আফ্রিকায় মার্কিন প্রভাব হ্রাস; বেড়েছে ওয়াগনার গ্রুপের কর্তৃত্ব
ফাঁস হওয়া গোপন মার্কিন নথি অনুযায়ী, আফ্রিকায় পশ্চিমা-বিরোধী রাষ্ট্রগুলোকে নিয়ে একটি 'কনফেডারেশন' প্রতিষ্ঠার জন্য দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে কাজ করে যাচ্ছে রাশিয়ান মার্সেনারি বাহিনী ওয়াগনার গ্রুপ। মস্কোর মিত্রদেরকে শক্তিশালী করার জন্য সামরিক এবং গুপ্তচরীয় ক্ষমতা ব্যবহার করে অস্থিতিশীলতা তৈরি করছে তারা।
আফ্রিকায় রুশ প্রভাবের এই দ্রুত সম্প্রসারণ মার্কিন গোয়েন্দা ও সামরিক কর্মকর্তাদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলেছে। এ কারণে গত বছরজুড়ে ওয়াগনার গ্রুপের ব্যবসার নেটওয়ার্কের ওপর অবরোধ, নিষেধাজ্ঞা এবং সাইবার অপারেশনের মাধ্যমে ধাক্কা দেওয়ার উপায় খুঁজে চলেছে মার্কিনরা।
ওয়াগনার নেতা ইয়েভজেনি প্রিগোজিন যখন ইউক্রেন যুদ্ধে এই প্যারামিলিটারি গ্রুপের গভীর সম্পৃক্ততা নিয়ে ক্রেমলিনের সাথে অন্তর্দ্বন্দ্বে ব্যস্ত, তখনই মার্কিন কর্মকর্তারা ওয়াগনারের এই সম্প্রসারিত বিশ্বব্যাপী কার্যক্রমকে একটি সম্ভাব্য হুমকি হিসেবে তুলে ধরেছেন।
ফাঁস হওয়া একটি নথি থেকে পাওয়া যায়, ওয়াগনার গ্রুপের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত করার জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাদের সহযোগী দেশগুলোকে নিয়ে একত্রে কাজ করার চেষ্টা করছে। ইউক্রেনে ওয়াগনার কমান্ডারদের হত্যা করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র টার্গেট ব্যক্তিদের সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করেছে। এবং আফ্রিকাতেও ওয়াগনার গ্রুপের বিরুদ্ধে অনুরূপ প্রাণঘাতী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য সহযোগী দেশগুলোর ইচ্ছা আছে কিনা তা জানতে চেয়েছে।
এবং এতকিছুর পরেও গত ছয় বছর ধরে সিআইএ, পেন্টাগনসহ অন্যান্য এজেন্সিগুলো ওয়াগনার গ্রুপের তেমন বড় ক্ষতি করতে পারেনি। এ সময়ের মধ্যে 'পুতিনের শেফ' প্রিগোজিনের নিয়ন্ত্রিত ভাড়াটে বাহিনীটি অন্তত ৮টি দেশে নিজেদের শক্ত অবস্থান প্রতিষ্ঠা করেছে, কার্যক্রম চালিয়েছে মোট ১৩টি দেশে।
ফাইলগুলো থেকে মাত্র একটি সফল সামরিক স্ট্রাইকের উল্লেখ পাওয়া যায়, যেখানে 'লিবিয়াতে ওয়াগনার গ্রুপের একটি লজিস্টিক বিমান ধ্বংস করা হয়েছে।' কিন্তু ওয়াগনার গ্রুপের বিশাল বহরের মধ্যে কেন কেবল এই একটি বিমানকেই আক্রমণ করা হয়েছে সে ব্যাপারে স্পষ্ট এবং বিস্তারিত কিছু পাওয়া যায়নি।
ওয়াগনার গ্রুপের বিরুদ্ধে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য মার্কিন আক্রমণটি ছিল ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, সিরিয়ার দেইর আল-জোরের কাছে। এই ঘটনায় মার্কিন বিমান হামলায় কয়েক শতাধিক ওয়াগনার যোদ্ধা নিহত হয়েছিল, যারা একটি গ্যাস প্ল্যান্টের পাশে থাকা ডেল্টা ফোর্স, রেঞ্জার এবং কুর্দিদের সম্মিলিত বাহিনীকে আক্রমণ করেছিল।
