ডয়লির ছবির খাতা এবং মান্ডির দেখা ঢাকা
ডয়লির ভোজসভায়
স্থান: বাঙ্কিপুর, পাটনা
তারিখ: ফেব্রুয়ারি ২৫, ১৮২৯
লর্ড কম্বারমেয়ারের সম্মানে পাটনার আফিম এজেন্ট স্যার চার্লস ডয়লি এক ভোজসভার আয়োজন করেছেন। কম্বারমেয়ারের সহযাত্রী দলের অধিকাংশ ব্যক্তি যোগ দিয়েছেন সেই বিশাল আয়োজনে। লর্ডের একান্ত সচিব ক্যাপ্টেন গডফ্রে চার্লস মান্ডি ডয়লির আন্তরিকতায় মুগ্ধ। গঙ্গার ধারে সুউচ্চ এক টিলার ওপর ডয়লির দালান। ভরা বর্ষায় নদীর প্রশস্ততা ৫ মাইলের কম না। হাওয়া বাতাসের কোনো কমতি নেই সেখানে। বসার ঘরটি বেশ বড়, জানালায় ঝুলছে ভারী পর্দা, ছাদ থেকে নেমে এসেছে বিশাল ঝাড়লণ্ঠন, দেওয়ালজুড়ে শোভা পাচ্ছে ইউরোপীয় কায়দায় আঁকা প্রতিকৃতি আর ল্যান্ডস্কেপের চিত্রকর্ম। মেঝেতে গালিচার মতন বিছানো আছে শিকার করে আনা পশুর চামড়া। ঘরের ঠিক মাঝখানটায় রাখা আছে বিশাল এক পিয়ানো, সাথে আছে ত্রিকোণ কাঠামোর সারি সারি তারে সাজানো বাদ্যযন্ত্র হার্প। জম্পেশ ভোজের পর অতিথিরা হুক্কা আর পানীয় নিয়ে বসেছেন। ডয়লির স্ত্রী এলিজাবেথ বসেছেন হার্প নিয়ে, তাঁর আঙুলের ছোঁয়ায় হার্পে অপূর্ব সুরের মুর্ছনা উঠেছে। উপস্থিত অতিথিরা সেই সুরে ডুবে আছেন। এদিকে গোলাকার শ্বেতপাথরের টেবিলের ওপর নিজ ড্রয়িংয়ের খাতা মেলে ধরেছেন ডয়লি।
ছবি আঁকার ঝোঁক ডয়লির বহুকালের। ভারতবর্ষের বন্য নিসর্গের মাঝে উঁকি দেওয়া দালানকোঠা ডয়লির প্রিয় বিষয়। ডয়লির মতে, এ দেশে নদীতীরে নেমে খানিকটা ভেতরে গেলে যেসব অপরূপ দৃশ্যের দেখা মেলে, তা যেকোনো শিল্পীর অনুসন্ধিৎসু চোখের ক্ষুধা মেটাতে সক্ষম। ১৮০৮ সালে কর্মসূত্রে ডয়লি গিয়েছিলেন ঢাকায়, যোগ দিয়েছিলেন সেখানের কালেক্টর পদে। নতুন সেই পদে যোগ দেবার পরপরই তিনি বন্ধু শিল্পী জর্জ চিনারিকে ডেকে নিয়েছিলেন ঢাকায়। চিনারির কাছ থেকে শিখেছিলেন আঁকাজোকার নানান কৌশল। ঢাকা থেকে ওয়ারেন হেস্টিংসকে পাঠানো ডয়লির চিঠিতে প্রথমদিককার কিছু ড্রয়িংয়ের দেখা মেলে। এরপর চর্চা থেমে থাকেনি। কর্মসূত্রে একসময় ঢাকা ছেড়ে পাটনা চলে আসেন। আফিম এজেন্ট হিসেবে পাটনায় কাজের চাপ তেমন নেই। তাই ছবি আঁকবার জন্য তার বিস্তর অবসর। কাজ শেষে ঘরে ফেরার পর তার হাতে পেন্সিল বা হুক্কার নলচে বাদে আর কিছু চোখে পড়ে না। ছবি আঁকায় ডয়লির সুখ্যাতি তত দিনে ছড়িয়ে পড়েছে ইংরেজ মহলে। লন্ডন থেকে বেরিয়েছে তার 'এন্টিকুইটিজ অব ঢাকা' নামের ফোলিও। বন্ধুবান্ধব, অতিথি অনেককেই ছবি এঁকে উপহার দেন, জলরং আর স্কেচের সংখ্যাই তাতে বেশি। কয়েক বছর আগে কলকাতার