কাচের জারে যেভাবে ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় কুষ্টিয়ার কুলফি!
লাল কাপড়ে মোড়ানো বিশাল হাড়ি মাথায়। 'কুলফি মালাইইইইই' হাঁক দিয়ে ডেকে যাচ্ছেন সজোরে। 'কুলফি মালাই' বিক্রি করা এসব কুলফিওয়ালাদের প্রায়ই দেখা মেলে ঢাকার রাস্তায়। গ্রীষ্মের দুপুরে কাঠফাঁটা রোদের নিচে এই কুলফির হাড়ি দেখে লোভ সামলানো অনেকটাই মুশকিল। কেউ কেউ ভ্যানগাড়িতে 'কুষ্টিয়ার বিখ্যাত মালাই কুলফি' সাইনবোর্ড লাগিয়েও ঘুরে বেড়ান কুলফি নিয়ে!
দেশজুড়ে সব জায়গায় যেমন দই মানেই 'বগুড়ার দই', রসমালাই মানেই 'কুমিল্লার রসমালাই' তেমনি কুলফি মানেই বিক্রি হয় 'কুষ্টিয়ার কুলফি' নামে। তবে খোঁজ নিলে দেখা যায় সেগুলোর বেশিরভাগই উৎপাদিত হয় স্থানীয় পরিসরে। অনেকেই দাবি করেন, কুষ্টিয়ার মালাই কুলফির রেসিপি অক্ষুণ্ণ রেখেই ঢাকাতে কুলফি বানিয়ে বিক্রি করেন তারা। কিন্তু শুধু নির্দিষ্ট রেসিপি অনুযায়ী রান্না করলেই সব জায়গার খাবারের স্বাদ এক হওয়া সম্ভব নয়।
নির্দিষ্ট স্থানে উৎপাদিত বিশেষ উপকরণ, আবহাওয়া, পানি ইত্যাদি বড় ভূমিকা রাখে স্বাদে। তাই কুষ্টিয়ার কুলফির স্বাদ পেতে হলে তা কুষ্টিয়াতেই তৈরি হতে হবে সেখানকার বিশেষ উপকরণ দিয়ে। এ কারণে ঢাকায় বসে কুষ্টিয়ার বিখ্যাত মালাই কুলফির স্বাদ পাওয়া অনেকটাই দুষ্কর। তবে ঢাকাবাসীর এই আক্ষেপ ঘুচানোর উদ্যোগ নিয়েছে অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠান 'কুলফিওয়ালা'।
সরাসরি কুষ্টিয়া থেকে ঐতিহ্যবাহী কুলফি ঢাকায় এনে বাজারজাত করছে প্রতিষ্ঠানটি। ২০১৯ সালে তেমন কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই উদ্যোগটি শুরু করেছিলেন কুলফিওয়ালার প্রতিষ্ঠাতা জুবায়ের আরেফিন অনিক। বর্তমানে ঢাকা ছাড়াও রাজশাহী, চট্টগ্রাম, গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জে পাওয়া যায় কুলফিওয়ালার মালাই কুলফি। কাঁচের জারে বোতলজাত করা মালাইযুক্ত এই কুলফিতে কুষ্টিয়ার ঐতিহ্যবাহী কুলফির প্রকৃত স্বাদ মেলে অনেকটাই। ২০০ মিলি ও ১০০ মিলির কুলফিওয়ালার এই জার পাওয়া যায় যথাক্রমে ২০০ টাকা ও ১০০ টাকায়।
জুবায়ের আরেফিনের ছোটবেলার বন্ধু জনপ্রিয় ভিডিও ব্লগার 'পেটুক কাপল'এর রাসিফ শফিক। দুজনেরই বেড়ে ওঠা কুষ্টিয়ায়। কুষ্টিয়ার ঐতিহ্যবাহী মালাই কুলফির স্বাদ তাদের চিরচেনা। ২০১৯ সালে পেটুক কাপলের সঙ্গে এক ভ্লগে কুষ্টিয়ার কুলফি খাওয়ার ফুটেজও দেখান তারা। কলাপাতায় মোড়ানো কুষ্টিয়ার সেই মালাই কুলফির স্বাদ চেখে দেখেতে দূর-দুরান্ত থেকে আগ্রহ দেখিয়েছিলেন অনেক দর্শক। সেই থেকেই এ প্রতিষ্ঠানের চিন্তা আসে মাথায়।
বন্ধুর পরামর্শে কুষ্টিয়ার কুলফিওয়ালাদের কাছ থেকে কুলফি সংগ্রহ করে ঢাকায় এনে কাঁচের জারে করে অনলাইনে বিক্রি শুরু করেন জুবায়ের আরেফিন। তার ভাষ্যে, "প্রথম ছয় মাস কোনো নাম ছাড়াই নিজেরা বোতলজাত করে চেনা-পরিচিত গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দিতাম এই কুলফি। পেটুক কাপলের ফেসবুক পেইজ আর ইউটিউব চ্যানেলের মাধ্যমেই প্রচারের কাজ চলতো। কুলফির অর্ডার নিতাম নিজেদের ফেসবুক প্রোফাইলের ইনবক্সেই।"
কাস্টমারদের আগ্রহ আর চাহিদা বাড়তে থাকলে ব্যবসা নিয়ে গুরুত্ব সহকারে ভাবতে শুরু করেন জুবায়ের। ছয় মাস পর নাম ঠিক করেন 'কুলফিওয়ালা'। লোগোসহ জারের উপর লাগানো হয় লেবেল। কুলফিওয়ালা নামে ফেসবুক পেজও খোলেন। অনলাইনের পাশাপাশি ঢাকাসহ সারাদেশে ডিস্ট্রিবিউটর নিয়োগ করে স্থানীয় রেস্টুরেন্ট আর দোকানে কুলফি সরবরাহ করার পরিকল্পনা করেন তিনি।
