যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণ এশীয় চলচ্চিত্র কেন জনপ্রিয় হচ্ছে!
পারভেশ সিং চিনা যখন তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবে ২০০২ সালের 'বারবারশপ' চলচ্চিত্রে কাজ করার সুযোগ পান, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তখনো ৯/১১ আক্রমণের আতঙ্ক থেকে সেরে উঠছে। দেশটির নাগরিকদের মনে তখন ভিন্ন বর্ণের মানুষদের নিয়ে দানা বাঁধছে নতুন নতুন স্টেরিওটাইপ।
ভারতীয়-আমেরিকান অভিনেতা চিনা জানান, "আমরা আর ভালো স্বভাবের শ্বেতাঙ্গঘেঁষা আদর্শ সংখ্যালঘু রইলাম না, যেভাবে ছোটবেলায় আমাদেরকে ভাবা হতো। এর বদলে দক্ষিণ এশীয় আমেরিকানদের জন্য বরাদ্দ রাখা হলো 'চার নম্বর সন্ত্রাসী'র মতো স্টেরিওটাইপকৃত চরিত্র।" চিনা এরপর বহুবার ক্যামেরার সামনে ভারতীয় অ্যাকসেন্টে পারফর্ম করেছেন, যেটি তার মতে, 'শ্বেতাঙ্গদের জন্য মজার হলেও' দক্ষিণ এশীয়দের জন্য নয়।
পারভেশ সিং চিনার এরপর অন্য ধরনের চরিত্রে সুযোগ পেতে সময় লেগেছে দেড় দশক। ২০১৫ সালের টিভি সিরিজ ক্রেজি এক্স-গার্লফ্রেন্ডে অভিনয় করেছেন এক 'মিউজিক্যাল থিয়েটার নার্ড' হিসেবে, ২০২০ সালের এনবিসির সিটকম কানেক্টিংয়ে পেয়েছেন এক সমকামী ভারতীয় আমেরিকান বাবার চরিত্র। অবশেষে তিনি অনুভব করেছেন, তিনি সত্যিকারের কোনো দক্ষিণ এশীয় আমেরিকান অভিনেতা, কোনো একঘেয়ে স্টেরিওটাইপিকাল চিন্তা-ভাবনার চিত্রায়ন নন। তবে এই ধরনের সুযোগ খুব কমই পাওয়া যায়।
"কাহিনীর প্লটের মৌলিকত্ব এবং সঠিক রিপ্রেজেন্টেশন এখন অনেক গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ধরা হয়। আজ থেকে বিশ বছর আগে আমি কল্পনাই করতে পারতাম না যে আমি একইসাথে ভারতীয় আমেরিকান এবং অন্য কোনো বৈশিষ্ট্যের চরিত্রে অভিনয় করার সুযোগ পাবো।"
সাম্প্রতিক সময়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চলচ্চিত্রে দক্ষিণ এশীয়দের রিপ্রেজেন্টেশন নিয়ে নতুন করে আলোচনার জোয়ার শুরু হয়েছে, বিশেষ করে ঐতিহাসিক দুই অস্কার জয়ের পর। একটি প্রথম ভারতীয় চলচ্চিত্র হিসেবে 'দ্য এলিফ্যান্ট হুইস্পারার'-এর সেরা শর্ট ডকুমেন্টারি জয় এবং অন্যটি প্রথম ভারতীয় গান হিসেবে আরআরআর-এর 'নাটু নাটু' গানের সেরা মৌলিক গানের অ্যাওয়ার্ড জয়। আরআরআর এবং ওয়েডিং সিজন, দুইটি চলচ্চিত্রই নেটফ্লিক্সের মার্কিন অডিয়েন্সের সেরা ১০-এর তালিকায় উঠে এসেছে, আরআরআর সারাবিশ্বে আয় করেছে ১৬০ মিলিয়ন ডলার। এদিকে সানড্যান্স ফিল্ম শুরু হওয়ার ২০ বছর পর প্রথমবারের মতো দক্ষিণ এশীয় চলচ্চিত্র আলাদাভাবে প্রদর্শন করা হচ্ছে।
মূলত এই পুরস্কার জয়ের জোয়ার শুরু হয় গত বছর রিজ আহমেদের 'দ্য লং গুডবাই' সেরা লাইভ-অ্যাকশন শর্টফিল্ম এবং জোসেফ প্যাটের প্রযোজিত 'সামার অফ সৌল' সেরা পূর্ণদৈর্ঘ্য ডকুমেন্টারি জয়ের মাধ্যমে।