সামগ্রিকভাবে, নথিগুলো ওয়াগনারকে আফ্রিকায় একটি উঠতি শক্তি হিসাবে চিত্রিত করেছে। ইউক্রেনের যুদ্ধ ক্রেমলিনের জন্য বড় সমস্যা হয়ে ওঠার মুহূর্তেও আফ্রিকায় নিজেদের ক্ষমতা ও প্রভাব বিস্তার করে চলেছে ওয়াগনার গ্রুপ।
একটি গোয়েন্দা ডকুমেন্টের উপসংহারে বলা হয়েছে, "এর ফলে প্রিগোজিন সম্ভবত একাধিক দেশে তার নেটওয়ার্ককে আরও সম্প্রসারিত করবে। আফ্রিকায় ওয়াগনারের কার্যক্রম চলা প্রতিটি দেশে তাদের কার্যক্রম আরও বাড়াতে দেশটিকে বাধ্য করবে এবং এর প্রতিবেশী দেশগুলোতেও অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করতে ভূমিকা রাখবে।"
ত্রিপোলি-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক সাদেক ইনস্টিটিউটের পরিচালক আনাস এল গোমতি বলেছেন, "ওয়াগনারের উত্থান আফ্রিকায় ক্ষমতার প্রতিযোগিতার নতুন যুগের শুরু করবে এবং এর সাথে সাথে কর্তৃত্ববাদের পুনরুত্থান শুরু হবে।"
"আফ্রিকান স্বৈরশাসকরা যে ধরনের সমস্যার মধ্যে নিজেকে খুঁজে পেয়েছেন তার একটি ভালো সমাধান হলো ওয়াগনার গ্রুপ। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনা? সমস্যা নেই। ওয়াগনার আপনাকে এ কাজে সাহায্য করবে, হোক ব্যালটের সাথে কারচুপি কিংবা মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্র বা দক্ষিণ লিবিয়ার মতো অঞ্চলে বিদ্রোহীদের সাথে সরাসরি যুদ্ধ।"
"দেশের সম্পদ এবং খণিজ সম্পদগুলো বের করে আনা সম্ভব হচ্ছে না? হোক সেটি প্রযুক্তি বা অর্থাভাব? সমস্যা নেই। ওয়াগনার গ্রুপ সে কাজেও আপনাকে সাহায্য করবে। এই কাজের জন্য প্রয়োজনীয় ডলার পৌঁছে যাবে দেশটির ব্যাংকে। কারণ ওয়াগনার শেল কোম্পানিগুলোর এক বিশাল নেটওয়ার্ক পরিচালনা করে থাকে।"
প্রিগোজিনের ওয়াগনার গ্রুপ গত বছরে আফ্রিকায় শুধু তাদের কার্যক্রমের গতি বাড়িয়েই ক্ষান্ত থাকেনি, বরং আরও উচ্চাকাঙ্ক্ষা এবং প্রভাবের সাথে কাজ করছে বলে মনে হচ্ছে। তারা প্রথমে নিরাপত্তাশূণ্যতার কারণ দেখিয়ে অঞ্চলে কাজ শুরু করলেও তাদের অবস্থান ধরে রাখার জন্য তারা ইচ্ছাকৃতভাবে দেশটিতে অস্থিরতা তৈরি করতে চাইছে বলে মার্কিন নথিগুলোতে উঠে এসেছে।
জয়েন্ট চিফস অফ স্টাফের চেয়ারম্যান জেনারেল মার্ক এ. মিলি এবং তার সিনিয়র উপদেষ্টাদের জন্য প্রস্তুত করা এক ফাঁস হওয়া প্রেজেন্টেশন স্লাইড থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়। স্লাইডটির ফুটনোটে উল্লেখ করা হয় বুরকিনা ফাসো, ইরিত্রিয়া, গিনি, মালিসহ বেশ কিছু দেশে মার্কিন ও ফরাসি প্রভাব কমানোর জন্য খুবই আক্রমণাত্মক পরিকল্পনা করছে 'ওয়াগনার গ্রুপ'। একইসাথে শাদে অভ্যুত্থানের জন্য বিদ্রোহীদেরকে আন্তঃসীমান্ত প্রশিক্ষণ দিচ্ছে তারা।