বিশপ হেবার পূর্ব বাংলা ভ্রমণ শেষে বেনারস যাবার সময় ডয়লির আতিথ্য গ্রহণ করেন। ডয়লির নিপুণ হাতের ড্রয়িং দেখে তিনি চমৎকৃত হন। নিজ ভ্রমণকথায় ডয়লি বিষয়ে হেবারের মন্তব্য, "He is the best gentleman-artist I ever met with." ছবি আঁকার পাশাপাশি সেগুলোর প্রচারের জন্য তিনি নিজ উদ্যোগে লিথোগ্রাফি করবার ব্যবস্থা করেছেন, প্রেসের নাম বিহার এমেচার লিথোগ্রাফিক প্রেস। দেশি বেশ কয়েকজন শিল্পী এই প্রেসে লিথোগ্রাফির কাজ করেন। সেখান থেকে নিয়মিত বেরোচ্ছে নানান ছবির প্রিন্ট।
উৎসুক মান্ডি ঝুঁকে পড়লেন ডয়লির ড্রয়িং খাতার ওপরে। কালি-কলমে আর পেন্সিলে আঁকা একের পর এক ছবি দেখে তিনি মুগ্ধ। এর মাঝে কিছু স্থাপনার ছবি তিনি বারবার এঁকেছেন। তেমন একটির নাম জানা গেল 'পাগলা পুল'। স্থাপনাটি ঢাকা থেকে নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার পথে পড়ে। মুঘল আমলে তৈরি এই স্থাপনা নিয়ে ডয়লি একটু বেশি মাত্রায় আবেগী। এর আগে 'এন্টিকুইটিজ অব ঢাকা' বইতে পাগলা পুলের ড্রয়িং ফোলিও আকারে ছাপিয়েছিলেন। কিন্তু এরপরও পুল নিয়ে তার ড্রয়িং থেমে থাকেনি। বন্ধু এডোয়ার্ড স্ট্র্যাচিকে চিঠিতে পাগলা পুলের একটি ড্রয়িং বিষয়ে লিখেছিলেন, 'আমি এই ড্রয়িংটি খুব পছন্দ করি এবং চিনারির সাথে আমিও একমত যে পুরো সংগ্রহের মাঝে এই ছবিটিই সবচেয়ে পিকচারেস্ক এবং সেরা।' কয়েক দিন আগে একটা তৈলচিত্রের কাজ শেষ করেছেন ডয়লি, সেখানেও আশপাশের আবছায়া ভেদ করে পুলের মিনারটি যেন আলো ছড়াচ্ছে। মান্ডির ঢাকা যাওয়ার কথা জেনে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন ডয়লি। তার মনে পড়ে গেল বন্ধু চিনারির সাথে কাটানো ঢাকার দিনগুলোর কথা। এ শহরে তিনি তার শিল্পীজীবনের খুব গুরুত্বপূর্ণ একটা সময় কাটিয়েছেন। ঢাকার ভগ্নপ্রায় মুঘল স্থাপনা তাকে আপ্লুত করেছিল। ডয়লির উচ্ছ্বাস ঢাকা বিষয়ে মান্ডিকে আরো কৌতূহলী করে তুলল। পরদিন সকালে মান্ডি যাত্রা করলেন মুঙ্গেরের উদ্দেশে। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী রাজমহল সফর শেষে মার্চের ৪ তারিখে পূর্ব বাংলায় প্রবেশ করে মান্ডির নৌবহর। ঢাকায় পৌঁছায় আরো সাত দিন পর।
মান্ডির সফরনামা
