এশিয়ায় হাতির দুই-তৃতীয়াংশ আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে গেছে: গবেষণা
এশিয়া মহাদেশে হাতির প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে গেছে। শত শত বছর ধরে চলা নির্বিচারে বৃক্ষনিধন এবং বন এলাকায় মানুষের অপরিকল্পিতভাবে কৃষিকাজ ও অবকাঠামো নির্মাণ এর মূল কারণ। খবর সিএনএন এর।
গত বৃহস্পতিবার (২৭ এপ্রিল) জার্নাল সাইন্টিফিক রিসার্চে প্রকাশিত এক গবেষণায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণাটিতে ক্যালিফোর্নিয়া ইউনিভার্সিটির প্রফেসর জীববিজ্ঞানী শেরমিন ডি সিলভার নেতৃত্বে একদল বিশেষজ্ঞ সম্পৃক্ত ছিলেন।
গবেষণা মতে, এশিয়ার মাত্র ১৩ টি দেশে প্রায় বিপন্ন এশিয়ান হাতির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। একইসাথে ১৭০০ সাল থেকে প্রাণীটির বন এবং তৃণভূমির আবাসস্থল প্রায় ৬৪ ভাগ কমে এসেছে। আয়তনের হিসেবে যা প্রায় ৩.৩ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার।
গবেষক দলের মতে, বৃহৎ পরিসরে হাতির আবাসস্থল ধ্বংসের কারণে প্রতিনিয়ত মানুষের সাথে হাতির সংঘাত বাড়ছে। তবে হাতির বাসস্থান সংরক্ষণের জন্য যথাযথ পরিকল্পনা গ্রহণ করলে এমন পরিস্থিতি এড়ানো সম্ভব।
গবেষণার নেতৃত্বে থাকা ডি সিলভা 'ট্রাঙ্কস এন্ড লিভস' নামের একটি অলাভজনক সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ও প্রেসিডেন্ট। সংস্থাটি এশিয়ান বন্য হাতি সংরক্ষণ ও এর আবাসস্থল রক্ষা নিয়ে কাজ করে থাকে।
হাতির আবাসস্থল নিয়ে ডি সিলভা বলেন, "আমরা এমন একটা সংকটময় পর্যায়ে এসে পৌঁছেছি যে, যেখানে মানুষ ও হাতির মধ্যকার একসময়ের পারস্পরিক সংঘাতহীন পরিস্থিতি থেকে সরে এসে বর্তমানে সংঘাতময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আমি ব্যাপারটি নিয়ে খুবই উদ্বিগ্ন। আমাদের এই সমস্যার সমাধান করতে হবে।"
গবেষণায় দেখা যায়, হাতির সবচেয়ে বেশি আবাসস্থল ধ্বংস হয়েছে চীনে। ১৭০০ সাল থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত দেশটিতে প্রাণীটি বসবাসযোগ্য ৯৪ ভাগ আবাসস্থল হারিয়েছে। অন্যদিকে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে হাতির আবাসস্থল ধ্বংস হয়েছে প্রায় ৮৬ ভাগ।
বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ইন্দোনেশিয়ায় হাতির প্রায় অর্ধেক আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে গেছে। এমনকি ভূটান, শ্রীলঙ্কা ও নেপালেও হাতির আবাসস্থল উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে।
এ প্রসঙ্গে ডি সিলভা বলেন, "হাতির আবাসস্থল পুনরায় ফিরিয়ে আনার মানে এই নয় যে ঐ এলাকাকে একদম আলাদা করে ফেলা। বরং আমাদের এসব এলাকার কৃষক ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের অর্থনৈতিক কার্যক্রমে নজর দিতে হবে। বেশিরভাগ সময়ই এসব মানুষ অর্থনৈতিক মূল ধারার বাইরে থেকে যায়।"
গবেষণা ফলাফলে দেখা যায়, ১৭০০ সালের দিক থেকেই এশিয়ায় দ্রুতগতিতে হাতির আবাসস্থল ধ্বংস হতে থাকে। একইসাথে তৎকালীন সময়েই এসব অঞ্চলে ইউরোপীয় উপনিবেশ বিস্তার লাভ করছিল।
