বন্যপ্রাণী পাচারকারীদের ধরতে সাহায্য করবে দৈত্যাকার ইঁদুর!
আফ্রিকার জায়ান্ট পাউচড ইঁদুরকে দেখতে আকর্ষণীয় কিনা তা নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে। কিন্তু এদের তীক্ষ্ণ ঘ্রাণশক্তি নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়।
তানজানিয়া-ভিত্তিক অলাভজনক সংস্থা এপোপো ইতোমধ্যেই এসব বিড়ালের আকৃতির ইঁদুরদের সক্ষমতা দেখিয়ে দিয়েছে। তারা এসব ইঁদুরকে 'হিরোইঁদুর' বলে ডাকে। এরা ল্যান্ডমাইন, যক্ষ্মা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে পড়া জীবিত মানুষকেও শনাক্ত করতে সক্ষম।
এখন সংস্থাটি বৈশ্বিক অবৈধ বন্যপ্রাণী বাণিজ্যের দিকে মনোযোগ দিচ্ছে এবং তাদের ইঁদুরদের ঘ্রাণশক্তিকে এ কাজে ব্যবহার করার পরিকল্পনা করছে।
প্রতিবছর প্রায় ২৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের এই বন্যপ্রাণী পাচার করা হয়। বিশ্বব্যাপী চতুর্থ বৃহত্তম অবৈধ বাণিজ্য শিল্প। এর আগে রয়েছে জাল পণ্য, মাদক এবং মানব পাচার।
ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড ইউএসের নেচার ক্রাইম ও পলিসি অ্যাডভোকেসির সহ-সভাপতি ক্রফোর্ড অ্যালানের বন্যপ্রাণী সংক্রান্ত অপরাধ নিয়ে ৩০ বছরেরও বেশি কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে। তিনি বলেন, "বন্যপ্রাণীকে সাধারণত কম ঝুঁকিপূর্ণ পণ্য হিসেবে গণ্য করা হয়। দুর্ভাগ্যবশত, সংগঠিত অপরাধ চক্রগুলো বুঝতে পেরেছে যে বন্দরে, সমুদ্রবন্দরে এবং বিমানবন্দরে শনাক্তকরণ ব্যবস্থায় প্রকৃতপক্ষে দুর্বলতা রয়েছে, বিশেষ করে আফ্রিকায়।"
তিনি ব্যাখ্যা করেন বলেন, পাচারকারীরা বন্যপ্রাণীর পণ্যগুলোকে বিভিন্ন কৌশলে লুকিয়ে রাখে। উদাহরণস্বরূপ, হাতির দাঁতকে কাঠের মতো দেখাতে দাগানো হতে পারে, ফসলের চালানে লুকিয়ে রাখা হতে পারে, এমনকি চকলেট বার আকৃতিতে কেটে চকোলেটের প্রলেপ দিয়ে মোড়ানো হয়, যাতে চাক্ষুষ এবং এক্সরে পরীক্ষা এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়।
অপরাধ শনাক্তে ইঁদুরের ঘ্রাণশক্তি
এখানেই আসে ইঁদুর এবং তাদের তীক্ষ্ণ ঘ্রাণশক্তির ভূমিকা। এপোপো'র নেতৃত্বে করা নতুন এক গবেষণা প্রকাশ হয়েছে ফ্রন্টিয়ার্স ইন কনজারভেশন সায়েন্স জার্নালে। সেখানে বলা হয়েছে যে গবেষণা কেন্দ্রের এ ইঁদুরগুলোকে সফলভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তারা হাতির দাঁত, গন্ডারের শিং, বনরুইয়ের আঁশ এবং আফ্রিকান ব্ল্যাকউড শনাক্ত সক্ষম। গবেষণার সঙ্গে সম্পৃক্ত না থেকেও ক্রফোর্ড অ্যালান এ সম্পর্কে বলেন, আফ্রিকা থেকে পাচারকৃত সবচেয়ে সাধারণ বন্যপ্রাণী পণ্যের মধ্যে এ ইঁদুরগুলো অন্যতম।
