চট্টগ্রামে বৈশাখী মেলা: প্রধান আর্কষণ জব্বারের বলী খেলা, ঐতিহ্যবাহী দেশীয় পণ্য
গৃহিণী সুমনা আক্তার শতবর্ষী জব্বারের বলী খেলা উপলক্ষে আয়োজিত চট্টগ্রামের লালদীঘির বৈশাখী মেলা থেকে গত ২০ বছর ধরে ঝাড়ু, শীতল পাটি, মাটির তৈজসপত্র-সহ সংসারের টুকটাক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কেনেন। এবারও সারা বছরের জন্য ৮টি ঝাড়ু কিনেছেন তিনি। সুমনা আক্তারের ভাষ্য— ফুলের ঝাড়ুর দিয়ে পরিষ্কার করতে অভ্যস্ত তিনি। এই মেলায় সবচেয়ে ভালো ঝাড়ু পাওয়া যায়।
চট্টগ্রাম নগরী ও আশপাশের জেলা-উপজেলার মানুষের সারা বছরের গৃহস্থালীর পণ্যসামগ্রী কেনেন এই ঐতিহ্যবাহী মেলা থেকে। ১৯০৯ সালে থেকে বলী খেলাকে কেন্দ্র করে – তিন দিনব্যাপী এই মেলার আয়োজন করা হয়। তবে এই মেলা ৬-৭ দিনও স্থায়ী হয়। লালদীঘি মাঠকে কেন্দ্র করে চারদিকের কয়েক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে হয় মেলা। আড়াই হাজারেরও বেশি দোকান নিয়ে আসর বসে দেশের বৃহৎ এই লোকজ মেলার। গৃহস্থালী ছাড়াও বাঁশি, খেলনা, জুয়েলারি, দেশীয় খাবারের দোকানও বসে।
প্লাস্টিক, সিলভার বা কাঁচের কারণে দেশীয় গৃহস্থালী পণ্যের বাজার সংকুচিত হয়ে আসছে। তাই মাটির তৈজসপত্র, শীতল পাটি, ঝাড়ু, বাঁশ, বেত বা দড়ির আসবাব ও ফার্নিচার, দেশীয় কার্পেট বা মজবুত দা-বটির মতো পণসামগ্রী সহজে পাওয়া যায় না। ফলে এসব পণ্যের বেচাকেনা জমে ওঠে এ মেলায়।
মেলার ঝাড়ুর ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, প্লাস্টিকের ঝাড়ুর ব্যবহার বাড়ায় - ফুলের ঝাড়ুর ব্যবহার দিন দিন কমছে। মূলত পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি, বান্দরবন, কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি এলাকা থেকে ঝাড়ুর ফুল সংগ্রহ করা হয়। স্থানীয়দের থেকে তা কিনে নেন কারখানা মালিকেরা। এরপর তা চট্টগ্রাম নগরীর কদমতলীর নাজিরপুল ঝাড়ুর গলিতে বিভিন্ন কারখানায় বাঁধাই করা হয়। পরে সারাদেশে সরবরাহ হয়। ৪০ টাকা থেকে ১৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয় একটি ফুলের ঝাড়ু। শলার ঝাড়ুর দাম ৪০ টাকা থেকে ৮০ টাকা।
একসময় এই মেলায় কয়েকশ' ঝাড়ুর দোকান বসতো। এখন তা নেমে এসেছে একশোতে। কমেছে বেচাবিক্রিও। তবুও মজবুত ঝাড়ু কিনতে মেলার অপেক্ষায় থাকেন মানুষ। মেলার প্রতিটি ঝাড়ুর দোকনে গড়ে ২ লাখ টাকা বিক্রি হয়। পুরো মেলায় দুই থেকে তিন কোটি টাকার ঝাড়ুর ব্যবসা হয়। তবে বন ও পাহাড় উজাড়ের কারণে ঝাড়ুর ফুলের সরবরাহও কমছে। এ খাত দখল করে নিচ্ছে প্লাস্টিকের ঝাড়ু উৎপাদক কর্পোরেটরা।
