ব্রিকস জোটের মুদ্রা ডলারের আধিপত্যকে নাড়িয়ে দিতে পারে
ডি-ডলারাইজেশন বা মার্কিন ডলারের আধিপত্য খর্ব হতে চলা নিয়ে বিশ্বব্যাপী এখন প্রচুর আলোচনা হচ্ছে। বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহ ইঙ্গিত দিচ্ছে, মার্কিন মুদ্রায় অন্যান্য দেশের আস্থা কমে আসার দিকে। এরমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগী থেকে শুরু করে উন্নয়নশীল বৃহৎ অর্থনীতির দেশগুলোও আছে। ফরেন পলিসি থেকে অনূদিত।
গত মাসেই রাশিয়ান পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ ডুমার ডেপুটি চেয়ারম্যান আলেক্সান্ডার বাবাকভ জানান, নতুন একটি মুদ্রা তৈরির বিষয়ে কাজ করছে তার দেশ। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকা – ব্রিকস সদস্য এই পাঁচ দেশ নতুন এ মুদ্রায় আন্তর্জাতিক লেনদেন করবে।
এর হপ্তাখানেক পর ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুলা দা সিলভা তার সাথে সুর মেলান। 'সব দেশকে কেন ডলার-ভিত্তিক বাণিজ্য করতে হবে' সেটা তার বোধগম্য নয় এমন মন্তব্য করে।
ইউরো, ইয়েন, ইউয়ানের মতো অন্ধ প্রতিযোগীদের দুনিয়ায় একচক্ষুর ডলারই রাজা, আর সে রাজত্ব চিরন্তন - এমন ধ্যানধারণাকে জটিল প্রশ্নের মুখে ফেলেছে এসব ঘটনাপ্রবাহ। মুদ্রার বিষয়ে একজন অর্থনীতিবিদ বলেছিলেন, 'ইউরোপ একটি জাদুঘর, জাপান তার আতুরঘর আর জেলখানা হলো চীন'। তিনি হয়তো ভুল কিছুও বলেননি সেসময়। কিন্তু, ব্রিকসের জারিকৃত মুদ্রা খেলার মোড়ই পাল্টে দিতে পারে। কারণ, উদীয়মান অর্থনীতির এ জোটের দেশগুলো – সম্মিলিত জিডিপির আকারে কেবল বিশ্বসেরা অর্থনীতি যুক্তরাষ্ট্রকেই পেছনে ফেলেছে তাই নয়, বরং পুরো জি-৭ ভুক্ত উন্নত দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে গেছে।
বিভিন্ন দেশের সরকারের ডলারের আধিপত্য থেকে মুক্তি পাওয়ার চেষ্টা নতুন নয়। সেই ১৯৬০ এর দশক থেকে দেশে দেশে মার্কিন ডলারকে বিশ্ববাণিজ্যের সিংহাসন থেকে উৎখাতের আকাঙ্ক্ষা আলোচিত হয়েছে। কিন্তু, আলোচনাই সার, তাতে ফলাফল ছিল শূন্য। এক হিসাবের বরাতে জানা যায়, বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৮৪.৩ শতাংশই হচ্ছে ডলারে – সে তুলনায়, মাত্র ৪ দশমিক ৫ শতাংশ হয় চীনের মুদ্রা ইউয়ানে।
তাছাড়া, রাশিয়ার রাষ্ট্রযন্ত্র অবলীলায় অতিশয়োক্তি করে এমন প্রমাণ রয়েছে।দুমার ডেপুটি চেয়ারম্যানের বক্তব্য নিয়েও সন্দেহের অবকাশ থেকেই যায়। এবিষয়ে কিছু বাস্তবিক প্রশ্নও জাগে, যেমন ব্রিকস সদস্য অন্যান্য দেশ বাবাকোভের এই প্রস্তাবকে কীভাবে গ্রহণ করেছে? যার উত্তর এখনও অস্পষ্ট রয়ে গেছে।
