প্রত্যাশা পূরণের দিকে ধীরগতিতে এগোচ্ছে উদ্যোক্তা তহবিল
নিয়মনীতিতে জটিলতার কথা উল্লেখ করে দেশের ব্যাংকগুলোর অনাগ্রহের কারণে গত পাঁচ বছরে মাত্র ১১টি প্রকল্পে ঋণ বিতরণ করেছে উদ্যোক্তা সহায়তা তহবিল (ইএসএফ)। ঋণ সুবিধা সহজীকরণের মাধ্যমে উদ্যোক্তা তৈরির লক্ষ্যে এ তহবিল গঠন করে সরকার।
কিন্তু মাত্র ২% সরল সুদে ঋণ দিয়ে নতুন উদ্যোক্তা তৈরির মাধ্যমে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টির সরকারি চেষ্টায় সাড়া দিচ্ছে না ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো।
ইএসএফ গঠনের পর গত পাঁচ বছরে মাত্র ১১টি প্রকল্পে ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো, যার মধ্যে ঋণের প্রথম কিস্তি পাওয়া প্রকল্প আটটি, দ্বিতীয় কিস্তি পেয়েছে তিনটি।
জমি ও ইক্যুইটিসহ উদ্যোক্তা ৫১% বিনিয়োগ করার পর বাকি ৪৯% বিনিয়োগ বাবদ এই তহবিল থেকে ২% সরল সুদে আট বছর মেয়াদে ঋণ দেওয়া হয়, যার মধ্যে প্রথম চার বছর গ্রেস পিরিয়ড।
ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই ঋণের প্রতি উদ্যোক্তা হতে চাওয়া ব্যক্তিদের আগ্রহও বেশি। গত পাঁচ বছরে এই ফান্ড থেকে ঋণ পেতে ৪৮৩৫টি আবেদন পড়েছে।
আবেদনকারীদের সাক্ষাৎকার শেষে প্রায় দেড় সহস্রাধিক আবেদন শর্টলিস্ট করা হলেও লিয়েন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো প্রকল্প মূল্যায়ন করে প্রস্তাব পাঠাচ্ছে না।
ফলে এই ফান্ড এখন সচল রাখা হবে কি-না, তা নিয়ে সরকারের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় আছে ফান্ড পরিচালনার সঙ্গে সম্পৃক্ত বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ।
ফান্ডটির কার্যক্রম সচল রাখা হবে কি-না, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত চেয়ে গত ডিসেম্বর মাসে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগে চিঠি পাঠায় বাংলাদেশ ব্যাংক।
মন্ত্রণালয় থেকে কোন সিদ্ধান্ত না পাওয়া পর্যন্ত ইএসএফ তহবিলের সার্বিক কার্যক্রম সচল রাখতে আইসিবিকে পরামর্শ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ ও কৃষিভিত্তিক শিল্পখাত ও আইসিটি খাতে নতুন নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টি, এসবখাতে বিনিয়োগ বাড়াতে শিক্ষিত বেকার ও কর্মক্ষম যুবক শ্রেণীকে উৎসাহ দেওয়া এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে এ ফান্ড ভূমিকা রাখবে বলে মনে করে সরকার।
খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, কৃষি, মৎস্য চাষ ও আইসিটিসহ বিভিন্নখাতে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টিতে সুদমুক্ত ঋণ বিতরণের জন্য ২০০১ সালে গঠন করা আন্ট্রারপ্রেনরশিপ এন্ড ইক্যুইটি ফান্ড (ইইএফ) থেকে ঋণ বিতরণে ব্যাপক অনিয়ম হয় এবং বিতরণ করা অর্থ আদায় করতে ব্যর্থ হওয়ার পর এই ফান্ডের সীমাবদ্ধতাগুলো দূর করে ২০১৮ সালে ইএসএফ ফান্ড গঠন করে বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে সাব-এজেন্ট জিসেবে এই তহবিল পরিচালনা করছে আইসিবি। আর আবেদনকারীদের প্রকল্প প্রস্তাব মূল্যায়নসহ এই তহবিল থেকে ঋণ বিতরণে লিয়েন ব্যাংক হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ রয়েছে ৩৭টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান।