মান্ডি যখন ঢাকায় আসেন, তখন তাঁর বয়স মাত্র ২৫ বছর। সে সময়ে তিনি ছিলেন কমান্ডার ইন চিফ লর্ড কম্বারমেয়ারের একান্ত সচিব। ১৮২৭ সালের নভেম্বরে ভারতবর্ষের ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ইংরেজ সামরিক স্টেশনগুলো দেখবার জন্য কম্বারমেয়ার এক দীর্ঘ সফরে বের হন। এই সফরে লর্ডের সঙ্গী হিসেবে যোগ দেন ক্যাপ্টেন মান্ডি। উত্তর ও পূর্ব ভারতে প্রায় দুই বছরব্যাপী সফর শেষে মান্ডি কলকাতায় ফিরে যান। দীর্ঘ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে মান্ডি 'পেন অ্যান্ড পেন্সিল স্কেচেস ইন ইন্ডিয়া জার্নাল অব আ ট্যুর ইন ইন্ডিয়া' নামে এক চমৎকার বই লেখেন, যা ১৮৩২ সালে দুই ভল্যুমে লন্ডনের জন মারে থেকে প্রকাশিত হয়। বইজুড়ে ছিল মান্ডির আঁকা ২৬টি স্কেচ, এগুলোর এনগ্রেভিংয়ের কাজ করেছিলেন ল্যান্ডসিয়ার। বইয়ের শুরুতে একটি শব্দকোষ যুক্ত করেছিলেন মান্ডি, যেখানে প্রচলিত অনেক ভারতীয় শব্দ, যেমন গুরু, বকশিশ, ভিস্তি, চৌকি, পর্দা, শরাব ইত্যাদি বহুল ব্যবহৃত শব্দের ইংরেজি অর্থ দেওয়া ছিল। শব্দকোষটি সে সময়ে ভারতে বসবাসকারী ইংরেজদের উদ্দেশ্য করে তৈরি করা হয়েছিল। বইটির ব্যাপক কাটতি ছিল বোঝা যায়। প্রকাশের মাত্র এক বছরের মাথায় এর দ্বিতীয় সংস্করণ বাজারে আসে, ১৮৫৮ সালে বের হয় তৃতীয় সংস্করণ।
সর্বশেষ সংস্করণে অধ্যায়ের সংখ্যা ছিল ১২টি। এর নবম অধ্যায়ে এসেছে ঢাকা সফরের প্রসঙ্গ। এর আগের অধ্যায়গুলোতে আছে উত্তর ভারতের নানান উল্লেখযোগ্য সামরিক স্টেশন এবং জনপদে মান্ডির ভ্রমণ অভিজ্ঞতার কথা। উত্তর ভারতের ৬০০ মেইল ভ্রমণ পথে মূল বাহন ছিল পালকি, হাতি এবং ঘোড়ার গাড়ি। তবে নদীনালায় ঘেরা পূর্ব বাংলা সফরে তারা বেছে নিলেন বিভিন্ন ধরনের নৌকার জাকজমকপূর্ণ এক বহর। লর্ডের জন্য ছিল বিশালাকার পিনিশ নৌকা, সঙ্গীদের জন্য ছিল ২৪টি উন্নতমানের বজরা, সাথে বাক্সপেটরা, খাবারদাবার, গোলাবারুদ, ঘোড়া বহনের জন্য ছিল পৃথক পৃথক নৌকা। বিশাল এই নৌবহর সারদার কাছে পাবনার নদী দিয়ে পূর্ব বাংলায় প্রবেশ করে। নৌ ভ্রমণ ছিল তুলনামূলক আরামদায়ক। তবে খুব নিশ্চিন্ত থাকবার সুযোগ ছিল না। নদীর অনেক জায়গায় ডুবোচর ছিল, তাই রাতের বেলায় নদীর বাঁকগুলোতে সতর্ক হওয়া ছিল জরুরী। নদীতীরের চিত্র ছিল বিষণ্ন, অনেক কাঠামো ভেঙে পড়েছিল, কিছু দালান নদীগর্ভে আগেই বিলীন হয়েছিল। স্থানে স্থানে কিছু বাংলো চোখে পড়ছিল, বাকি সব ছিল কাঁচা ঘরবাড়ি। জায়গায় জায়গায় বেশ কিছু নীলকুঠি ছিল। নীল ব্যবসার তখন রমরমা অবস্থা। মান্ডি এবং তার সহযাত্রীরা নীলকুঠির আতিথ্য গ্রহণ করেন।
ঢাকায় তিন দিন
১১ মার্চ সূর্যোদয়ের সাথে মান্ডির নৌবহর ঢাকা পৌঁছায়। মান্ডি লিখেছেন বুড়িগঙ্গার তীর ধরে ৫ মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত এই শহরটির দশা তখন ভগ্নপ্রায়। তবে ঠিক যেমনটা বলেছিলেন ডয়লি, এর মাঝেই উঁকি দিচ্ছে এককালের প্রাচুর্যময় দালানকোঠার স্মৃতিচিহ্ন। সিভিল স্টেশনের কাছে এসে নোঙর ফেলল তাদের বজরা।