ঝাড়ু ব্যবসায়ী জিয়াউর রহমান বলেন, 'ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, প্লাস্টিক ও পরিষ্কারের অন্যান্য সামগ্রীর দাপটে ঝাড়ুর চাহিদা দিন দিন কমছে। তবে কিছু মানুষের কাছে দেশীয় পণ্যের চাহিদা থাকায় এখনো তা টিকে আছে'।
কোণঠাসা মাটির পণ্যেও আসছে নতুনত্ব:
বেসরকারি চাকরীজীবী সুমন বসাকের সঙ্গে বৈশাখী মেলায় এসেছে তার পাঁচ বছর বয়সী ছেলে সুদীপ্ত। তার আবদার মাটির প্লেট কিনবে। তাই অগত্যা ১৫০ টাকা থেকে দরাদরির পর ১৩০ টাকায় কেনা হলো। খুশি শিশুটি।
সুদীপ্তর বাবা সুমন বসাক টিবিএসকে বলেন, 'ছোটবেলায় মাটির পাত্রে খাবার খেতাম। মাটির জিনিসপত্র ভাঙার ঝুঁকির কারণে আজকাল বাসায় মেলামাইন ব্যবহার করা হয়'।
একসময় তৈজসপত্র মানেই ছিল কুমার পাড়ার মাটি গৃহস্থালী সামগ্রী। গত দুই দশকে এই বাজার দখলে নিয়েছে সিরামিক, মেলামাইন ও প্লাস্টিক। মাটির তৈজসপত্র এখন বিলাসিতাও বটে। গ্রামীণ অর্থনীতির অন্যতম বাহন এই ক্ষুদ্র শিল্প এখন মধ্যস্থতাকারীদের দখলে। কুমিল্লা, ঢাকার ধামরাই, শরীয়তপুর, টাঙ্গাইল, যশোল, পটুয়াখালী, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে এসব হস্ত, কুটির, মৃৎ শিল্পের মালামাল সংগ্রহ করেন এক শ্রেণির ব্যবসায়ী। তাদের কাছ থেকে কিনে নেন ঢাকার ধানমন্ডি, হাইকোর্ট, দোয়েল চত্বরের ব্যবসায়ীরা।
গৃহস্থালীর তৈজসপত্রের ধারণা থেকে বের হয়ে মৃৎশিল্পে এখন তৈরি হচ্ছে বহুমাত্রিক পণ্য। মাটির কলস, গ্লাস, কাপ, প্লেট, হাড়ি-পাতিল থেকে বয়াম, কলমদানি, ফুলদানি, সৌখিন টবও তৈরি হচ্ছে। এসব পাত্র এখন রাঙানো হচ্ছে বিভিন্ন রঙে। যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে আনা হচ্ছে নতুনত্ব। মাটির শোপিজের চাহিদাও বাড়ছে। মাটির পাতে আকাঁ হচ্ছে গাছ, পাতা, ফুল, নৌকা, দৃশ্য, ব্যক্তির প্রতিকৃতিও। রয়েছে কোরআনের আয়াত, স্বাগত শ্লোকও। এসব দিয়ে সাজানো হয় ঘরের ড্রইং রুম।
কলেজ ছাত্রী রুহিনা ফেরেদৌস বলেন, মায়ের শখ মাটির তৈসজপত্র সংগ্রহ করা। তাই মেলায় এসেছি নতুন কিছু সংগ্রহ করতে।
()