ইউনিভার্সিটি অফ ভার্জিনিয়ার মিডিয়া স্টাডিজের সহকারী অধ্যাপক শিল্পা ডেভের মতে, আগের জনপ্রিয় এবং অ্যাওয়ার্ড পাওয়া 'ভারতীয়' চলচ্চিত্রগুলোর চেয়ে এই নতুন জোয়ারের চলচ্চিত্রগুলো আলাদা। আটটি অস্কার জেতা 'স্লামডগ মিলিয়নেয়ার (২০০৮)' একটি 'ব্রিটিশ চলচ্চিত্র,' যার মূল কলাকুশলীদের প্রায় সবাই ছিলেন ইংরেজ শ্বেতাঙ্গ। তাছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে অস্কারের আন্তর্জাতিক ক্যাটাগরির বাইরে এসেও অন্যান্য অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে দক্ষিণ এশীয় চলচ্চিত্রের পুরস্কার জয়ও চোখে পড়ার মতো।
ব্রিটিশ-পাকিস্তানি অভিনেতা রিজ আহমেদ, যিনি 'দ্য লং গুডবাই'-এ অভিনয় করার পাশাপাশি এর চিত্রনাট্যও লিখেছেন, এর আগে আরও বেশ কিছু রেকর্ড গড়েছেন। ২০২১ সালের অস্কারেই 'সাউন্ড অফ মেটাল' চলচ্চিত্রের জন্য দ্বিতীয় ভারতীয় এবং প্রথম মুসলিম হিসেবে সেরা অভিনেতা ক্যাটাগরিতে নমিনেশন পেয়েছিলেন।
দশকের পর দশক ধরে অন্ধকারে থাকা দক্ষিণ এশীয় চরিত্রকেন্দ্রিক চলচ্চিত্রগুলো অবশেষে মূলধারায় স্বীকৃতি পেয়েছে । নব্বইয়ের দশকেও মিসিসিপি মাসালা (১৯৯১), ভাজি অন দ্য বিচ (১৯৯৩) এবং চাটনি পপকর্নের (১৯৯৯) মতো হলিউডে বড় আকারের বেশ কিছু দক্ষিণ এশীয় ডায়াসপোরা চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছিল, কিন্তু এর কোনটিকেই সেভাবে মূলধারার চলচ্চিত্র হিসেবে ধরা হতো না।
'ইন্ডিয়ান অ্যাকসেন্টস: ব্রাউন ভয়েস অ্যান্ড র্যাডিক্যাল পারফরম্যান্স ইন আমেরিকান টেলিভিশন অ্যান্ড ফিল্ম' বইয়ের লেখক শিল্পা জানান, "এই ধরনের রিপ্রেজেন্টেশন নতুন কিছু নয়। যে জিনিসটি পরিবর্তন হয়েছে তা হলো সামাজিক মাধ্যম। সামাজিক মাধ্যমের আলোচনার ফলে মানুষ হঠাৎ করে এই চলচ্চিত্রগুলোতে দক্ষিণ এশীয়দের উপস্থিতি টের পেয়েছে।"
যেমন: মিসিসিপি মাসালার প্লট নির্মিত হয়েছে একজন দক্ষিণ এশীয় নারী আর কৃষ্ণাঙ্গ পুরুষের সম্পর্ককে কেন্দ্র করে। মূল চরিত্রে মিরা নায়ারের পাশপাশি অভিনয় করেছিলেন অস্কারজয়ী অভিনেতা ডেনজেল ওয়াশিংটন। এদিকে চাটনি পপকর্নের মূল চরিত্র একজন ভারতীয় আমেরিকান সমকামী নারী, যিনি তার বড় বোনের বাচ্চাকে গর্ভধারণ করতে চান সারোগেট মা হিসেবে। এখনো এই সময়ে এসে এসব বিষয়ে ভালোভাবে আলোচনা করা হয় না, কিন্তু নব্বইয়ের দশকেই এসব বিষয়ে চলচ্চিত্র তৈরি করা হয়েছে।
মিসিসিপি মাসালার পরিচালক স্বয়ং মিরা নায়ার তার চলচ্চিত্রকে অভিহিত করেছেন এক "যুগান্তকারী চলচ্চিত্র হিসেবে, যেটি গত ৩০ বছরে কেউ ভাবেনি, যেমনটা তিনি ভেবেছেন কৃষ্ণাঙ্গ-বাদামি রোমান্টিক সম্পর্ককে নিয়ে।
