দূর থেকে শুনতে পাচ্ছি নজরুলের লেখা সে গান!
খুব ছোট থেকেই দেখেছি, আমাদের পরিবারে ঈদ একটা গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। সারা বছর পথ চেয়ে থাকি এই দিনটার জন্য। আমাদের বাড়ি প্রায় পুরুষানুক্রমে সহায়িকার কাজ করেন আঞ্জু কাকিমার পরিবার। পূজোর ঘরের কাজ থেকে ঘরদোর পরিস্কার…সব। আমার ঠাকুমার আমল থেকে। তাঁদের বাড়ি ঈদের দুধসাদা চালের রুটি, লাচ্চা আর মাংস খেয়ে বেড়ে উঠেছি।
একটু বড় হতে না হতে রাবুল, মনজুরদের বাড়ি যেতে হত। মনজুরদের বাড়ি অনেক দূর। তবু না গেলে রাগ করে…তুই আসবি না তো! তাহলে আমি আর তোর বাড়ি যাব না। এ বড় মুশকিল। এদিকে খেজের কাকু, আলিম কাকুরাও যে নেমন্তন্ন করেছে। কাকে ছেড়ে কার বাড়ি যাই!
যারা ঈদের নেমন্তন্ন খেতে যান, সবাই জানেন এক বাড়ি গেলেই এত্ত খাইয়ে দেবে যে পেট ফাটুম ফাটুম। তাই কয়েক বছর ধরে আমরা খেপে খেপে দু তিনদিনে নেমন্তন্ন খেতে যাই।
ইদানিং তিন্নির বন্ধু আক্রামুলের বাড়ি যেতেই হবে…আর পুরোনোগুলো তো আছেই। যেমন এই ঈদে আমাদের প্রায় পাঁচ ছয় বাড়ি রাতে খাবার নেমন্তন্ন। যেখানে যেতে পারব না, দেখব দুপুর হতে না হতে টিফিন কৌটো ভরে খাবার চলে আসবে। আর বিজয়ার মত কোলাকুলি আছেই।
'ঈদ' শব্দটি আরবি, শব্দ মূল 'আউদ'। এর অর্থ এমন উৎসব যা ফিরে ফিরে আসে, পুনরায় অনুষ্ঠিত হয়, রীতি হিসেবে গণ্য হয় প্রভৃতি। এর অন্য অর্থ খুশি-আনন্দ। উচ্ছল-উচ্ছ্বাসে হারিয়ে যাওয়ার মুহূর্ত।
ঈদ-উল-ফিতর প্রতিবছর চান্দ্র বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী শাওয়াল মাসের ১ তারিখে নির্দিষ্ট রীতিতে এক অনন্য আনন্দ-বৈভব বিলাতে ফিরে আসে। এক মাস কঠোর সিয়াম সাধনার মাধ্যমে নানা নিয়মকানুন পালনের পর মুসলিম বিশ্বে উদযাপিত হয় ঈদ-উল-ফিতর; অন্য কথায় রোজার ঈদ।
'ফিতর' শব্দের অর্থ ভেঙে দেওয়া। আরেক অর্থে বিজয়। দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার পর যে উৎসব পালন করা হয়, তা-ই ঈদ-উল-ফিতরের উৎসব। বিজয় শব্দটি ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। রমজান মাস রোজা রেখে আল্লাহ-ভীরু মানুষ তার ভেতরের সব ধরনের বদভ্যাস ও খেয়াল-খুশিকে দমন করার মাধ্যমে একরকমের বিজয় অর্জন করে। সব মিলিয়ে ঈদ-উল-ফিতরকে বিজয় উৎসব বলাই যেতে পারে।
ঈদ-উল-ফিতরের প্রতিটি অনুশাসনে ইবাদতের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়, তা ছাড়া এ দিন প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে সত্যনিষ্ঠ জীবনযাপনের তাগিদ এবং মানবতার বিজয় বার্তা। তবে প্রচলিত নিয়মে দীর্ঘ এক মাস রোজা রাখার পর আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে দিনটিকে স্মরণীয় করার নাম ঈদ উৎসব।
'ঈদুল ফিতর' শব্দ দুটিও আরবি। যার অর্থ হচ্ছে—উৎসব, আনন্দ, খুশি ও রোজা ভঙ্গকরণ প্রভৃতি। সুদীর্ঘ একটি মাস কঠোর সিয়াম সাধনা ও ইবাদত-বন্দেগির পর বিশ্ব মুসলিম উম্মাহ রোজা ভঙ্গ করে আল্লাহর বিশেষ নিয়ামতের শুকরিয়াস্বরূপ ধরণীতে যে আনন্দ-উৎসব পালন করেন, সেটিই ঈদ-উল-ফিতর।
ঈদের সঙ্গে একেবারে অবিচ্ছিন্ন হয়ে জড়িয়ে আছে ঈদের গান। একটা গল্প মনে পড়ল। ১৯৩১ সাল। সামনের ঈদে আব্বাসউদ্দিন নতুন গান রেকর্ড করবেন। তিনি নজরুলকে এসে ধরলেন নতুন গান লিখে দিতে হবে ঈদ নিয়ে। নজরুল রাজি। গান তো লিখে দিলেনই, আবার সুরও দিয়ে দিলেন।
চারদিন পর শিল্পী আব্বাস উদ্দিনের গলায় গানটি রেকর্ড করা হয়। রেকর্ড করার দুই মাস পরে ঈদের ঠিক আগে আগে এই রেকর্ড প্রকাশ পেল। প্রকাশ করলেন গ্রামাফোন কোম্পানি। রেকর্ডের অন্য গানও নজরুলের…'ইসলামের ঐ সওদা লয়ে এলো নবীন সওদাগর, বদনসীন আয়, আয় গুনাহগার নতুন করে সওদা কর। হিজ মাস্টার্স কোম্পানির রেকর্ড নম্বর এন- ৪১১১।
এই রেকর্ডে যে গানটা চিরকালের ইতিহাসে ঢুকে গেল সেটা হলো-
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ
তুই আপনাকে আজ বিলিয়ে দে, শোন আসমানী তাগিদ।
তোর সোনা-দানা, বালাখানা সব রাহে লিল্লাহ
দে যাকাত, মুর্দা মুসলিমের আজ ভাঙাইতে নিঁদ
ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ।
দূর থেকে কানে শুনতে পাচ্ছি ওটাই। আমার ঈদ উদযাপন শুরু। সবাই ভাল থাকুন। সবার ভাল হোক…ঈদ কিন্তু সেটাই শেখায় আমাদের।
- কৌশিক মজুমদার: ভারতীয় বিজ্ঞানী ও লেখক
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফলন। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।