তবুও, অন্তত অর্থনীতির উপর ভিত্তি করে – ব্রিকস-ইস্যুকৃত মুদ্রার সাফল্যের সম্ভাবনা বেশ নবীনই বলা চলে। একে ঘিরে পরিকল্পনা যত প্রাথমিক পর্যায়েই থাকুক, যতই অজানা থাকুক বাস্তবিক অনেক প্রশ্নের উত্তর; তারপরও এটি মার্কিন ডলারকে ব্রিকস দেশগুলোর প্রধান রিজার্ভ মুদ্রার আসনচ্যুত করতে পারে।
অতীতে ডিজিটাল ইউয়ানের মতো ডলারের যেসব প্রতিযোগী মুদ্রার পরিকল্পনা করা হয়েছে – তার চেয়ে ব্রিকসের তাত্ত্বিকভাবে আলোচিত মুদ্রার রয়েছে –- ডলারকে উৎখাত, অথবা তা নাহলেও অন্তত মুদ্রাধিপতির সিংহাসনকে নড়বড়ে করে দেওয়ার ক্ষমতা।
আলোচনার সুবিধার্থে তাত্ত্বিক এই মুদ্রাকে 'ব্রিক' বলে ডাকা যাক।
ব্রিকস দেশগুলো শুধু আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের জন্য ব্রিক ব্যবহার করলে – ডলারের আধিপত্য অবসানের পথে যে বাধাগুলো তাদের সামনে রয়েছে – তা দূর করতে পারবে। বর্তমানে ব্রিকস সদস্যরা দ্বিপাক্ষিক চুক্তির মাধ্যমে ডলারের বিকল্প নিজস্ব মুদ্রায় বাণিজ্য করছে। যেমন- চুক্তির ভিত্তিতে রাশিয়া ও চীনের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য করা হচ্ছে ইউয়ানে।
এক্ষেত্রে বাধাটা কী? সেটা হলো – রাশিয়া তার বাদবাকি আমদানি চীন থেকে করে না। ফলে উভয় দেশের মুদ্রায় দ্বিপাক্ষিক বিনিময়ের পর যে বাড়তি আয় রাশিয়ার থেকে যাচ্ছে, সেটা তারা ডলার-সমর্থিত সম্পদে রুপান্তর করছে বিশ্বের অন্যান্য দেশ থেকে আমদানির জন্য। এটা তাদের করতেই হয়, কারণ ওইসব দেশ এখনো ডলারেই বৈদেশিক বাণিজ্য করছে।
কিন্তু, চীন ও রাশিয়া উভয়ে যদি শুধুমাত্র ব্রিক মুদ্রায় বাণিজ্য করতো – তাহলে দ্বিপাক্ষিক এই বাণিজ্য থেকে করা আয় ডলারে রুপান্তর করতে হতো না রাশিয়াকে। তখন রাশিয়া অন্যান্য আমদানির জন্যও ব্রিক মুদ্রাই ব্যবহার করতো, ডলার নয়। অবশেষে এভাবেই পা রাখতো ডি-ডলারাইজেশনের নব-যুগে।
ব্রিকস দেশগুলো বাণিজ্যের জন্য শুধু ব্রিক মুদ্রাই ব্যবহার করবে – এমনটা ভেবে নেওয়াটা বাস্তবসম্মত কি-না, তার উত্তর হচ্ছে – হ্যাঁ, এর ভিত্তি আছে বাস্তবতার জমিনেই।
প্রথমত এর মাধ্যমে নিজেদের আমদানি ব্যয় নির্বাহের দরকারি মুদ্রা তারা নিজেরাই ছাপাতে পাড়বে। অর্থাৎ, ব্রিকস সদস্য দেশগুলোর অনুমোদন সাপেক্ষে এই অর্থায়ন করতে পারবে অনায়সে। ২০২২ সালে সামষ্টিকভাবে ব্রিকস দেশগুলোর বাণিজ্য বা ব্যালান্স অব পেমেন্টের উদ্বৃত্ত ছিল ৩৮৭ বিলিয়ন ডলার, যার সিংহভাগ কৃতিত্বই চীনের।
ফলে বিশ্বের অন্যান্য মুদ্রা জোট বাণিজ্যে যে মাত্রায় স্বনির্ভরতা অর্জন করতে পারেনি – সেই সম্ভাবনা আছে ব্রিকস জোটের। কারণ, এর আগের জোটগুলোর মতোন ব্রিকসের মুদ্রা ইউনিয়ন পরস্পর সীমান্ত থাকা দেশগুলোর মধ্যেই হবে না, বরং এর সদস্য দেশগুলো বহু ধরনের পণ্য ও সেবা উৎপাদন করে; যা বিদ্যমান অনেক মুদ্রা জোটের থেকে বেশি।
