২০ হাজার বছরের পুরনো হার, ডিএনএ পরীক্ষায় বের হলো কে পরত এই হার
প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ ছড়িয়ে থাকা এক সাইবেরিয়ান গুহা থেকে বিজ্ঞানীরা এল্কের দাঁত থেকে বানানো একটি হার খুঁজে পেয়েছেন। খুবই সাবধানে মাটি খনন করে বের করে আনা এই হারটির বয়স ২০ হাজার বছর বলে ধারণা করা হচ্ছে। খবর রয়টার্স-এর।
বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন প্রাচীন যুগের ডিএনএ বের করার জন্য তারা এক নতুন পদ্ধতির আশ্রয় নিয়েছেন, যার মাধ্যমে তারা এই হারের মালিককে বের করতে পেরেছেন। রাশিয়ার আলতাই পর্বতমালার পাদদেশে সাইবেরিয়ার পূর্বাঞ্চলের কাছে বসবাস করা এক 'শিকারী-সংগ্রহকারী' গোত্রের সাথে সম্পর্কিত প্রস্তর যুগের এক নারীই জীবিতাবস্থায় এই হার পরেছিলেন।
এই পদ্ধতির মাধ্যমে হাড় আর দাঁতের মতো পদার্থের ভেতর থেকে (ক্ষুদ্রাকার ফুটোযুক্ত এমন কঠিন পদার্থ যার ভেতর দিয়ে তরল বা বায়ু প্রবাহিত হতে পারে) স্কিন সেল, ঘাম এবং শরীর থেকে নির্গত অন্যান্য তরলে থাকা ডিএনএ আলাদা করা যায়।
ব্যক্তিগত অলঙ্কার হিসেবে প্রাচীনকাল থেকেই হার, ব্রেসলেট থেকে শুরু করে আংটির মতো বস্তু ব্যবহার করা হতো। এই বস্তুগুলো থেকে ইতিহাসের বিভিন্ন পর্যায়ের মানবসভ্যতার আচার-আচরণ ও সংস্কৃতি জানা যেতে পারে। তবে কোনো নির্দিষ্ট বস্তুর সাথে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তির সম্পর্ক জোড়া লাগানো এর আগে সম্ভব ছিল না।
ন্যাচার জার্নালে প্রকাশিত হওয়া গবেষণাপত্রের প্রধান লেখক এবং জার্মানির ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইনিস্টিউট ফর ইভোল্যুশনারি অ্যান্থ্রপোলজি-র মলিকিউলার জীববিজ্ঞানী এলেনা এসেল জানান, "এই বস্তুগুলোকে আমার কাছে খুবই চিত্তাকর্ষক মনে হয়। কারণ এ বস্তুগুলো আমাদের সামনে এক জানালা খুলে দেয়, যার মাধ্যমে আমরা ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে ঘুরে আসতে পারি, সে সময়ের মানুষদের জীবনাচরণ সম্পর্কে জানতে পারি।"
১৯ হাজার থেকে ২৫ হাজার বছরের মধ্যে হারটির বয়স ধারণা করা হচ্ছে। গবেষণার সাথে জড়িত বিজ্ঞানীরা গ্লাভস এবং মাস্ক পরে খুবই সাবধানে হারটিকে বের করে আনেন, যাতে এর সাথে আধুনিক ডিএনএ না মিশে যেতে পারে। এর ফলে এটি হয়ে উঠলো প্রাগৈতিহাসিক যুগের প্রথম বস্তু, যার সাথে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে সংযোগ করা সম্ভব হয়েছে। তবে প্রাগৈতিহাসিক যুগের সেই নারী এই হারটি বানিয়েছিলেন নাকি শুধু পরেছিলেন, তা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়নি।
এসেল জানান, যখন তিনি হারটি তার গ্লাভস পরা হাত দিয়ে ধরেছিলেন তখন তার অনুভূতি ছিল: "আমি যেন প্রাচীন এক সময়ে চলে গিয়েছি, কল্পনা করছিলাম কে এই হারটি বানিয়েছে এবং কয়েক হাজার বছর আগে এই জিনিসটি পরেছে।"