ব্যবসায়ীদের তথ্যমতে, মেলায় মাটির তৈজসপত্রের শতাধিক দোকান রয়েছে। দোকানগুলোতে পুরো মেলায় ২ লাখ টাকা থেকে ১৫-২০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। সে হিসাবে, অন্তত পাঁচ কোটি টাকার ব্যবসা হয়।
দোকানি মুফিজুল ইসলাম বলেন, 'মেলাটি মৃৎ শিল্প সংশ্লিষ্টদের এক মিলনমেলা। এখানে পণ্যের নতুন ডিজাইন ও ধারণার আদান-প্রদান হয়'।
প্লাস্টিক-রেক্সিনের চাপে বেত-বাঁশের পণ্য:
গ্রাম বাংলার গৃহিণী নারীদের হাতে তৈরি পাটি সবসময় ঠাণ্ডা থাকায় নামকরণ হয় শীতল পাটি। বর্তমানে রংপুর, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, জামালপুর, কুমিল্লায়, চট্টগ্রামে গ্রামাঞ্চলের গৃহিনীরা অবসরে তৈরি করেন দেশীয় শীতল পাটি।
কিন্তু রেক্সিনের পাটির দাপতে অনেকটা কোণঠাসা এই হস্তশিল্প। ঢাকায় অনেক কারখানায় মেশিন দিয়ে তৈরি হয় রেক্সিনের পাটি। কম দামের কারণে বাজার ছেয়ে গেছে পণ্যটি। মেলার প্রায় সবকটি দোকানেই শীতল পাটির পাশাপাশি এখন রেক্সিনের পাটিও বিক্রি হচ্ছে।
দোকানি স্বপন নাথ বলেন, 'একটি শীতল পাটি হাতে তৈরি করতে একমাসও লেগে যায়। অপরদিকে, রেক্সিনের পাটি মেশিনে দিলেই তৈরি হয়ে যায়। ছোট শীতল পাটি ৪০০ টাকা। বিপরীতে রেক্সিনের পাটির দাম দেড়শ টাকা। যে শ্রম ও সময় দিতে হয় সে তুলনায় পারিশ্রমিক কম বলে শীতল পাটির উৎপাদন কমে আসছে'।
খাগড়াছড়ির বাঁশের মোড়ার কদর দেশজুড়ে:
প্লাস্টিকের টুল/চেয়ারের কারণে সংকুচিত হচ্ছে বেতের তৈরি মোড়ার বাজার। এরমধ্যেও মজবুত গঠন, সুশ্রীর কারণে পার্বত্য জেলা খাগড়াছড়ির মোড়ার কদর দেশজুড়ে। খাগড়াছড়ি ছাড়াও নোয়াখালী চরাঞ্চল, নরসংদী ও ভৈরবে তৈরি হয় বেতের মোড়া। মূলত গৃহিণীদের চাহিদার ওপর নির্ভরশীল শিল্পটি।
ব্যবসায়ীদের ভাষ্য— ৩০০ টাকা থেকে ৩ হাজার টাকাও বিক্রি হয় একটি মোড়া। খাগড়াছড়ির মাটিরাঙা, পাংছড়ি, দীঘিনালা, তবলছড়ি, চট্টগ্রামের বোয়ালখালী ও মিরসরাইসহ বিভিন্ন এলাকার তৈরি হয় এসব মোড়া। জেলের কয়েদিরাও তৈরি করতেন পণ্যটি। বিভিন্ন মেলা কেন্দ্রিক পণ্যটির বেচাবিক্রি বেশি হয়। এছাড়া চট্টগ্রামের বিবিরহাট, হাটহাজারী, ফেনীর মুহুরী গলি, কুমিল্লার কোম্পানিগঞ্জ ও কান্দিরপাড়ে এসব মোড়ার দোকান রয়েছে।
খাগড়াছড়ির ব্যবসায়ী মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসাইন টিবিএসকে বলেন, 'এক জোড়া মোড়া হাতে তৈরি করতে সময় লাগে নূন্যতম এক সপ্তাহ। দেশের অল্প কিছু জায়গা ছাড়া এখন মেলা কেন্দ্রিকই হয়ে গেছে পণ্যটি'।