ফরাসি এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সমর্থনে শাদ সরকার সাহেলের সশস্ত্র ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছিল। আর এর প্রমাণ পাওয়া যায় যখন ফরাসি রাষ্ট্রপ্রধান ইমানুয়েল মাখো ২০২১ সালে ইদ্রিস ডেবির অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে এসেছিলেন।
একটি নথি থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায় যে, "যদি ওয়াগনার গ্রুপ শাদে অভ্যুত্থানে সাহায্য করে, তবে তারা ওয়াগনারের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ করবে।"
এদিকে ওয়াশিংটন পোস্টের পক্ষ থেকে প্রিগোজিনকে ফাঁস হওয়া ডকুমেন্ট সম্পর্কে মন্তব্য করতে বলা হলেও তিনি জবাব দেননি। এর আগে শাদ সম্পর্কে প্রশ্নের জবাবে ওয়াশিংটন পোস্টকে তিনি বলেছিলেন যে, "অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে অস্থিতিশীল করার ক্ষেত্রে তার ভূমিকা রয়েছে, এমন কথাবার্তা 'হাস্যকর'।"
ডিসকর্ড লিকস
প্রিগোজিন টেলিগ্রামে দাবি করেছেন যে, আফ্রিকায় তার অপারেশনগুলো 'সৎ এবং ন্যায্য'। তার অপারেশনগুলো কেবল 'ডাকাত, সন্ত্রাসী এবং প্রতিবেশীদের মাধ্যমে নিপীড়িত আফ্রিকান জনগণকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।"
"কিন্তু লিবিয়ায় ওয়াগনারের হস্তক্ষেপ দেশটিকে বিভক্ত ও পঙ্গু করে দিয়েছে", বলে মন্তব্য করেন এল গোমতি।
"লিবিয়ায় কাজ করা গোষ্ঠীগুলোর মধ্যে তারাই সম্ভবত সবচেয়ে অস্থিতিশীল অবস্থা তৈরি করে রেখেছে। তারা প্রায়ই এই ধরনের সহিংসতা চালায়। ফলে শান্তির সময় হোক বা যুদ্ধের সময়, আপনি কোনো স্থিতিশীল অবস্থায় থাকার অনুভূতি পাবেন না।"
ওয়াগনারের গুরুত্ব বোঝানোর জন্য প্রিগোজিন গত শুক্রবার সুদানে শান্তি ফিরিয়ে আনার প্রস্তাব করেছেন। ক্ষমতা নিয়ে দেশটির সেনাবাহিনী এবং আধা-সামরিক বাহিনী আরএসএফ নিজেদের মধ্যে সহিংসতা শুরু করার পর পূর্ব আফ্রিকান দেশটি গৃহযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে চলে গিয়েছে।
"বিদ্যমান দ্বন্দ্ব সমাধানে এবং সুদানের ভবিষ্যত সমৃদ্ধির জন্য আমি মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত," বলে তার প্রেস অফিস থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে জানান প্রিগোজিন। চিকিৎসাসামগ্রী এবং 'ভোগান্তির শিকার সুদানবাসীদের জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু' নিয়ে বিমান পাঠাতে প্রস্তুত বলেও দাবি করেছেন তিনি।
'একটি বিশেষ ভয়ঙ্কর রাশিয়ান সংস্থা'
স্নায়ুযুদ্ধের সময়ে আফ্রিকাজুড়ে বিভিন্ন ধরনের প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়েছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু স্নায়ুযুদ্ধ শেষ হলে রাশিয়া আফ্রিকা থেকে পিছু হটে, জায়গা করে দেয় চীনের জন্য। চীন তাদের অবকাঠামো নির্মাণ এবং সস্তা ঋণের সুযোগ নিয়ে হাজির হয়, পশ্চিমাদের মানবাধিকার রক্ষা কিংবা গণতান্ত্রিক অগ্রগতির টিকিয়ে রাখার চাপ ছাড়াই।
কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আফ্রিকায় রাশিয়ার এই প্রত্যাবর্তন এবং তাদের সামরিক ও রাজনৈতিক প্রভাব আফ্রিকায় এক নতুন প্রতিযোগিতার সূচনা করেছে। ঔপনিবেশিক আমলে আফ্রিকান সম্পদের জন্য প্রতিযোগিতাকে স্মরণ করিয়ে দেয় এটি। মার্কিন নথি অনুযায়ী, ইকুয়েটরিয়াল গিনির এক কর্মকর্তা এ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, "আফ্রিকা হলো এক সুন্দরী নারী, যাকে বিয়ে করতে অনেকে ঘোরাফেরা করছে।"
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের আফ্রিকান প্রোগ্রাম ডিরেক্টর মুরিথি মুতিগা জানান, "স্নায়ুযুদ্ধের সমাপ্তির পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফ্রিকার প্রতি কম আগ্রহী হয়ে ওঠে। একে একটি অগুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল হিসেবে কার্যক্রম কমিয়ে আনে তারা। কোথাও কোথাও মানবিক সাহায্য করা, কয়েক জায়গায় গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার জন্য হালকা চাপ প্রয়োগ করা, এই ছিল মার্কিনদের সর্বোচ্চাগ্রহ। আফ্রিকাকে তেমন গুরুত্ব না দেওয়ার ফলে এই ফাঁকা জায়গাটি অন্যরা এসে দখল করার সুযোগ পেয়েছে।"
ফাঁস হওয়া একটি নথি অনুযায়ী, ওয়াগনার সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক লিবিয়া এবং সুদানে সম্পদ আহরণ করছে। এছাড়াও রাশিয়ান অস্ত্র, পারমাণবিক জ্বালানি প্রযুক্তি এবং নিরাপত্তা চুক্তির একটি বড় বাজার সোনা, ইউরেনিয়ামসহ অন্যান্য সম্পদসমৃদ্ধ আফ্রিকা। নথি অনুসারে, ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ পোর্ট সুদানে একটি নৌ ঘাঁটি সম্পূর্ণ করার বিষয়ে রাজি করানোর জন্য রাশিয়া সুদানের সামরিক নেতাদের ওপর তাদের প্রভাবকে কাজে লাগিয়েছে।
মস্কো যখন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সমালোচনার বিরুদ্ধে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করছে, তখন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ এই বছর মালি, সুদান, দক্ষিণ আফ্রিকা, এসওয়াতিনি, অ্যাঙ্গোলা, ইরিত্রিয়াসহ একাধিক আফ্রিকান দেশ সফর করেছেন। আগামী জুলাই মাসে সেন্ট পিটার্সবার্গে আফ্রিকান নেতাদের সাথে শীর্ষ বৈঠক করবেন পুতিন।
এই বছরের জানুয়ারি মাসেই মার্কিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওয়াগনারকে একটি আন্তর্জাতিক অপরাধী সংস্থা হিসেবে চিহ্নিত করেছে। তাদের মতে, ওয়াগনার গ্রুপ 'গুরুতর অপরাধের সাথে জড়িত, যার মধ্যে রয়েছে সাংবাদিক, সাহায্য কর্মী ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সদস্যদের ওপর সহিংস হয়রানি; সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষীদের হয়রানি, বাধা এবং ভয় দেখানো এবং মালিতে ধর্ষণ ও হত্যার মতো অপরাধ'।