উপনিবেশের সময় বন নিধন, রাস্তা নির্মাণ, খনিজ উত্তোলন ও বাঁধ নির্মাণের মতো কার্যক্রম দ্রুতগতিতে বৃদ্ধি পায়। একইসাথে ঐ সময় জমিতে কৃষিকাজের পরিমাণও বৃদ্ধি পায়। যার সরাসরি প্রভাব দেখা যায় বন্যপ্রাণীর আবাসস্থলের ওপর।
এ প্রসঙ্গে ডি সিলভা বলেন, "১৭০০ সালে একটি হাতি বসবাসযোগ্য আবাসস্থলের গড়ে ৪৫ ভাগ এলাকা কোনোরকম বাঁধা ছাড়াই চলাচল করতে পারতো। কিন্তু ২০১৫ সালে প্রাণীটির একেবারে মুক্তভাবে চলচাল করতে পারা এলাকার পরিমাণ ৭.৫ ভাগে নেমেছে এসেছে।"
বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ভারত ও শ্রীলঙ্কায় সবচেয়ে বেশি হাতি রয়েছে। উপনিবেশের ধাক্কার পর গত শতকের মাঝামাঝি সময়ে ঘটা শিল্প বিপ্লব হাতির আবাসস্থল ধ্বংসের 'দ্বিতীয় ঢেউ' হিসেবে কাজ করেছে।
গবেষক ডি সিলভা বলেন, "আমরা লক্ষ্য করেছি যে, থাইল্যান্ড ও চীনের মতো কিছু দেশে ১৯৫০ এর দশকে ব্যাপকহারে হাতির আবাসস্থল ধ্বংস হয়েছে।"
বর্তমানে কৃষিকাজ ও খনিজ সম্পদ আহরণের জন্য মানুষ আরও বেশি পরিমাণে বন অঞ্চলে নিজেদের কার্যক্রম প্রসারিত করছে। এতে করে প্রায়শই মানুষের সাথে হাতির সংঘাতের সৃষ্টি হচ্ছে।
ক্ষেত্রবিশেষে রাজনৈতিক ও সামাজিক নানা ঘটনাও হাতি আবাসস্থলের ক্ষেত্রে ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছে। ২০১৭ সালে মায়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনের স্বীকার হয়ে দেশটির রাখাইন রাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের এসে আশ্রয় নিয়েছে।
বর্তমানে প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থী কক্সবাজারে অবস্থিত বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী ক্যাম্পে বসবাস করছে। অথচ এই অঞ্চলটিই একসময় ছিল হাতির গুরুত্বপূর্ণ আবাসস্থল।
গবেষকদের মতে, রোহিঙ্গাদের জন্য কক্সবাজারে শরণার্থী শিবির স্থাপনের ফলে বাংলাদেশে ও মিয়ানমারের মধ্যেকার সীমান্তবর্তী এলাকায় হাতির স্বাভাবিক চলাচলে মারাত্মক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
স্বাভাবিক আবাসস্থল ধ্বংস হলেই হাতি নতুন আবাসস্থলের খোঁজে মানুষের বসবাসকৃত এলাকায় ঢুকে পড়ে এবং পরবর্তীতে নানা বিপত্তি ঘটে।
২০২১ সালে চীনের দক্ষিণ-পশ্চিমের প্রদেশ ইউনানে এমনি এক ঘটনা ঘটে। প্রদেশটির সংরক্ষিত এলাকা থেকে একটি হাতির পাল বের হয়ে প্রায় ৫০০ কিলোমিটার এলাকা বিচরণ করে। এতে করে প্রদেশটির লাখ লাখ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে এবং বিপুল পরিমাণে ফসলসহ মিলিয়ন ডলারের ডলারের ক্ষতি হয়।
এ প্রসঙ্গে ডি সিলভা বলেন, "হাতি সাধারণত অনেক বছর বেঁচে থাকে এবং পরিবর্তনশীল পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। তাই প্রাণীটি যখন আবাসস্থল হারায়, তখন নতুন আবাসস্থলের খোঁজ করতে থাকে।"
বর্তমানে প্রায় সংকটাপন্ন অবস্থায় থাকা এশিয়ান হাতিকে বাঁচিয়ে রাখতে গবেষক দল যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। এক্ষেত্রে প্রাণীটির ধীরে ধীরে সংকুচিত হয়ে আসা বাসস্থানকে শনাক্ত করতে হবে। একইসাথে পরিকল্পনা করে ধ্বংস হয়ে যাওয়া বাসস্থানকে বসবাসযোগ্য বাসস্থানে রুপান্তরিত করতে হবে।