এককালে এই শহর ছিল সমৃদ্ধ জনপদ, ছিল সুবা বাংলার রাজধানী। পর্তুগিজ জলদস্যু আর আরাকানি দস্যুদের মোকাবেলার জন্য এখানে মুঘল সৈন্যদের ঘাঁটি ছিল। মান্ডি যে সময়ে ঢাকা আসেন, সে সময়ে এ শহরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির জনাকয়েক ইংরেজের বাস ছিল। শহরটি গুরুত্ব পুরোপুরি হারায়নি এর হাতি বাণিজ্যের জন্য, ঢাকার সংগ্রহে তখন প্রায় ৩০০ হাতি ছিল। ঢাকার সুখ্যাতির অন্যতম প্রধান কারণ ছিল এর মসলিনশিল্প। ইংরেজ রমণীদের মাঝে সূক্ষ্ম মসলিনের চাহিদা ছিল আকাশছোঁয়া। মান্ডি যখন ঢাকা আসেন, তখন এ শিল্প বিলুপ্তির পথে। এর কারণ হিসেবে মান্ডি দায়ী করেছেন বিলাতে শিল্পায়নের অভূতপূর্ব উন্নতি এবং মসলিন শিল্পের সাথে জড়িতদের প্রতি ইংরেজদের বৈরী আচরণকে। এই দুই কারণে নারীদের অনন্য পোশাক মসলিনের চাহিদা ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়েছে এবং হুমকির মুখে পড়েছে।
ঢাকা মূলত নদীতীর ধরে বিস্তার লাভ করেছে, অপর তিন দিক শত শত মাইল ঘন জঙ্গলে ঘেরা, যার কিছু অংশ একেবারেই দুর্ভেদ্য। ঢাকার এককালের জৌলুস ভরা প্রাসাদ, উপাসনাগার আর সমাধিসৌধগুলো এই দুর্ভেদ্য জঙ্গলে ঢেকে গেছে, এগুলো বাঘ, চিতাবাঘ আর হায়নাদের নিরাপদ লুকানোর জায়গায় পরিণত হয়েছে। সাধারণত শিকারের জন্য ইংরেজদের খোলামেলা এলাকাই পছন্দ। তবে সেখানেও প্রচুর অনুশীলনের প্রয়োজন, না হলে সুযোগ পেলেই প্রাণীরা শিকারিকে ফাঁকি দিয়ে কাছের ঘন জঙ্গলে হারিয়ে যায়। শিকারের জন্য মহিষ, বন্য শূকর এবং হরিণের প্রাচুর্য চোখে পড়ার মতন। তবে নদীনালায় ঘুরে বেড়ায় নরমাংসের জন্য লালায়িত কুমির। মান্ডি দেখলেন স্থানীয়রা অনেকটা বিকারহীনভাবেই নদীতীরে স্নান, কাপড় ধোয়া কিংবা পানি সংগ্রহের কাজ সেরে নিচ্ছেন। হিংস্র কুমিরের বহুল উপস্থিতির পরও নদীনালা ঘিরে স্থানীয় মানুষের কর্মযজ্ঞ দেখে তিনি অবাক হলেন। জনৈক মি. আলেকজান্ডার, লর্ড কম্বারমেয়ারকে কুমিরের মাথার একটি সুন্দর নমুনা উপহার দিলেন। নরখাদক কুমিরটি ঢাকার এক নীল কারখানার আটজন কর্মীকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। স্থানীয় এক ব্যক্তি দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর বিষাক্ত তীর দিয়ে কুমিরটিকে হত্যা করতে সফল হন। কুমির বধের জন্য বেশ কিছু পেশাদার লোকও ছিল। মৃত কুমিরের পেট চিড়ে প্রায়ই হতভাগ্যদের ব্যবহৃত সোনা, রুপা বা পিতলের গয়না পাওয়া যেত। পারিশ্রমিকের পাশাপাশি এসব গয়না ছিল কুমির শিকারির জন্য বাড়তি পাওয়া। লোকেদের নানান ভীতিকর অভিজ্ঞতা আর নিষেধ সত্ত্বেও ঢাকার ভ্যাপসা গরমে বুড়িগঙ্গার স্বচ্ছ পানিতে ডুব দেওয়ার লোভ সামলানো ছিল কঠিন। প্রতি সন্ধ্যায় নৈশভোজের আগে স্নান সেরে নিতে ভোলেননি মান্ডি।