"আমি যখন বস্তুটির দিকে তাকিয়ে ছিলাম, আমার মনে অনেক প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিলো। কে এই হারটি বানিয়েছে? এটি কি এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে হস্তান্তরিত হয়েছিল? যদি হয়ে থাকে, তাহলে কি মায়ের কাছ থেকে মেয়ের কাছে গিয়েছিল নাকি বাবার কাছ থেকে ছেলের কাছে? আমাদের কাছে যে জেনেটিক প্রযুক্তি আছে, তা দিয়ে এ ধরনের প্রশ্নের উত্তর খোঁজার কাজ আমরা শুরু করতে পারবো ভেবেই অবাক লাগছে।"
হারটির তৈরিকারক এল্কের দাঁতের মাঝখানে ছোট একটি ফুটো করেন সুতার মতো কোনো বস্তু ঢুকিয়ে দেওয়ার জন্য, যেটি এখন হারিয়ে গেছে।
গবেষণাটির সিনিয়র প্রত্নতত্ত্ববিদ মেরি সোরেসি জানান, আফ্রিকায় প্রায় তিন লক্ষ বছর আগে আমাদের হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতির উদ্ভব হয়, যেখান থেকে পরবর্তীতে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে তারা। ব্যক্তিগত অলঙ্কার হিসেবে ব্যবহার করা এখনো পর্যন্ত সবচেয়ে পুরনো বস্তু পাওয়া যায় সেই আফ্রিকাতেই, যার বয়স প্রায় এক লক্ষ বছর।
বিলুপ্ত হওয়া মানব প্রজাতি ডেনিসোভান, নিয়ানডারথাল এবং আমাদের স্যাপিয়েন্স প্রজাতি বিভিন্ন সময়ে সাইবেরিয়ার ডেনিসোভা গুহাটি ব্যবহার করেছে। গুহাটি থেকে প্রায়ই গুরুত্বপূর্ণ সব প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার খুঁজে পাওয়া যায়, যার মধ্যে রয়েছে ডেনিসোভানদের ব্যবহার্য প্রথম আবিষ্কৃত অবশেষসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ।
নতুন পদ্ধতির মাধ্যমে প্রত্নতাত্ত্বিক বস্তুটির কোন কিছু নষ্ট করা হয়না। লাইপজিগের 'ক্লিন রুম' ল্যাবরেটরিতে প্রয়োগ করা এই পদ্ধতির সাথে ওয়াশিং মেশিনের সাথে তুলনা করা যায়। কাপড় থেকে যেমন ওয়াশিং মেশিন ময়লা বের করে ফেলে, তেমনিভাবে একটি তরল দ্রবণে প্রত্নবস্তুটিকে ডোবানো হয়, যেটি বস্তুটি থেকে ডিএনএ-কে বের করে ফেলে।
প্রত্নবস্তু থেকে নির্দিষ্ট ব্যক্তির ডিএনএ পাওয়া গেলে সেটি বিশ্লেষণ করে আরও অনেক বিষয় জানা যেতে পারে, যার মধ্যে রয়েছে প্রাগৈতিহাসিক যুগের সামাজিক ভূমিকা কিংবা সে সময়ের সমাজের লিঙ্গভিত্তিক কাজের বিভাগ। এছাড়া এটি আদৌ স্যাপিয়েন্স প্রজাতির কারোরই তৈরি কিনা তা সম্পর্কেও নিশ্চিত হওয়া যাবে। এর আগে এমন কিছু জায়গা থেকে প্রত্নবস্তু আবিষ্কার হয়েছে, যেখানে হোমো স্যাপিয়েন্স এবং নিয়ান্ডারথালরা একাধারে বাস করতো।
সোরেসি জানান, "এই গবেষণা পূর্বেকার সময়ের মানুষের লিঙ্গ ও তাদের বংশের ওপর ভিত্তি করে তাদের সামাজিক ভূমিকা সম্পর্কে জানার এক বিশাল সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে আমাদেরকে।"