সংশোধিত পদ্মা সেতু প্রকল্পে ব্যয় কমানোর পরামর্শ পরিকল্পনা কমিশনের
পদ্মা সেতু প্রকল্পের তৃতীয় সংশোধনী প্রস্তাবে বেশকিছু খাতে বাড়তি ব্যয় ধরা হয়েছে বলে মনে করছে পরিকল্পনা কমিশন। তাই চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে কমিশন এসব খাতের ব্যয় যৌক্তিক হারে কমিয়ে আনার পরামর্শ দিয়েছে।
মঙ্গলবার (১৮ এপ্রিল) জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় সংশোধিত প্রস্তাবটি উপস্থাপন করা হবে বলে জানা গেছে কমিশন সূত্রে।
গত জুনে পদ্মা সেতু যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হলেও প্রকল্পের কিছু অংশের কাজ এখনো চলছে। এছাড়া, ইতোমধ্যে সম্পন্ন হওয়া বেশকিছু কাজের বকেয়া অর্থও পরিশোধ করা বাকি। তাই তৃতীয়বারের মতো সংশোধনী আনা হয়েছে প্রকল্পের ব্যয়ে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো তৃতীয় সংশোধিত প্রস্তাবনায় পদ্মা সেতু প্রকল্পের জন্য অতিরিক্ত ২ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা চাওয়ার পাশাপাশি প্রকল্পের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানোর আবেদন করে সেতু বিভাগ।
সংশোধিত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, মুদ্রা মানের ওঠানামা, পাইল ফাউন্ডেশনের নকশা পরিবর্তন, আইন পরিবর্তনের কারণে ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) ও আয়কর বৃদ্ধি, ৪০০ কেভি (কিলোভোল্ট) ট্রান্সমিশন টাওয়ার ফাউন্ডেশন প্ল্যাটফর্মের নকশার জন্য বৃদ্ধিপ্রাপ্ত খরচ, মাওয়া নদীর প্রশিক্ষণ কাজের নকশা পরিবর্তন, অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য অতিরিক্ত কাজ ও অন্যান্য সিভিল কাজ এবং সেতু উদ্বোধনের অনুষ্ঠান ইত্যাদির জন্য অতিরিক্ত তহবিলের প্রয়োজন হয়েছে।
মার্চে অনুষ্ঠিত প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটির (পিইসি) সভায় সেতু বিভাগের কাছে কর্মকর্তা ও পরামর্শকদের বেতন-ভাতা, কম্পিউটার ও আনুষাঙ্গিক ক্রয় এবং মূল সেতু ও নদীশাসনে ব্যয় বৃদ্ধির যৌক্তিক ব্যাখ্যা জানতে চায় পরিকল্পনা কমিশন।
পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের সদস্য (সচিব) মোহাম্মদ এমদাদ উল্লাহ মিয়ান স্বাক্ষরিত সভার কার্যবিবরণী সেতু বিভাগসহ বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, প্রকল্পের কয়েকটি খাতে অনুমোদিত বরাদ্দের দেড় থেকে সাড়ে ৮গুণ টাকা ব্যয় করেছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। সংশোধিত প্রস্তাবে এসব খাতে বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে ১৬ গুণ পর্যন্ত। অনুমোদনের আগেই এসব খাতে বাড়তি ব্যয় করার বিষয়টিকে 'পরিকল্পনা শৃঙ্খলার পরিপন্থী' হিসেবে চিহ্নিত করেছে কমিশন।
মূল্যায়ন কমিটির সভায়, ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে এমন খাতগুলোর প্রস্তাবিত ব্যয় পরিকল্পনা কমিশনের সঙ্গে আলোচনা ও আবার যাচাই করে পুনঃনির্ধারনের শর্তে তৃতীয় সংশোধনী অনুমোদনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের সব কাজ প্রস্তাব অনুযায়ী আগামী বছরের জুনের মধ্যে শেষ করার শর্তও জুড়ে দেওয়া হয়েছে।
যা বলছেন প্রকল্প কর্মকর্তারা