পরের দিন, লর্ড কম্বারমেয়ারের সাথে সাক্ষাৎ করেন নওয়াব শামস-উদ-দৌলা। মান্ডি নওয়াবকে তৎকালীন ঢাকায় ইংরেজদের কাছে গ্রহণযোগ্য একমাত্র পদমর্যাদার বাসিন্দা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। পূর্বের নায়েব নাজিম নওয়াব নুসরাত জঙের মৃত্যুর পর পরিবারের কর্তা হিসেবে স্বীকৃতি পান ছোট ভাই শামস-উদ-দৌলা। প্রাপ্ত তথ্যমতে এ সময়ে তার জন্য ঢাকা তোষাখানা থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা ভাতা মঞ্জুর করা হয়। যৌবনে শামস-উদ-দৌলার বিরুদ্ধে বেনারসে ইংরেজ হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগ ছিল। এই অভিযোগের দায়ে বহু বছর কেটেছে কলকাতার কারাগারে। সে সময়ে তিনি নিজেকে ইংরেজি ভাষায় দক্ষ করে তোলেন, ইংরেজি সাহিত্য ও এর ইতিহাসে ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। মান্ডি যখন নওয়াবকে দেখেন তখন তাঁর বয়স ৬০ এর কোটায়। মাঝারি গড়নের গৌড়বর্ণ নওয়াবের চেহারা বুদ্ধিদীপ্ত, আকর্ষণীয়। কোম্পানির একজন পেনশনভোগী হলেও নওয়াব হিসেবে তিনি কিছু পরিমাণে আভিজাত্য টিকিয়ে রাখতে চান। নওয়াবের সাথে ছিল হাতির দাঁতের তৈরি পুরু লাঠি, মসলিন পাগড়ির নিচে থেকে উঁকি দিচ্ছিল ধবধবে সাদা বাবরি চুল। সাদামাটা পোশাকেও তাকে অসামান্য দেখায়। কিছুকাল আগে নওয়াব শামস-উদ-দৌলা এবং তার ক্ষমতার সীমাবদ্ধতা বিষয়ে বিশপ হেবার নিজ ভ্রমণকথায় লিখেছিলেন। উল্লেখ্য, বিশপ হেবার ১৮২৪ সালের জুলাই মাসে ঢাকা সফরকালে নওয়াবের সাথে সাক্ষাৎ করেন। মান্ডির কাছে হেবারের বর্ণনা যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত মনে হলেও লেখাটি পড়ে নওয়াব ক্ষুব্ধ হন। নওয়াব হেবারের লেখার প্রতিবাদ জানিয়ে কলকাতার সংবাদপত্রে একটি চিঠিও লেখেন।
ঢাকায় অবস্থানের তৃতীয় দিন, ১৩ মার্চ ভোর চারটায় ঘোড়ার গাড়িতে চেপে কম্বারমেয়ার ও তার সহযাত্রীরা ঢাকা থেকে আট মাইল দূরের এক জঙ্গলে শিকারের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। আয়োজনের জাঁকজমক দেখে অবাক হলেন মান্ডি। ঘন, উঁচু বনে প্রবেশের জন্য সেখানে ৬০টি হাতি এক সারিতে অপেক্ষা করছিল, কেবল শিকারের জন্য এত হাতির সমাবেশ তিনি আগে কখনো দেখেননি। বন্য শূকরের দল