ব্রিকস দেশগুলো ভৌগলিক বৈচিত্র্যের প্রতিনিধিত্ব করে, যা ভৌগলিকভাবে একক অঞ্চলের সীমাবদ্ধতাকে পাশ কাটাতে পারবে, ভৌগলিক নৈকট্যের ফলে যে সীমাবদ্ধতা রয়েছে ইউরোজোনের। ২০২২ এই মুদ্রা ইউনিয়নের সম্মিলিত বাণিজ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ৪৭৬ বিলিয়ন ডলার।
তাছাড়া, ব্রিকস দেশগুলো কেবল একে-অপরের সাথেই বাণিজ্য করবে না। আঞ্চলিকভাবে একেকটি ব্রিকস দেশ তাদের নিজস্ব অঞ্চলের অর্থনৈতিক 'হেভিওয়েট'। ফলে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের দেশ ব্রিক মুদ্রায় তাদের সাথে বাণিজ্যে আগ্রহী হবে। যেমন থাইল্যান্ড চীনের সাথে বাণিজ্যে ব্রিক মুদ্রা ব্যবহারে বাধ্য হতে পারে। আবার ব্রাজিলের আমদানিকারকরা এই মুদ্রায় থাইল্যান্ড থেকে চিংড়ি কিনতে পারবে।
একটি দেশ তাদের উৎপন্ন পণ্য দুই দেশের মধ্যে থাকা শুল্কের মতো বাণিজ্য বাধাকে পাশ কাটিয়ে সেগুলো তৃতীয় কোনো দেশে রপ্তানি করতেও পারবে। ফলে যুক্তরাষ্ট্র যদি চীনের সাথে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য পরিহারও করে, তাহলে চীন ভিয়েতনামের মতো দেশে রপ্তানি করবে, সেগুলো আবার পুনঃরপ্তানি হবে মার্কিন বাজারে।
ব্রিকস দেশগুলোর সরকার ব্রিক মুদ্রায় বাণিজ্য বাধ্যতামূলক করলে ভোক্তারা সর্বোচ্চ কতোটা ক্ষতিগ্রস্ত হবে তার উদাহরণ হিসেবে আছে আজকের রাশিয়া। আমেরিকা ও ইউরোপের সরকারগুলো রাশিয়াকে অর্থনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন করতে চাইলেও, তাদের কিছু পণ্য ঠিকই রাশিয়ার বাজারে আসছে। এজন্য রুশ ভোক্তাদের বাড়তি দাম দিতে হলেও, সেটা বিপর্যয়ের শামিল হয়নি।
তাই ডলারের আধিপত্যকে ক্ষুণ্ণ করার বিষয়ে ব্রিকস দেশগুলোর কর্মকর্তারা দিন দিন আরো আগ্রহী হয়ে উঠছেন, রাশিয়া তাদের সামনে সেই দৃষ্টান্ত রেখেছে। ফলে ডি-ডলারাইজেশন লাভ-ক্ষতির বিবেচনায় এখন অনেক বেশি আকর্ষণীয় মনে হচ্ছে।
তবে ডলারকে তাদের প্রধান রিজার্ভ মুদ্রার আসন থেকে সরাতে চাইলে ব্রিকস দেশগুলোর দরকার হবে নিরাপদে সম্পদ রাখার উপায়, যা বাণিজ্যে ব্যবহার হবে না। ব্রিকস দেশগুলো এমন সমাধান খুঁজে পাবে এমন ধারণা করা কি বাস্তবসম্মত? এক্ষেত্রেও উত্তর হলো- হ্যাঁ।
যেহেতু সামগ্রিকভাবে এই জোটের বানিজ্য উদ্বৃত্ত আছে, ফলে তাদের মুদ্রা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয় বিকল্প হতে পারে। সম্পদ নিরাপদে রাখতে ডলারের দীর্ঘদিনের প্রতিযোগী স্বর্ণ, কিন্তু বহুমূল্য এই ধাতুর অসুবিধার জায়গা হলো– এতে বিনিয়োগ করে সুদ পাওয়া যায় না। নানান সূত্রে জানা যাচ্ছে, ব্রিকস দেশগুলো তাদের মুদ্রাকে স্বর্ণসহ অন্যান্য বহুমূল্য ধাতুর ভিত্তিতে সমর্থন দিতে চায়। ফলে ব্যতিক্রমী একটি ব্যাপার হবে।
