হাজার বছরের বিচিত্র, আজগুবি চিকিৎসা
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2023/05/06/ajgubi_chikitsa.jpg)
বিচিত্র ও বিস্ময়কর ওষুধ এবং চিকিৎসাপদ্ধতির ইতিহাস অন্তত দুই হাজার বছরের। প্রশ্ন ও বিতর্ক সৃষ্টি করা এ ধরনের কিছু ওষুধ এবং এসবের প্রয়োগ আলোচনা করা যেতে পারে। এদেশে বাসে-ট্রেনে রাস্তার ধারে জমায়েত মজমায় উত্থানরহিত অঙ্গের জাগরণে জোঁকের তেলের ব্যবহারবিধির রসালো বর্ণনা দক্ষ হকারের মুখে না শোনার কারণ নেই। ওদিকে ইউরোপ আমেরিকাতেও দেদার বিক্রি হয়েছে সাপের তেল, এ কারণে। এর সবটাই ভুয়া এমন নয়, দ্রব্যগুণও অন্যান্য অসুখবিসুখকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করেও থাকে।
বাত থেকে মহৌষধ রেডিয়াম
বিংশ শতকের একটি আবিষ্কার দিয়ে শুরু করি। আমেরিকার আরিজোনা অঙ্গরাজ্যের আর ডব্লিউ টমাস নামের একজন স্টক ব্যবসায়ী কয়েকটি রোগের এক মহৌষধ আবিষ্কার করে বসলেন। রোগগুলোর মধ্যে রয়েছে আর্থরাইটিস, নির্বীর্যতা ও উত্থান অক্ষমতা, পেটের গ্যাস এবং বার্ধক্য। মহৌষধটি হচ্ছে রেডিয়াম আকর।
তিনি রেডিয়াম ও ইউরেনিয়ামের লাইনিং দেওয়া সিরামিকের একটি পাত্র তৈরি করলেন, রেভিগেটর নামের পাত্রটি বাজার পেল। আর ডব্লিউ টমাস তার এই ছদ্মবৈজ্ঞানিক পাত্রটির প্যাটেন্ট রেজিস্ট্রেশন করে নির্মাণ ও বিক্রয়ের অধিকার নিজের হাতে নিলেন।
রেভিগেটরের সাথে নির্দেশনামাও দেওয়া হলো: রাতভর পাত্রভর্তি পানি রেখে সকালে এবং তৃষ্ণার্ত হওয়া মাত্র দিনের যেকোনো সময় পান করলে তা নিরাময় ও মঙ্গল নিশ্চিত করবে। রেভিগেটরের চাহিদা বেড়ে গেল, তিনি উৎপাদন করে কুলিয়ে উঠতে পারছিলেন না। তিনি বড় অঙ্কের অর্থ নিয়ে কালিফোর্নিয়ার ডাও হারমান পাম্প অ্যান্ড মেশিনারি কোম্পানির কাছে স্বত্ব বিক্রি করে দিলেন। একসময় ঘরে ঘরে রেভিগেটর ঢুকে গেল। মাউন্ট সেইন্ট মেরি বিশ্ববিদ্যালয় রেভিগেটর এবং তাতে রাখা পানি পরীক্ষা করল। পানিতে তেজস্ক্রিয় রেডিয়াম ছাড়াও আর্সেনিক ও সিসা পাওয়া গেল। ৯ ইঞ্চি ব্যাসার্ধের ১২ ইঞ্চি উঁচু রেভিগেটরের পানির জন্য হাহাকার পড়ে গেল। ভয়ংকর তেজস্ক্রিয় পাত্রের পানি পান করতে করতে একসময় আমেরিকানদের হুঁশ ফেরে। এক দশকের বেশি সময় আমেরিকার নাগরিকদের যৌবন ও আরোগ্যের ভরসা দিয়ে শেষ পর্যন্ত নিষিদ্ধ হলো রেডিয়াম তেজস্ক্রিয় রেভিগেটর।
মিসেস উইনস্লোর শিশুভোলানো সিরাপ