প্রকল্প কর্মকর্তাদের মতে, ভ্যাট ও আয়করের হার বৃদ্ধি এবং মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে বিভিন্ন খাতে অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে।
তৃতীয় সংশোধিত প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রকল্পের ব্যয় এখন বেড়ে দাঁড়াবে ৩২ হাজার ৮৭৫.৫৪ কোটি টাকা; দ্বিতীয় সংশোধনে এই ব্যয় ধরা হয়েছিল ৩০ হাজার ১৯৩.৩৮ কোটি টাকা।
সভায় প্রকল্প পরিচালক সফিকুল ইসলাম বলেন, পূর্ত কাজের ভ্যাট ও আয়কর হার বেড়ে যাওয়ায় মূল সেতুতে ৪০৫ কোটি টাকা ও নদী শাসনে ২৮২ কোটি টাকা মিলে ভ্যাট ও আয়কর বেড়েছে ৬৮৭ কোটি টাকা। এছাড়া, পরামর্শকের ভ্যাট ও আয়কর বেড়ে যাওয়ার কারণেও ব্যয় বাড়ছে।
তিনি আরও বলন, সেতু নির্মাণে ঠিকাদারের সঙ্গে চুক্তির সময় ডলারের বিনিময় ৭৮.৩০ টাকায় থাকলেও বর্তমানে ১০৭ টাকায় ডলার কিনতে হচ্ছে। এর ফলে প্রায় ২০০ কোটি টাকা বাড়তি লাগবে।
মূল সেতুর কাজে অতিরিক্ত ৪৩ মাস এবং নদীশাসনে ৫৫ মাস সময় লাগায় ৭২৭ কোটি টাকা ব্যয় বাড়ছে বলেও তিনি জানান।
এছাড়া বিদ্যুৎ সংযোগ, আপ্যায়ন ও অপ্রত্যাশিত খাতে বাড়তি ব্যয় করা হয়েছে। যদিও এসব ব্যয়কে শৃঙ্খলা পরিপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করে ব্যাখ্যা চেয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
জানতে চাইলে সেতু বিভাগের সচিব মনজুর হোসেন টিবিএসকে বলেন, "কয়েকটি খাতে ব্যয় কিছুটা কমানো সম্ভব হবে। তবে ঠিকাদারের সঙ্গে আগামী জুনে চুক্তির মেয়াদ শেষ হতে যাচ্ছে, তাই মূল সেতুর অবশিষ্ট বিল পরিশোধের স্বার্থে দ্রুত সংশোধিত প্রস্তাবটি একনেকে অনুমোদনের প্রয়োজন।"
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তৃতীয় সংশোধনীতে যেসব কাজের জন্য অতিরিক্ত তহবিল চাওয়া হয়েছে, তার বেশিরভাগ কাজই শেষ। এখন শুধু বিল পরিশোধের জন্য নতুন অর্থের প্রয়োজন।
প্রকল্পের বিস্তারিত
পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, দেশের দক্ষিণাঞ্চলের সঙ্গে রাজধানী ঢাকার যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতির মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন নিশ্চিত করতে বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থার ঋণে ১০,১৬২ কোটি টাকা ব্যয় ধরে পদ্মা সেতু প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল ২০০৭ সালের আগস্টে।
২০১৫ সালের জুনের মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও ব্যয় ২০,৫০৭ কোটি টাকায় উন্নীত করে প্রকল্পের প্রথম সংশোধনীতে মেয়াদ বাড়ানো হয় ছয় মাস।
বিভিন্ন জটিলতায় বিশ্বব্যাংকসহ অন্যান্য সংস্থার ঋণ বাতিল হওয়ায় শতভাগ অভ্যন্তরীণ অর্থায়নে ২৮,৭৯৩ কোটি টাকা ব্যয় ধরে দ্বিতীয় সংশোধনী অনুমোদন দেওয়া হয় ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে। এ দফায় বাস্তবায়নকাল ধরা হয় ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত।
পরবর্তীতে বিশেষ সংশোধনীতে আরও বাড়িয়ে প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ৩০,১৯৩.৩৯ কোটি টাকা। ১০,১৬২ কোটি টাকার প্রকল্পে তিন দফায় ২০,০৩২ কোটি টাকা ব্যয় বৃদ্ধির পর আবারও মেয়াদ বাড়ানো হয় চলতি বছরের জুন পর্যন্ত।