমধ্যেই চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি সুয়ারেজ প্রকল্প বাস্তবায়নে দক্ষিণ কোরিয়ার কোম্পানি তাইয়ু ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি করে ওয়াসা কর্তৃপক্ষ।
ভুক্তভোগী জমির মালিকদের হয়ে মামলা করা ছৈয়দ মুহাম্মদ এনামুল হক মুনিরী দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "সুয়ারেজ প্রকল্প বাস্তবায়নে আমরা বিরোধিতা করছি না। কিন্তু উচ্চ আদালতের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ডি-রিকুইজিশনের আদেশ বাতিল করে আবার দখলে নেওয়া যাবে না।"
"নিয়মানুযায়ী আবার রিকুইজিশনের মাধ্যমে জায়গার মালিককে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। কিন্তু এ ধরনের কোনো উদ্যোগ চট্টগ্রাম ওয়াসা নেয়নি। বরং তারা জোর করে জায়গা দখল করতে চাইছে। জমির মালিকরা এত বড় অন্যায় কীভাবে মেনে নেবে?" প্রশ্ন রাখেন মুনিরী।
এনামুল হক মুনিরী জানান, শুরুর দিকে বিরোধপূর্ণ জায়গাগুলোর মালিক ছিলেন ৪০০ থেকে ৫০০ জন। কিন্তু বর্তমানে ৮ হাজারের মতো মালিক রয়েছেন। এই ১৬৩.৮৫৫ একর কৃষি জমির বিষয়ে চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত সেসব জমির বেআইনি ব্যবহার, অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ চট্টগ্রামের একটি আদালতে খতিয়ান সংশোধন ও নিষেধাজ্ঞার মামলা করেন তিনি।
মুনিরী আরও বলেন, আদালত মামলাটি গ্রহণ করে চট্টগ্রাম ওয়াসাসহ বিবাদীদের কারণ দর্শানোর আদেশ দিন। কিন্তু গত ৬ এপ্রিল ওয়াসা কর্তৃপক্ষ আদালতে হাজির না হওয়ায় আদালত প্রকল্পের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা দেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) প্রকৌশলী এ কে এম ফজলুল্লাহ বলেন, তারা এ বিষয়ে কোনো সমন পাননি।
তবে ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক সমন না পাওয়ার দাবি করলেও তার বরাবরে পাঠানো আদালতের সমনের রিসিভিং কপির একটি অনুলিপি এসেছে দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের হাতে।
প্রকল্পের সাথে জড়িত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলেছেন, পরবর্তী শুনানি না হওয়া পর্যন্ত প্রকল্পটি বন্ধ করার বিষয়ে আদালতের অন্তর্বর্তী আদেশ পাওয়ার পর তাদের প্রতিনিধি গত ১১ এপ্রিল আদালতে হাজির হন।
শুক্রবার দুপুরে উত্তর হালিশহরের চৌচালা ও মধ্যম হালিশহরের আনন্দবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, আদালতের নিষেধাজ্ঞার পরেও বন্ধ হয়নি ওয়াসার সুয়ারেজ প্রকল্পের কাজ। সাগর থেকে উত্তোলন করা বালি দিয়ে ভড়াট করা হচ্ছে একরের পর একর কৃষি জমি। চারটি স্ক্যাবেটর ব্যবহার করে জমি ভরাট করছে অর্ধশতাধিক শ্রমিক।
চৌচালা পাঁচঘর পাড়া এলাকার বাসিন্দা ও কৃষক মো. শফিউল আলম দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, ' প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে আমরা এই জমিতে ফসল ফলিয়ে জীবন ধারন করে আসছি। স্বাধীনতার আগে যে প্রকল্প বাতিল হয়ে গিয়েছিলো আজ সেই প্রকল্পের নাম দিয়ে আমাদের বাপ-দাদার জমি জমা কেড়ে নেওয়া হচ্ছে।'
আরেক কৃষক মো. আবদুর রহিম বলেন, "পৈত্রিকভাবে পাওয়া চার বিঘা জমিতে বেগুন ও পুঁইশাহ করেছি। কয়েকদিনের মধ্যেই ফসল ঘরে তুলতাম। এখন কখন এই ফসল মাটিতে ভরাট হবে সেই প্রহর গুনছি।"
"বেঁচে থাকার সেই একমাত্র সম্বলটি কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এ জমি হারালে আমার আত্মহত্যা ছাড়া উপায় থাকবে না। আমরা ক্ষতিপূরণ চাই।"
২০১৩ সালে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে চট্টগ্রাম নগরীর ড্রেনেজ ও স্যানিটেশন মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়নের কাজ শুরু হয়। মহাপরিকল্পনায় পুরো নগরীকে ছয়টি জোনে ভাগ করে ছয়টি পয়ঃশোধনাগার এবং দুটি ফিকাল স্ল্যাজ শোধনাগার স্থাপনের সুপারিশ করা হয়।
প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ের কাজ পায় দক্ষিণ কোরিয়ার তায়ং ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড কন্সট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড। জানুয়ারি মাসে তাদের সঙ্গে চুক্তি করে ওয়াসা। চলতি এপ্রিলে প্রকল্প এলাকায় মাটি ভরাটের কাজ শুরু করে ওয়াসা।