এ প্রকল্পের প্রধান ড. ইজি সজট ইঁদুরকে বন্যপ্রাণী চোরাচালান শনাক্তকরণে ব্যবহৃত কুকুরের "পরিপূরক হাতিয়ার" হিসেবে ব্যবহারের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, "কুকুর আশ্চর্যজনক। যদি আপনি তানজানিয়ার সেরেঙ্গেটিতে চোরাচালান সনাক্ত করতে যান, সেখানে অবশ্যই ইঁদুর ব্যবহার করবেন না।"
তবে তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, "ইঁদুরখুব ছোট এবং চটপটে হওয়ার কারণে, ঘন জায়গার মধ্যে প্যাকিং করা কনটেইনারে তারা সহজেই প্রবেশ করতে পারে।
সজট আরও দাবি করেন, কুকুরের বিপরীতে ইঁদুররা একাধিক হ্যান্ডলারের সাথে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তাছাড়া তাদের ছোট আকৃতির জন্য প্রশিক্ষণ, রক্ষণাবেক্ষণ এবং পরিবহন খরচও তুলনামূলক কম। এটি বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বন্যপ্রাণী পাচারের বেশিরভাগ অংশই বিশ্বের দরিদ্রতম অঞ্চলগুলো থেকে আসে।
ক্রফোর্ড অ্যালান মনে করেন, পাচারকৃত বন্যপ্রাণী সনাক্তে খরচই প্রধান বাধা। তিনি বলেন, "আমাদের আফ্রিকায় শনাক্তকরণে সাশ্রয়ী এবং টেকসই সমাধান খুঁজে বের করতে হবে।"
তিনি আরও বলেন, "শনাক্তকরণ পদ্ধতি উন্নত করার ফলে অবৈধ বন্যপ্রাণী ব্যবসায়ীদের ঝুঁকি বৃদ্ধি পায়, যা পণ্যের বাণিজ্যিক মূল্য বাড়ায় এবং চাহিদা হ্রাস করে। তাই আমি আশাবাদী যে বন্যপ্রাণী সনাক্তে ইঁদুর ব্যবহার একটি কম খরচ, কম প্রভাব, কম জনবলনির্ভর প্রক্রিয়া হতে পারে।"
উত্তর ক্যারোলিনার ডিউক ইউনিভার্সিটিতে সাইকিয়াট্রি ও বিহেভিয়রাল সায়েন্সেসের সহকারী অধ্যাপক এবং গবেষণার অন্যতম প্রধান লেখক কেট ওয়েব সিএনএনকে জানান, ইঁদুর ব্যবহারের অন্যতম বড় সুবিধা হলো তাদের প্রশিক্ষণ সময় তুলনামূলকভাবে কম।
তিনি আরও বলেন, সিঙ্গাপুর এবং ফ্রান্স থেকেও বন্যপ্রাণী শনাক্তকরণে ইঁদুর ব্যবহারের ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করা হয়েছে।
গবেষণার এই ফলাফলকে বাস্তবিক পরীক্ষায় নামিয়ে আনার লক্ষ্যে, এপোপো গত বছর তানজানিয়ার দারুস সালাম বন্দরে একটি প্রুফ-অব-কনসেপ্ট পরীক্ষা চালায়। উল্লেখ্য, দেশের ৯৫ শতাংশ বাণিজ্য এ বন্দর দ্বারা সম্পন্ন হয়।
এপোপো জানায়, ইঁদুরগুলো ৮৩ শতাংশেরও বেশি টার্গেট শনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছিল। এমনকি এদেরকে পরীক্ষার জন্য গন্ধ-প্রতিরোধী বস্তুর মধ্যেও লুকিয়ে রাখা হয়েছিল। একটি ইঁদুর কোনো টার্গেট শনাক্ত করার পর, তার সামনের পা দিয়ে একটি ছোট বল টেনে হ্যান্ডলারকে সতর্ক করে, যা একটি বিশেষভাবে তৈরি নিওপ্রিন ভেস্টে লাগানো থাকে এবং এতে একটি বিপ শব্দ সৃষ্টি হয়।