তবে বাণিজ্যিকভাবে সফল সবগুলো দক্ষিণ এশীয় ডায়াসপোরা চলচ্চিত্রগুলোই যে সম্পূর্ণরূপে স্টেরিওটাইপ থেকে মুক্ত তা নয়। বেন্ড ইট লাইক বেকহ্যাম, মিসিসিপি মাসালা কিংবা নেটফ্লিক্সের ওয়েডিং সিজন, প্রত্যেকটিতেই দৃশ্যায়ন করা হয় এক জাঁকজমক বিয়ের। বিশেষজ্ঞদের মতে, দক্ষিণ এশীয় বিয়ের আয়োজনের প্রতি পশ্চিমা দর্শকদের মুগ্ধতার পরিচয় দেয় এটি, বিশেষ করে অ্যারেঞ্জড ম্যারেজের ধারণা নিয়ে তারা বেশ আগ্রহী।
শিল্পার মতে, "পশ্চিমারা অ্যারেঞ্জড ম্যারেজকে নেতিবাচক হিসেবে দেখে, এর মাধ্যমে তারা নিজেদের তুলনায় দক্ষিণ এশীয়দেরকে আলাদা মনে করে। একে অনেকটা রোমান্টিক বিরোধী প্রেম হিসেবে মনে করে তারা।"
রবি প্যাটেলের ডকুমেন্টারি 'মিট দ্য প্যাটেলস (২০১৪)' এবং কুমাইল নানজিয়ানির অস্কার-মনোনীত রোমান্টিক কমেডি 'দ্য বিগ সিক (২০১৭)'-এর মতো সাম্প্রতিক কিছু চলচ্চিত্রেও দক্ষিণ এশীয় বিয়ের ওপর আলোকপাত করা হয়েছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের অডিয়েন্সের কাছে চলচ্চিত্রগুলোকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে।
তবে গত কয়েক দশক ধরে চলা এই ধারার ফর্মুলা যে সবসময় মানা হয়েছে এমন নয়। এরকম এক নিখুঁত উদাহরণ হলো, গীতা মালিকের রোমান্টিক কমেডি 'ইন্ডিয়া সুইটস অ্যান্ড স্পাইসেস (২০২১)', যেখানে ভারতীয় আমেরিকানদের মধ্যে শ্রেণি বিভাজন তুলে ধরা হয়।
চলচ্চিত্রটির ভারতীয় আমেরিকান পরিচালক বলেন, "দক্ষিণ এশীয় ডায়াসপোরা চলচ্চিত্রগুলোতে পরিবারের মায়েদেরকে তাদের পারিবারিক ভূমিকাই পালন করতে দেখা যায়, এর বাইরে কিছু নয়। আমি এই ধারার বাইরে যেতে চেয়েছি। আমি চেয়েছি [মাকে] পরিবারের বাইরে একটি জীবন দিতে… এমনভাবে এই চরিত্রটিকে সাজাতে চেয়েছি, যেটি আমি খুব বেশি দক্ষিণ এশীয় চলচ্চিত্রে দেখিনি।" তার মতে, ভারতীয় চলচ্চিত্রগুলোতে বয়স্ক নারীদেরকে কেবল গৃহিণী কিংবা 'আন্টি'র মতো চরিত্রতেই দেখানো হয়।
চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রগুলোর দুইজনই মা। তারা দুইজনই তাদের কলেজের দিনগুলোতে যৌন নিপীড়নের প্রতিবাদ করার জন্য মাথা টাক করে ফেলেছিলেন, যে কারণে পরে গ্রেপ্তারও হন। এর কয়েক দশক পর, ভারতীয় সমাজে বিবাহবিচ্ছেদ কিংবা আলাদা থাকা নিয়ে বিভিন্ন ধরনের নেতিবাচক ধারণা থাকার পরও দেখা যায় তাদেরই একজন তার প্রতারক স্বামীকে ছেড়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করছেন।
'ইন্ডিয়ান সুইটস অ্যান্ড স্পাইসেস'-এ অভিনয় করা ব্রিটিশ ভারতীয় অভিনেতা রিশ শাহ হলিউডে পা দিয়েছেন মাত্র তিন বছর, অথচ এর মধ্যেই বিভিন্ন ধারার দক্ষিণ এশীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন। গত বছর 'মিস মার্ভেল'-এ কামরানের মতো দক্ষিণ এশীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন। আবার নেটফ্লিক্সের ডু রিভেঞ্জে তাকে দেখা গিয়েছে নীলরঙা চুল, চামড়ার জ্যাকেট পরা 'রুস' নামের এক চরিত্রে, যেটিকে ওভাবে কোন নির্দিষ্ট বর্ণে সংজ্ঞায়িত করা যায় না।