তাড়া করবার জন্য সাথে ছিল ৩০ জোড়া শিকারি কুকুর। শিকারের এই অভিযান তিন ঘণ্টা ধরে চলল। তবে গোলাগুলির পেছনে যা ব্যয় হলো তার তুলনায় শিকারের পরিমাণ ছিল সামান্য দুটি বিশাল আকারের হরিণ (সম্ভবত বারশিঙ্গা অথবা সাম্বার জাতীয় হরিণ), কয়েকটি বন্য শূকর, হরিণ (খুব সম্ভব চিত্রল হরিণ, প্রিয়দর্শন এবং সুস্বাদু মাংসের কারণে এদের বিশেষ কদর ছিল) এবং বেশ কিছু খরগোশ। বাদামি রঙের স্বল্পগতির ছোট্ট একটি প্রাণীও শিকার করলেন মান্ডি; খরগোশ আর গিনিপিগের মাঝামাঝি দেখতে এমন প্রাণী তার আগে চোখে পড়েনি। এই অভিযানে বাঘ এবং বুনো মহিষ শিকার দেখবার আশায় কাছের গ্রামের কজন রাখালও যোগ দিয়েছিলেন। তবে এ ব্যাপারে সফল হলেন না শিকারিরা, অল্প কিছু পায়ের ছাপ দেখেই ফেরত আসতে হলো। যথেষ্ট শিকার না পাওয়ার কারণ খুঁজতে চেয়েছেন মান্ডি। সাধারণত গরমের তীব্রতা বাড়লে জঙ্গল থেকে বন্য প্রাণীরা জলধারার সন্ধানে সমতলের কাছে চলে আসে। তাদের অভিযানের সময় হয়তো গরমটা প্রাণীদের জন্য সহনীয় ছিল। উপযুক্ত সময়ে ঢাকার স্পোর্টিং ক্লাব যে শিকারের আয়োজন করে, তাতে ইংরেজরা জঙ্গলে এসে কয়েক দিন অবস্থান করেন, তাদের থাকবার জন্য সেখানে বাংলো তৈরি করা আছে।
সেদিন সন্ধ্যায় লর্ড কম্বারমেয়ারের সম্মানে নায়েবে নাজিমের নিমতলি প্রাসাদে নৈশভোজের আয়োজন করা হয়। লর্ডকে প্রাসাদে নিয়ে যাওয়ার জন্য নওয়াব নিজ ঘোড়ার গাড়ি পাঠালেন। ১৮২৪ সালে শুরু হওয়া প্রথম অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধকালে পণ্য পরিবহণের প্রয়োজনে ঢাকা থেকে আটটি অতিকায় হাতি ইংরেজদের উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন নওয়াব শামস-উদ-দৌলা। এ সহায়তার স্বীকৃতি হিসেবে ইংরেজ সরকার তাঁকে উপহার দেন রাজকীয় এক ঘোড়ার গাড়ি। গাড়িটির উজ্জ্বল রং ও অলংকরণ মান্ডিকে লন্ডনের মেয়রের রাজকীয় কোচের কথা মনে করিয়ে দেয়। প্রতিবছরের নির্ধারিত একটি সময়ে ঐ কোচে চেপে লন্ডনের মেয়র শহর প্রদক্ষিণে বের হতেন। তার সেই শোভাযাত্রার মূল আকর্ষণ ছিল এই কোচ, যেটি টেনে নিত ৬টি স্বাস্থ্যবান ঘোড়া। নওয়াব শামস-উদ-দৌলার গাড়িটি অবশ্য টেনে নিয়ে গেল ৪টি ডন ঘোড়া। নওয়াবের ঘোড়ার গাড়ি বিষয়ে হেবারের বর্ণনার সাথে মান্ডির বিবরণের বেশ কিছু অমিল লক্ষণীয়। হেবার গাড়িটিকে উল্লেখ করেছেন পুরাতন ল্যান্ডো হিসেবে, যা নওয়াবের পূর্বেও কেউ ব্যবহার করেছিল। এ ছাড়াও হেবার তার ভ্রমণকথায় বর্মিদের সাথে নওয়াবের সম্পর্ক নিয়ে ইংরেজদের সন্দেহের কথা উল্লেখ করেছেন। অপর দিকে মান্ডি এ গাড়িটিকে শুধু ইংরেজদের দেওয়া উপহার হিসেবে উল্লেখ করেছেন তা-ই নয়; উপহারের কারণ হিসেবে জানিয়েছেন অ্যাংলো-বার্মা যুদ্ধের সময় ঢাকা থেকে হাতি সরবরাহ করে ইংরেজদের সহায়তা করবার কথা।