সিআইএ ডিরেক্টর উইলিয়াম জে বার্নস গত ফেব্রুয়ারিতে জর্জটাউন ইউনিভার্সিটিতে বক্তব্যের সময় ওয়াগনারকে 'বিশেষ ভয়ঙ্কর রাশিয়ান সংস্থা' হিসেবে বর্ণনা করেন। তিনি জানান, "ওয়াগনার মালি এবং বুরকিনা ফাসোসহ বেশ কিছু জায়গায় তাদের প্রভাব বিস্তার করছে। এটি বেশ উদ্বেগজনক ব্যাপার। আমরা এটি মোকাবেলায় কঠোর পরিশ্রম করছি, কারণ তারা আফ্রিকানদের জন্য হুমকিস্বরূপ।"
অলিগার্ক এবং পুতিনের ঘনিষ্ঠ মিত্র হয়ে ওঠা জেল খাটা প্রিগোজিন প্রথমে অস্থিতিশীল অবস্থা চলা আফ্রিকান দেশগুলোকে টার্গেট করেন। বিদ্রোহ বা অস্থিরতার শিকার হওয়া দেশগুলোর নেতাদের নিরাপত্তা, সামরিক সহায়তা, রাজনৈতিক পরামর্শ, পোলিং এবং রাজনৈতিক ম্যানিপুলেশনের কৌশল প্রদান করে তারা, এর বিনিময়ে বিদ্রোহ চলা অঞ্চল থেকে সম্পদ আহরণ করার চুক্তি আদায় করে নেয় তারা, যেসব সহিংস অঞ্চলে অন্যান্য বড় পশ্চিমা কোম্পানিগুলো কাজ করতে আগ্রহী নয়।
লন্ডন-ভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক চ্যাথাম হাউসের আফ্রিকা প্রোগ্রামের প্রধান অ্যালেক্স ভাইনস জানান, "রাশিয়ানরা খুব সুবিধাবাদী এবং খুব কম খরচে বেশি লাভ করতে চায়। এবং তারা নিজেদের জন্য আরও সুবিধা তৈরি করতে পারে কিনা সে জন্য তারা অঞ্চলকে আরও অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করে। এভাবে তারা বিভিন্ন জায়গায় সুবিধাবাদী অপকর্ম চালিয়ে যায়।"
২০২০ সালে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিকে ওয়াগনার বাহিনী রাজধানী থেকে বিদ্রোহীদেরকে তাড়িয়ে দিয়ে দেশটির সরকারকে সাহায্য করেছিল; একইসাথে দেশটির রাষ্ট্রপ্রধান ফাউস্টিন-আর্চেঞ্জ তোয়াদেরার নিরাপত্তা প্রদান করেছিল তারা। স্টেট ডিপার্টমেন্ট অনুযায়ী, তোয়াদেরার রুশ নিরাপত্তা উপদেষ্টা ভিটালি পারফিলভ নিজেই একজন ওয়াগনার কর্মকর্তা। দেশটিতে ওয়াগনার গ্রুপ ইতিমধ্যেই খণিজ সম্পদ, বন সম্পদসহ অন্যান্য খাতে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছে।
ফরাসি সংবাদপত্র লা মন্ডের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, মার্কিন কর্মকর্তারা গত ডিসেম্বর মাসে ইউএস-আফ্রিকা শীর্ষ সম্মেলনের সময় তোয়াদেরাকে ওয়াগনারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে মার্কিন সামরিক প্রশিক্ষণ এবং মানবিক সহায়তা বৃদ্ধির চুক্তির প্রস্তাব দেয়।
এর জবাবে পারফিলভ দেশটির গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমে আমেরিকা বিরোধী বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা চালায়। নথিতে বলা হয়েছে, পারফিলভ দাবি করেছেন যে, ওয়াশিংটন দেশটির মন্ত্রীদেরকে ঘুষ দিয়েছে এবং তারা দেশটির খনিজ সম্পদ লুণ্ঠনের চেষ্টা করছে।
বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়া আফ্রিকান নেতাদের সাথে প্রাক্তন সোভিয়েত সম্পর্কের সুবিধা নিয়েছে। তবে এটি আফ্রিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষয়িষ্ণু সম্পর্কের সুবিধাকেও কাজে লাগিয়েছে, বিশেষ করে ট্রাম্পের শাসনামলে। এছাড়াও আফ্রিকার দেশগুলোর ফরাসি-বিরোধী মনোভাবও কাজে লাগিয়েছে তারা। ফ্রান্সের বাহিনী তখন সাহেল অঞ্চলে সন্ত্রাস-বিরোধী অভিযান 'অপারেশন বারখানে' চালাচ্ছিলো।
২০২১ সালে মালি থেকে তার বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয় ফ্রান্স, এরপরেই ওয়াগনারের মার্সেনারি বাহিনী সেই জায়গা দখল করে নেয়। এরপর ডিসেম্বরে সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক থেকেও তাদের বাহিনী প্রত্যাহার করে নেয়। বিশ্লেষকদের মতে, ওয়াগনার 'স্টেট ক্যাপচার' করে ফেলেছে। এদিকে ফেব্রুয়ারি মাসে বুরকিনা ফাসোও ফরাসি সেনাদেরকে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেয়।
"ট্রল ফ্যাক্টরি এবং জাল মিডিয়ার মাধ্যমে রাশিয়া আফ্রিকায় ফ্রান্সবিরোধী মনোভাব তৈরি করতে সফল হয়েছে। এটি আগেও যে ভালো ছিল তা নয়, তবে ট্রলিংয়ের মাধ্যমে একে আরও চরম পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছে তারা," বলে জানান ভাইনস। "সাহেল এমনিতেই একটি অস্থিতিশীল অঞ্চল। বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্য নয়, বরং এই অঞ্চলই ইসলামি জঙ্গিবাদ তথা ইসলামিক জিহাদিদের সবচেয়ে বড় হটস্পট। তাই রাশিয়াও এর ফায়দা লুটছে।"
রাশিয়ানদের ফরাসি-বিরোধী এবং পশ্চিমা-বিরোধী প্রচারণা আফ্রিকান নেতাদেরকে আরও প্রভাবিত করেছে, কারণ তারা ইতিমধ্যেই পশ্চিমা নেতাদের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ এবং মানবাধিকার নিয়ে চাপ দেওয়ায় ক্লান্ত, একইসাথে সাহেল অঞ্চলেও ফরাসিদের ভুল পদক্ষেপে তারা ক্ষুব্ধ।
মুতিগা জানান, "আফ্রিকার অভিজাতদের কাছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো তাদের পুরনো 'গণতন্ত্রীকরণ এবং মানবিক সহায়তা'র মোড়কে আটকে আছে। একইসাথে তাদের কাছে ওয়াশিংটনের এই গণতান্ত্রিক মোড়ক আর আকর্ষণীয় কিছু নয়।
"সাম্প্রতিক সময়ে আমেরিকা তার নিজের গণতন্ত্রের সুনাম হারিয়েছে। তবে এটি কেবল ট্রাম্পের কারণে নয়, বরং বিশৃঙ্খল রাজনীতির কারণে। ট্রাম্পের নির্বাচনের ফলাফল প্রত্যাখ্যানেরও একটি বড় প্রভাব আছে।"
এদিকে বেশ কয়েকজন বিশ্লেষকের মতে, চীনের অবকাঠামো নির্মাণ এবং ঋণের বিশাল কর্মযজ্ঞের তুলনায় আফ্রিকায় মার্কিন বিনিয়োগ একেবারেই অপ্রতুল। এদিকে রাশিয়াও অন্যান্য আফ্রিকান নেতাদের কাছে নিজেকে একটি বিকল্প পথ হিসেবে তুলে ধরছে, যারা ওয়াশিংটন, বেইজিং বা মস্কোর মধ্যে কোনো একটি পক্ষ বেছে নিতে চান না।
সূত্র: ওয়াশিংটন পোস্ট