রিশ শাহ তার চরিত্র নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, "এটা দুর্দান্ত যে চলচ্চিত্রটিতে ওপেন-এথনিসিটি কাস্টিং ছিল। ফলে আমার জাতিসত্ত্বার নির্দিষ্ট ছাঁচের বাইরে গিয়ে অভিনয় করার সুযোগ পেয়েছি আমি। এখানে আমি আমার জীবনের গল্প বলছি, আমার ব্যক্তিগত গল্প, যেটিকে আমার জাতিভিত্তিক পরিচয় ছাপিয়ে যেতে পারেনি। আমার বর্ণ বা জাতিসত্ত্বা আমার ব্যক্তির চেয়ে বেশি প্রকট হয়ে উঠতে পারেনি। আর আমার মনে হয়, এটাও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ।"
দূরপ্রাচ্যের চলচ্চিত্র নির্মাতাদের মধ্যেও এই জাতিতাত্ত্বিক ধারণা থেকে বের হয়ে এসে চলচ্চিত্র নির্মাণের উদাহরণ দেখা যায়। ২০২১ সালে প্রথম এশীয় মহিলা হিসেবে সেরা পরিচালকের অস্কার জিতে নেওয়া ক্লো ঝাও যে 'নোমাডল্যান্ড' চলচ্চিত্রের জন্য পুরস্কারটি পেয়েছেন, সেটি মূলত শ্বেতাঙ্গ শ্রমজীবীকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র। ২০১৩ সালে এক বাঘের সাথে সমুদ্রে হারিয়ে যাওয়া একজন ভারতীয় যুবককে নিয়ে তৈরি 'লাইফ অফ পাই' এর জন্যও একই পুরস্কার জিতেছিলেন তাইওয়ানের চলচ্চিত্র নির্মাতা অ্যাং লি।
শ্রীলঙ্কান আমেরিকান চলচ্চিত্র নির্মাতা তানিয়া সেলভারত্নাম বলেন, "আমার মনে হয় চলচ্চিত্র নির্মাতারা কেবল নিজেদের গল্প শোনাবেন বলে এমন আশা করাটা ক্ষীণদৃষ্টির পরিচয় দেয়। আমাদের কল্পনাকে, আমাদের দৃষ্টিকে আরও প্রসারিত করা আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। সবাই কেবল নিজেদের জাতির মধ্যেই আবদ্ধ থাকবে এমন ভাবাটা ঠিক নয়।"
ক্রেজি এক্স-গার্লফ্রেন্ডের অভিনেতা চিনার পরামর্শ হলো, আমেরিকানদের কাছে আরও সূক্ষ্ম ও বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্যগুলোকে তুলে ধরা দক্ষিণ এশীয় নির্মাতাদের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ। তিনি বলেন, "আমরা অবশেষে মূলধারায় জায়গা পাচ্ছি, যেখানে মার্কিন দর্শকরা চিকেন টিক্কা মাসালা আর ইদলি-সাম্বার মধ্যে পার্থক্য ধরতে পারছেন, ধর্ম আর বর্ণের সূক্ষ্ম দিকগুলো তো বটেই। আমিই খুব কৃতজ্ঞ যে আমরা এই সূক্ষ্ম বৈশিষ্ট্যগুলোকে তুলে ধরতে পারছি।"
চিনা আশা করেন যে এমন একদিন আসবে, যেদিন তিনি জেমস বন্ড, শার্লক হোমস বা ক্যাপ্টেন আমেরিকার মতো ত্রিমাত্রিক এবং স্মরণীয় কোনো চরিত্রে অভিনয় করতে পারবেন।
চিনা জানান, "আমি জানি না ভারতীয়-আমেরিকানদের জন্য কিং লিয়ারের সমতুল্য চরিত্র আছে কিনা। আমরা কেবল সেখানে পৌঁছেছি যেখানে আপনি বোবা হতে পারবেন বা সমকামী হতে পারবেন। আমার মনে হয় বাদামি বর্ণের মানুষদের জন্য এখনো কোনো আদর্শ চরিত্র তৈরি করা হয়নি। আমরা এর কাছাকাছি চলে এসেছি, কিন্তু এখনো সম্পূর্ণ কোনো চরিত্র তৈরি হয়নি।"