ব্রিক মুদ্রার সুদ প্রদানকারী সম্পদ (সরকারি বন্ড, সঞ্চয়পত্র ইত্যাদি) যে সুদ দেবে তা অনেকটা স্বর্ণ থেকে প্রথমবারের মতো সুদলাভের মতোন ব্যতিক্রমী হবে। এতে করে একইসাথে স্বর্ণের বহুমুখী বৈশিষ্ট্য এবং সুদ-প্রদানকারী সম্পদ দুইয়ের সুযোগ নিতে পারবেন বিনিয়োগকারীরা, যা তাদেরকে আকৃষ্টও করবে।
ব্রিক বন্ড যদি সুদ-প্রদানকারী স্বর্ণের মতোন হয়, তাহলে তাদের ঝুঁকির পরিমাণ অনেকটাই কম বলে মনে করা হবে, যেহেতু সেক্ষেত্রে দেউলিয়াত্তের ঝুঁকি হবে তুলনামূলক কম। ব্রিকস-ভুক্ত বিভিন্ন দেশের সরকারের দেউলিয়াত্তের ঝুঁকি নগণ্য না হলেও – সেটা প্রশমনের পথ খোলা আছে। ব্রিকের বন্ড সরকারগুলোকে নতুন ঋণ গ্রহণের সুযোগ দেবে। এভাবে বিপুল ঋণের মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার ঝুঁকি কমাতে সহায়তা দেবে। ৩০ বছর পরের চেয়ে ৩০ দিনের ব্যবধানে বিনিয়োগের প্রত্যাশিত সুফল পেতেই বিনিয়োগকারীরা বেশি আগ্রহী। এক্ষেত্রে বন্ডের দাম তাদের প্রতীক্ষার বাড়তি মূল্য দেবে। বাজার যদি ব্রিক সমর্থিত বন্ড ক্রয়ে বাড়তি লভ্যাংশ চায়, সেটা হয়তো পাবে। কারণ, ব্রিকের গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠার জন্য ব্রিকস সরকারগুলো এই মূল্যদানে রাজি থাকবে।
সুষ্ঠুভাবে বললে, ব্রিক বহু বাস্তবিক প্রশ্নের উদ্রেক করবে। যেমন যদি শুধু ব্রিক দেশের মধ্যে অভ্যন্তরীণ লেনদেনে এই মুদ্রা চালু করা হয়, তাহলে তাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকারদের কাজ আরো জটিল হয়ে উঠবে। এই বাস্তবতায়, ইউরোপিয়ান সেন্ট্রাল ব্যাংকের মতো বহুজাতিক বৃহৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করাটা সময় ও শ্রমসাধ্য বিষয়। তবে এসব চ্যালেঞ্জ সমাধান একেবারে অসাধ্য কিছুও নয়।
ব্রিক সদস্য দেশগুলোর মধ্যেকার ভূরাজনৈতিক সম্পর্কও কন্টকমুক্ত নয়। তারপরও ব্রিক মুদ্রা আর্থিক খাতে তাদের সহযোগিতার স্থান তৈরি করবে। আর্থিক খাতে অভিন্ন স্বার্থ তাদের ঐক্যবদ্ধ হতে সহায়তাও করবে। যেমন চীন ও ভারতের মধ্যে ভূরাজনৈতিক বৈরিতা থাকলেও ডি-ডলারাইজেশনের ক্ষেত্রে তাদের অভিন্ন স্বার্থ আছে। ফলে একে-অন্যের সাথে প্রতিযোগিতা অব্যাহত রেখেই তারা এক্ষেত্রে সহযোগিতার সম্পর্ক তৈরি করতে পারে।
তবে ব্রিক মুদ্রা ডলারের মুকুট একেবারে কেড়ে নিতে পারবে না। এমনকী ব্রিকস দেশগুলো সম্পূর্ণরূপে ডলার পরিহার করলেও নয়। সেক্ষেত্রে বৈশ্বিক আর্থিক ব্যবস্থা আজকের একক আধিপত্য থেকে মুক্ত হয়ে বহুমেরু-কেন্দ্রীক হবে।
বিশেষ দ্রষ্টব্য: নিবন্ধের বিশ্লেষণটি লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও পর্যবেক্ষণের প্রতিফল। অবধারিতভাবে তা দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডের অবস্থান বা সম্পাদকীয় নীতির প্রতিফলন নয়।