শর্টলিস্টভূক্ত প্রকল্প হতে লিয়েন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মূল্যায়ন শেষে আইসিবিতে প্রকল্প প্রস্তাব পাঠালে সেগুলোতে ঋণ মঞ্জুর করে সংস্থাটি।
ইএসএফ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে পাঠানো এক প্রতিবেদনে আইসিবি বলেছে, শর্ট লিস্টভুক্ত ১৫৬৮টি প্রকল্প হতে ইএসএফ কৃষি ও আইসিটি খাতে এখন পর্যন্ত মাত্র ১৫৭টি প্রকল্প মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠান হতে মূল্যায়ন শেষে আইসিবিতে পাঠানো হয়েছে, যা শর্টলিস্টভূক্ত মোট প্রকল্পের ১০.০১%।
'আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লি. (আইসিবি'র সাবসিডিয়ারি কোম্পানি) বাদে অন্যান্য মূল্যায়নকারী ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান প্রকল্পের প্রজেক্ট প্রোপাজাল জমা নিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনীহা প্রকাশ করছে। শর্টলিস্টভুক্ত হওয়ার পরেও প্রকল্পের উদ্যোক্তাগণ তাদের প্রকল্প প্রস্তাব জমা দিতে পারছেন না' – যোগ করেছে আইসিবি।
মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠানো ১৫৭টি প্রকল্পের মধ্যে ১৫০টি প্রকল্পই মূল্যায়ন করেছে আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজমেন্ট লিমিটেড।
বাকি সাতটি প্রকল্পের মধ্যে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক লিমিটেড দু'টি, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক একটি, এনআরবিসি একটি, মার্কেন্টাইল ব্যাংক একটি, অগ্রণী ব্যাংক একটি এবং আইএফআইসি ব্যাংক একটি প্রকল্প মূল্যায়ন করেছে। বাকি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো কোন প্রকল্প মূল্যায়ন করে প্রস্তাব আইসিবিতে পাঠায়নি।
মূল্যায়ন করা ১৫৭টি প্রকল্পের মধ্যে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত কৃষি ও আইসিটিখাতে ১০৪টি প্রকল্পে ২০৩.২৯ কোটি টাকা মঞ্জুর হয়েছে। ১৩টি প্রকল্প ইএসএফ নীতিমালার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় মঞ্জুরের জন্য বিবেচিত হয়নি।
২১টি প্রকল্পের উদ্যোক্তাদের কাছে সিআইবি তথ্যসহ অন্যান্য ঘাটতি তথ্য সরবরাহের জন্য মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে অনুরোধ করা হলেও প্রকল্প কর্তৃপক্ষ যোগাযোগ করেনি।
এছাড়া, টার্কি পালন, টার্কি হ্যাচারি ও সেমি ইনটেনসিভ অ্যাকুয়াকালচার খাতে প্রকল্প স্থাপন বর্তমানে লাভজনক মনে না হওয়ায় সাতটি প্রকল্পের কর্তৃপক্ষ উপ-খাত পরিবর্তন করে পুনরায় আবেদন করবে বলে জানিয়েছে।
গত ৫ মার্চ আইসিবি'র মহাব্যবস্থাপক (ইইএফ) মো. তালেব হোসেন স্বাক্ষরিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মঞ্জুরি হওয়া ১০৪টি প্রকল্পের মধ্যে ৯৩টি প্রকল্পের উদ্যোক্তারা মঞ্জুরিপত্রের শর্তানুযায়ী ডকুমেন্টেশনের জন্য আবেদন করেছে, যাদের মধ্যে গত ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মাত্র ১৮টি প্রকল্পের উদ্যোক্তা ৫১% বিনিয়োগ সম্পন্ন করে ইএসএফ ঋণের অর্থ বিতরণের আবেদন জানিয়েছে। তার মধ্যে ১১টি প্রকল্পে ১৩.৫৮ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে, বাকি সাতটি প্রকল্প ঋণ বিতরণের জন্য অপেক্ষমাণ রয়েছে।
ইএসএফ ফান্ড থেকে উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণের অন্তরায়গুলো তুলে ধরে আইসিবি বলেছে, 'পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রকল্প প্রস্তাব বাছাই করে শর্টলিস্টভুক্ত করা হলেও সে তুলনায় মূল্যায়ন প্রতিবেদনের সংখ্যা খুবই কম। মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো আন্তরিকভাবে সম্পৃক্ত না হওয়ায় ইএসএফ এর সন্তোষজনক অর্জন সম্ভব হচ্ছে না।'
