ভারতের রাজনীতিতে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ কি এক নতুন বেড়াজালে আবদ্ধ হতে যাচ্ছে!
ভারতের রাজনীতিতে বিচার বিভাগ ও নির্বাহী বিভাগ এক নতুন বেড়াজালে আবদ্ধ হতে চলেছে। আসন্ন ১৮ লোকসভা নির্বাচন আজ থেকে ঠিক এক বছরের মধ্যেই সম্পন্ন হবে। ২০২৪ সালের এপ্রিল-মে মাসের মধ্যে এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে নানান রাজনৈতিক মেরুকরণ চলছে দেশটিতে। দেশটির বর্তমান পার্লামেন্টে দ্বিতীয় দল হিসেবে অবস্থান করছে জাতীয় কংগ্রেস যার যাত্রা শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ আমলে ১৮৮৫ সালে। কংগ্রেসের কাছে লোকসভার আসন সংখ্যা ৫০টি। মাত্র ৫০টি আসন হওয়ার কারণে কংগ্রেস বিরোধীদলের নেতা হওয়ার যোগ্যতা হারিয়েছে। বিরোধীদলের নেতা হওয়ার জন্য দলটির কাছে ন্যূনতম দশ শতাংশ লোকসভার আসন থাকতে হবে। সেই বিবেচনায় পাঁচটি আসন কম কংগ্রেসের কাছে। ভারতের লোকসভার মোট সর্বোচ্চ আসন সংখ্যা ৫৫২টি।
জনসংখ্যার ভিত্তিতে রাজ্যগুলোর প্রতিনিধিত্ব ৫৩০টি আসনে। ২০টি আসন কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়ে থাকে। ২টি আসন সংরক্ষিত থাকে অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সোসাইটির জন্য। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক মনোনীত হন তারা। ভারতীয় পার্লামেন্টের রুল বিধি অনুসারে বিরোধী দলের নেতাকে বহু ক্ষেত্রেই মত প্রকাশ করার সুযোগ দেওয়া বাধ্যতামূলক। অথবা বিভিন্ন কমিটিতে বিরোধী দলের নেতার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়। বিরোধীদলের প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসন না থাকাতে বর্তমান লোকসভার রুল বিধি অনুসারে স্বীকৃত বিরোধী দলের নেতা ভারতীয় লোকসভায় নেই। যদিও এক্ষেত্রে অতীতে বিভিন্ন রাজ্যে ও লোকসভায় নির্ধারিত আসন না থাকা সত্ত্বেও বিরোধী দলের নেতা হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদা এবং তাদের ভূমিকাকে নিশ্চিত করা হয়েছে।
পশ্চিমবাংলায় বামদের শাসনামলে কংগ্রেসকে বিরোধী দলের আসন দেওয়া হয়েছে প্রয়োজনীয় সংখ্যক আসন না থাকা সত্বেও। রুলবিধির দোহাই দিয়ে বিজেপি ভারতীয় রাষ্ট্রকে এক কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রে পরিণত করেছে। আসন্ন লোকসভা নির্বাচনে নতুন মেরুকরণ দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। পশ্চিমবাংলায় মমতা ব্যানার্জি ও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারের ঘোষণার পরে তেমনি একটি ইঙ্গিত পাওয়া যায়, সর্বভারতীয় বিজেপি বিরোধী একটি মোর্চা গঠনের। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ লোকসভা আসনধারী রাজ্য হিসেবে মমতা ব্যানার্জি বিজেপিকে পশ্চিমবাংলায় জায়গা করে দিয়েছিল।
অতীতে মমতা ব্যানার্জি পশ্চিমবঙ্গের বাইরে কেন্দ্রীয় বিজেপির সঙ্গে জোট গঠন করে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। আপাতদৃষ্টিতে মমতা ব্যানার্জির লক্ষ্য সর্বভারতীয় দল কংগ্রেসকে পরাজিত করা। যদিও রাজ্যে মমতা ব্যানার্জি তীব্র বিরোধিতার সম্মুখীন হচ্ছেন বিজেপির। কিন্তু কেন্দ্রীয় বহু বিষয়ে মমতাকে বিজেপির পক্ষ অবলম্বন করতে দেখা গেছে, বিশেষ করে উপরাষ্ট্রপতি ধনকর যিনি পশ্চিমবাংলার রাজ্যপাল ছিলেন। তার সাথে নানান বিষয়ে মতপার্থক্য হলেও মমতা ব্যানার্জির দলকে উপরাষ্ট্রপতি পদে তাকেই সমর্থন করতে দেখা গেছে।