নায়েবে নাজিমের প্রাসাদে বিশাল নৈশভোজ শেষে নাচের আয়োজন ছিল। নিমতলি থেকে বজরায় ফিরতে রাত ২টা বেজে গেল। আগের রাতের ক্লান্তি কাটাবার জন্য সৈন্যদল অবশ্য পর্যাপ্ত বিশ্রামের সুযোগ পেল না। পরদিন ভোরে ড্রামের শব্দে সচকিত হয়ে উঠল সকলে। ঢাকা ছাড়বার সময় হয়েছে। তড়িঘড়ি সামরিক পোশাক পরে তৈরি হয়ে নিলেন সকলে। নৌবহর যাত্রা করল নতুন গন্তব্যের উদ্দেশে। তবে মেঘনায় পৌঁছে নৌবহর দুটা ভাগে ভাগ হয়ে গেল। লর্ড কম্বারমেয়ার গরমের সময়টুকু সমুদ্রতীরের জনপদগুলোতে কাটিয়ে দেবার পরিকল্পনা করেছিলেন। বিশেষভাবে এপ্রিল, মে, জুন- এই তিন মাসের তীব্র দাবদাহ থেকে বাঁচবার জন্য তিনি এমনটা ভেবে রেখেছিলেন। সে কারণে ঢাকায় এসে বজরা বদলে সংগ্রহ করেছিলেন বড় আকারের অনেকগুলো পিনিশ নৌকা। লর্ডের নেতৃত্বে নৌবহর চলল চট্টগ্রামের উদ্দেশে। অপর দিকে মান্ডির নৌবহর সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে ফিরে চলল কলকাতা। সেই বহর ২৭ মার্চ হুগলি নদী থেকে বেরিয়ে টলির নালা ধরে পৌঁছে গেল নতুন তৈরি খিদিরপুর সেতুর গোড়ায়। সেখানেই নৌঙর ফেলল মান্ডির বজরা।
পরিশেষে একটি বিষয়ে আলোকপাত করা জরুরি। রাজমহল ত্যাগের পর থেকে কলকাতায় ফিরে যাওয়া পর্যন্ত কালকে আমরা যদি পূর্ব বাংলায় মান্ডির ভ্রমণকাল হিসেবে বিবেচনায় আনি, তবে তা মাসখানেকের কম না। সফরের নানা বিষয়ে মান্ডির আঁকা ২৬টি ছবি খেয়াল করলে দেখা যায়, সেখানে ঢাকা বিষয়ে কোনো ছবি নেই। কেন আঁকেননি অথবা কোনো ছবি থাকলেও তা কেন মূল বইতে অন্তর্ভুক্ত করেননি, তার উত্তর এখন আর পাওয়া সম্ভব নয়। তবে এ বিষয়ে মান্ডির ইশারা রেখে গেছেন তার ভ্রমণ কথায়। তিনি লিখেছেন স্যার চার্লস ডয়লির অপূর্ব সব ড্রয়িংয়েই ঢাকার সৌন্দর্যের সত্যিকারের প্রতিফলন ঘটেছে; ঢাকার ছবি আঁকবার জন্য নতুন করে তার পেন্সিল ধরবার প্রয়োজন নেই।
সহায়ক সূত্র:
১. Pen and Pencil Sketches in India: Journal of a Tour in India by G.C.Mundy, John Murray,
London, 1832.
২. Unpublished views of Dhaka (Dacca) by Sir Charles D'Oyly, 7th Baronet by Joachim K
Bautze, Kaveri Books, New Delhi, 2007.
৩. Under the Indian Sun: British Landscape Artists edited by Pauline Rohatgi and Pheroza
Godrej, South Asia Books, Columbia, 1996.