'উদ্যোক্তাগণ আগ্রহী হলেও আইসিবি ক্যাপিটাল ম্যানেজনেমন্ট বাদে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হতে মাত্র সাতটি প্রকল্প প্রস্তাব আইসিবিতে দাখিল করা হয়েছে। মূল্যায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পর্যাপ্ত সংখ্যক প্রকল্প মূল্যায়ন না করায় ইএসএফ এর কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি ব্যাহত হচ্ছে'- যোগ করেছে সংস্থাটি।
এছাড়াও উদ্যোক্তাদের অনাগ্রহ, বিভিন্ন বিষয়ে অজ্ঞতা, জমির নথি হালনাগাদ করতে বিলম্ব, প্রকল্প বাস্তবায়নে বিলম্বের কথা উল্লেখ করেছে আইসিবি। তারা আরো বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংক ২১টি ব্যাংক ও ১২টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের লিয়েন ব্যাংক হিসেবে উদ্যোক্তাদের কাছ থেকে প্রকল্প প্রস্তাব গ্রহণ করতে সম্মত হয়েছে। গণবিজ্ঞপ্তি জারির পরও শর্টলিস্টভুক্ত প্রকল্পগুলোর মূল্যায়ন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত হয়নি।
ইএসএফ তহবিল থেকে ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোর অনীহার কারণ জানতে চাইলে এবিবির চেয়ারম্যান ও ব্র্যাক ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সেলিম আর এফ হোসেন দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, তহবিলের ধরন এবং পরিচালনার নিয়মের পরিবর্তনের কারণে ব্যাংকাররা অপেক্ষাকৃত কম আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
"কারণ নতুন নীতিতে এই শর্ত রয়েছে যে ঋণগ্রহীতা বাণিজ্যিকভাবে ব্যর্থ হলে তার দায় সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে নিতে হবে," তিনি বলেছিলেন।
বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্স কোম্পানি অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি এবং আইপিডিসি ফাইন্যান্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মমিনুল ইসলাম টিবিএসকে বলেন, "যখন ইইএফ ছিল তখন নিয়ম-কানুন খুবই সহজ ছিল এবং বাংলাদেশ ব্যাংক সব ঝুঁকি নিতো। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান সেখানে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করতো।"
"ইএসএফ-এ এই নিয়মগুলো পরিবর্তন করা হয়েছে। বিধি-বিধান কঠোর করা হয়েছে। প্রক্রিয়াটিও এখন জটিল। সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো, যে অর্থায়ন এখন করা হয় তা ঋণ হিসাবে বিবেচিত হয়; কিন্তু ইইএফ এর অধীনে তহবিল মূলধন হিসাবে বিবেচিত হত। ফলে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তারা যেমন আগ্রহ হারাচ্ছে, তেমনি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও আগ্রহ দেখাচ্ছে না," বলেন তিনি।
তিনি বলেন, এই তহবিলের তুলনায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং গ্রাহকরা বাংলাদেশ ব্যাংকের পুনঃঅর্থায়ন প্রকল্পে বেশি আগ্রহী।
"কারণ এই তহবিলগুলো সহজেই বিতরণ করা হয়। সুদের হারও কম। তবে, ব্যাংক এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এক্ষেত্রে তাদের নিজস্ব তহবিল ব্যবহার করে না," যোগ করেন মমিনুল ইসলাম।