এই উপরাষ্ট্রপতি ধনকর বর্তমানে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্টের সাথে বিচারক মনোনয়নের লড়াইতে সরকারের পক্ষে সরাসরি অংশ নিচ্ছেন।
বিচারপতি নিয়োগের প্রচলিত আইনের সংশোধনকল্পে সংবিধানের ৯৯তম সংশোধনী আনা হলে সেদেশের সুপ্রিম কোর্ট তা বাতিল করে দেয়। আইনমন্ত্রী সরাসরি সুপ্রিম কোর্টের সেই রায়ের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। ভারতের বিচার ব্যবস্থা যদিও খানিকটা স্বাধীন মনে হয় আপাতদৃষ্টিতে, তবে বেশ কিছু রায়ের ক্ষেত্রে তাদের এই ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। গুজরাটের আদালতে রাহুল গান্ধীকে সর্বোচ্চ সাজা প্রদান করে তার সংসদ সদস্য পদ বাতিল হওয়াকে কোনভাবেই নিরপেক্ষতার দৃষ্টিতে গ্রহণযোগ্য নয়। এমনি পশ্চিমবাংলার নানান দুর্নীতিতে একজন বিচারপতি যেভাবে প্রকাশ্যে রাজনীতিবিদদের মতন আচরণ করছেন তা ভারতীয় বিচারব্যবস্থার দুর্বল দিক হিসেবে সামনে চলে আসছে। এমন সব জটিল পরিস্থিতিতে ভারতীয় হিন্দুত্ববাদী কর্তৃত্ববাদী দল বিজেপির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক দলগুলো কতটা ঐক্যবদ্ধ হতে পারবে তা বলার সময় এখনো আসেনি।
শুরুতেই কিছু সন্দেহ থেকেই যায় মমতা ও নীতেশের নেতৃত্বে বিজেপি বিরোধী জোট গঠন নিয়ে। এই দুই নেতার দল বিজেপির সাথে জোটবদ্ধ থেকেছে। মমতার হাত ধরেই পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি তার যাত্রা শুরু করে। তৃণমূল ২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা না করে বিজেপিকে জিতিয়েছিল সে ইতিহাস খুব দূরের নয়। রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন ইস্যুতে বিজেপির সাথে তৃণমূলের ঐকমত্য সকলের জানা। একই কথা নীতেশের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। যদিও এই মুহূর্তে তিনি আরজেডির লালু প্রসাদের ছেলের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে আছেন তথাপি নিশ্চিত করে বলা যাবে না, আগামী এক বছরে তাদের রাজনৈতিক অবস্থানটা কী হবে। বিগত লোকসভা নির্বাচনের আগে সেই পুলওয়ামার হত্যাকাণ্ড ঘটেছিল। আগামীতে এমনি কোন ঘটনা উসকে দেওয়া হবে কিনা নির্বাচনের পূর্বে সেটিও একটি প্রশ্ন।
ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক বর্তমানে তুঙ্গে বলা যায়। অতিসম্প্রতি বেশ কিছু ট্রানজিট সুবিধা ভারতকে দেওয়া হয়েছে। যা পশ্চিমবাংলার উত্তরের জনগোষ্ঠীর জন্য ব্যাপক সুবিধা বয়ে আনবে। আসামে বিজেপির বিকাশ ঘটছে, তাকে আরো বেশি সুবিধা দেবে বিজেপির বর্তমান অবস্থান। উত্তরবঙ্গ এবং আসামের জন্য বাংলাদেশের ভেতর থেকে এই ট্রানজিট সুবিধা অনেক বেশি বিজেপিকে সহায়তা প্রদান করবে। যদিও বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যকার সহযোগিতার ভিত্তি সমতার নীতিতে হওয়াটা বাঞ্চনীয়। বাংলাদেশের দিক থেকে অনেক কিছুতেই আমরা হাত বাড়িয়ে দিয়েছি কিন্তু পাশাপাশি ভারত কতটা করছে আমাদের জন্য সেটি বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর মনে একটি প্রশ্ন। সরাসরি ট্রানজিট সুবিধা প্রদান করার পরেও বাংলাদেশ তিস্তা পানি চুক্তি করতে পারে কিনা সেটিও সবচেয়ে বড় প্রশ্ন হয়ে রইল। তারপরও দুই দেশের মধ্যকার বাণিজ্য ঘাটতি নিরসনের উপায় থাকছে কিনা সেটাও বড় প্রশ্ন। দুই দেশের সামনে নির্বাচন। নির্বাচনের আগেই উত্থাপিত প্রশ্নগুলোর মীমাংসা হওয়াটা দুই দেশের সরকারের জন্য মঙ্গলজনক।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।