বন্যপ্রাণী পাচার কেবলমাত্র পাচারকৃত প্রাণী বা উদ্ভিদের সংখ্যাকেই ক্ষতিগ্রস্ত করে না বরং পুরো বাস্তুতন্ত্রের জন্যও ধ্বংসাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে। গবেষণায় দেখা যায় যে অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী ব্যবহারের ফলে ইবোলা, মাঙ্কিপক্স এবং সিভিয়ার অ্যাকিউট রেসপিরেটরি সিন্ড্রোমের (সার্স) মতো জুনোটিক রোগের বিস্তার ঘটতে পারে, যা মানুষের জন্য মারাত্মক স্বাস্থ্য ঝুঁকি সৃষ্টি করে।
চতুর ও কৌতূহলী
আফ্রিকার জায়ান্ট পাউচড ইঁদুরদের গড় আয়ু প্রায় আট বছর, তাই তাদের এক বছরের প্রশিক্ষণ একটি দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ বলে মনে করেন সজট। এই বছরজুড়ে সোমবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত প্রশিক্ষণ সেশন চলে, যেখানে নিয়মিতভাবে দড়ির খেলনা ও দৌড়ানোর চাকা নিয়ে খেলার সময়ও থাকে।
ইঁদুরগুলোর উচ্চ পর্যায়ের বুদ্ধি এবং কৌতূহলী থাকার কারণে তারা খুব সহজেই শিক্ষার্থী হয়ে ওঠে। সজট বলেন, "আপনি যদি তাদের নতুন কিছু করাতে চান, শুধু প্রশিক্ষণ ঘেরাটোপে তাদের ছেড়ে দিন এবং অপেক্ষা করুন যে তারা কীভাবে নিজেরাই এটি শিখে নেয়।"
মানুষের মতোই, প্রতিটি ইঁদুরের আলাদা ব্যক্তিত্ব রয়েছে বলে জানান সজট। তিনি বলেন, "কিছু ইঁদুর হয়ত প্রথম চেষ্টায় কাজটি ধরতে পারে, আবার কিছু হয়ত একটু সময় নেয়, কিন্তু একবার শিখে গেলে তারা প্রকৃতপক্ষে সুপারস্টার হয়ে ওঠে।"
যদিও গবেষণাটি এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে, এপোপো আশা করছে এটি তাদের আগের প্রকল্পগুলোর মতোই সফলভাবে প্রসার লাভ করবে। প্রশিক্ষিত ইঁদুরগুলোকে নিয়ে দার এস সালাম বন্দরে এবং বিমানবন্দরে আরও কার্যক্রমমূলক পরীক্ষা পরিচালনা করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। পরবর্তী ধাপগুলোতে মোতায়েন কৌশলগুলোকে উন্নত করার দিকে মনোযোগ দেওয়া হবে বলে জানান সজট। এক্ষেত্রে দীর্ঘ দড়ির ব্যবহারের মাধ্যমে ইঁদুরের পারফরম্যান্স বনাম মুক্ত বিচরণ কৌশল যাচাই করা হবে।
তিনি আশাবাদী যে ইঁদুরগুলো এই চ্যালেঞ্জ মোকবিলা করতে সক্ষম। তিনি বলেন, "এখন পর্যন্ত, আমরা ইঁদুরদের যাই শেখানোর চেষ্টা করেছি, তারা সেটা করতে পেরেছে। যদি আমরা সঠিকভাবে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি তাহলে তারা সবসময়ই কাজটি সম্পন্ন করতে প্রস্তুত থাকে।"