বর্তমানে কুষ্টিয়ায় ছয়টি কুলফি বিক্রেতা পরিবার থেকে মালাই কুলফি সংগ্রহ করেন জুবায়ের আরেফিন। প্রতিদিন প্রায় ২০০ লিটার গরুর দুধ প্রয়োজন হয় কুলফিওয়ালার কুলফি তৈরির কাজে। মালাই কুলফির জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ হলো গরুর দুধ, চিনি আর এলাচ। মাটির চুলায় প্রায় এক মণের লোহার কড়াইতে অল্প আঁচে প্রায় ১০-১২ ঘণ্টা জ্বাল দিয়ে মালাই প্রস্তুত করা হয় কুলফির জন্য।
জুবায়ের বলেন, "কুলফির প্রধান উপকরণ হলো দুধ, যা খুবই সেন্সিটিভ। সর্বোচ্চ হাইজিন বজায় রেখে এই কুলফি তৈরি ও সংরক্ষণ করা না হলে এটা নষ্ট হয়ে যাবে। তাই কুলফিওয়ালার কুলফিতে হাইজিন না মেনে উপায় নেই। কারিগরদের এই বিষয়ে যথেষ্ট ধারণা আছে। আমাদের একজন প্রতিনিধিও আছেন যিনি কুষ্টিয়ায় থেকে কুলফিগুলোর কোয়ালিটি কন্ট্রোলের দায়িত্ব পালন করেন।"
পেটুক কাপলের ভ্লগে প্রায়ই দেখা যায় কুষ্টিয়ার কারিগরের রান্নাঘরে কুলফি তৈরির ভিডিও। কুষ্টিয়ায় তৈরি করা এই মালাই কুলফি ২-৩ দিন ফ্রিজে রেখে সংরক্ষণ করা হয়। ১০ লিটারের কন্টেইনারে ঢুকিয়ে যাত্রীবাহী বাসে করে ঢাকায় আনা হয় এসব কুলফি। ঢাকার বনশ্রীতে কুলফিওয়ালার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত সংরক্ষণাগারে জারে ঢুকিয়ে কুলফিগুলো সংরক্ষণ করা হয় পরবর্তীতে।
ঢাকা আর চট্টগ্রামে অনলাইনে অর্ডার করার পরদিনই গ্রাহকের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয় কুলফিওয়ালার মালাই কুলফি। অর্ডার করা যায় কুলফিওয়ালার ফেসবুক পেজ ও 'ঘরে থেকে ডট কম' নামের ওয়েবসাইট থেকে। এছাড়া বেশ কিছু দোকান ও রেস্টুরেন্টেও সরাসরি কিনতে পাওয়া যায় এই কুলফি।
"কুষ্টিয়ায় আমরা যে কুলফিগুলো খাই সেগুলো রাতে বানিয়ে বিকেলের মধ্যেই বিক্রি করা হয়। অন্যদিকে ঢাকায় আনা কুলফিগুলো পরিবহন আর বাজারজাতকরণের প্রক্রিয়ায় গ্রাহকের হাতে পৌঁছাতে বেশ কয়েকদিন সময় লেগে যায়। তাই কুষ্টিয়ার রাস্তাঘাটে বিক্রি হওয়া কুলফির সাথে এসব কুলফির স্বাদে কিছুটা পার্থক্য তো থেকেই যায়," সরল স্বীকারোক্তি জুবায়ের আরেফিনের। তার মতে, স্বাদ কিছুটা কমলেও কুষ্টিয়ার বাইরে বসে এরচেয়ে ভালো স্বাদের ঐতিহ্যবাহী মালাই কুলফি পাওয়া সম্ভব নয়।
বর্তমানে কুলফিওয়ালার সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হিসেবে জুবায়ের উল্লেখ করেন ডেলিভারি সংক্রান্ত জটিলতাকে। ফ্রোজেন বা তরল খাবার ডেলিভারি করতে হয় অনেক সাবধানতার সঙ্গে। ডেলিভারিতে দেরি হলে নষ্ট হয়ে যেতে পারে কুলফি। তাই সর্বোচ্চ সতর্কতা মেনেই গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দিতে হয় এটি। কখনো অসতর্কতায় কুলফি নষ্ট হয়ে গেলে দায়িত্ব নিয়ে সেগুলো পরিবর্তন করে দেওয়া হয় গ্রাহককে।
জুবায়েরের ভাষ্যে, "কুলফিওয়ালার কুলফির আসল স্বাদ পেতে হলে কিছুটা ধৈর্য ধরতে হয় গ্রাহকদের। ডেলিভারি পাওয়ার পর কুলফিটা তরল অবস্থায় থাকে। তখন সাথে সাথে এটা খেতে গেলে মিল্কশেকের মতো লাগবে। তাই রিসিভ করার পর অন্তত চার থেকে ছয় ঘণ্টা ফ্রিজে রেখে বরফ করতে হবে কুলফি। ফ্রিজ থেকে বের করে ১০ মিনিট পর ৭০% বরফ আর ৩০% তরল অবস্থায় খেলে পাওয়া যাবে কুষ্টিয়ার বিখ্যাত কুলফির মতো স্বাদ।"