ঊনবিংশ শতকের আমেরিকার মেইন অঙ্গরাজ্যের ব্যাঙ্গর শহরের মিসেস উইনস্লো একজন বাস্তব নারী, তার নামেই শিশুদের সর্বরোগ সর্ববেদনা হরণ করা সিরাপ মিসেস উইনস্লোর সুদিং সিরাপ। শিশুর কান্নার যত ধরনের কারণ থাকতে পারে—দাঁতব্যথা থেকে শুরু করে পেটব্যথা, কষা থেকে শুরু করে ডায়রিয়া, মাড়ির যন্ত্রণা পেটের বায়ু—সব সারাতে মাত্র ২৫ সেন্ট। মিসেস উইনস্লোর সুদিং সিরাপের দাম মাত্র ২৫ সেন্ট। সদ্যোজাত থেকে ৬ মাস পর্যন্ত ৬ থেকে ১০ ফোটা, ছয়-সাত মাসে আধা চা-চামচ আর তার চেয়ে বড়দের পুরো এক চামচ করে দিনে তিন থেকে চারবার। ম্যাজিকের মতো কাজ হবে। শিশু শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়বে। মায়ের জন্য এর চেয়ে আনন্দের আর কী হতে পারে? শিশুদের জন্য এই ছিল ঊনবিংশ শতকের ওয়াল্ডার ড্রাগ।
মিসেস শার্লট উইনস্লো ছিলেন একজন মিডওয়াইফ নার্স—ধাত্রী নার্স। শিশুদের নিয়েই তার কারবার। নিজেরও কয়েকটি কন্যাসন্তান ছিল। তিনি তার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে শিশুদের শান্ত করার সিরাপ তৈরি করলেন। নিজের সন্তান ও তার রক্ষণাবেক্ষণে থাকা অন্য শিশুদের ওপর প্রয়োগ করলেন। তার এক কন্যাকে বিয়ে করল ফার্মাসিস্ট জেরিমিয়াহ কার্টিস। সেই কন্যার নাম লুসি উইনস্লো। কার্টিস তার ব্যবসায়িক পার্টনার বেঞ্জামিন পার্কিনসকে নিয়ে শাশুড়ির আবিষ্কৃত ওষুধটির উৎপাদন বোতলজাতকরণ ও বিক্রয় শুরু করলেন ১৮৪৫ সালে—একটি ড্রাগস্টোরে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন গেল, ক্যালেন্ডারে সুর্দিং সিরাপের পাশে প্রশান্ত মা ও শিশুর ছবি ছাপা হলো। ইংরেজি, জার্মান ও ফরাসি ভাষায় ছাপা হলো শিশুর দাঁত ওঠার সময় অবশ্য চাই মিসেস উইনস্লোর সিরাপ।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2023/05/06/soothing_syrup.jpg)
মজাদার ও শিশুর নেশা লাগানো এই সিরাপের উপাদান হচ্ছে মরফিন এবং অ্যালকোহল। প্রতি আউন্স সিরাপে ৬৫ গ্রামই শক্তিশালী এই মাদক উপাদান। কোনো কোনো শিশু ওষুধের গায়ে লেখা নির্দেশনা অনুযায়ী দিনে ২৬০ মিলিগ্রাম মরফিন ও অ্যালকোহল সেবন করেছে। কার্টিসও তার পার্টনার মিলিয়নিয়ার হয়ে যায়। শিশুরা এই সিরাপের নামে কী পান করছে, মায়েরা জানতেন না, জানতে আগ্রহীও ছিলেন না—শিশু যখন শান্ত আছে, ওষুধেরও জাদু আছে নিশ্চয়।
এর মধ্যেই একটি-দুটি করে দুঃসংবাদ আসতে শুরু করে—উইনস্লোর সুর্দিং সিরাপ খাওয়ার পর শিশুমৃত্যু! কান্না থামছে, শান্ত হচ্ছে, ঘুমিয়ে যাচ্ছে, তারপর নিস্পন্দ। সংবাদপত্রে ছাপা হলো মিসেস উইনস্নোস সুর্দিং সিরাপে আরও একটি শিশুর জীবনাবসান হলো।
আমেরিকান মেডিকেল জার্নাল লিখল, নিষ্পাপ শিশুহত্যা চলছেই। ১৯১১ সালে সিরাপ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এতে বেবি কিলার মেডিসিন আখ্যা দিল আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন।
সিয়াটলে নিহত দুটি যমজ শিশুকে দেখে শেষকৃত্য সম্পাদনকারী করোনার সন্দেহ করলেন। তিনি ময়নাতদন্ত করালেন তাদের পাকস্থলীতে মরফিন পাওয়া গেল। সিয়াটল টাইমস লিখল, মা যা মনে করেই খাওয়াক, এটা আসলে হত্যাকাণ্ড। ওয়াইয়োমিংয়ে সিরাপ খাওয়া একটি শিশু নিশ্বাস নিতে পারছিল না। একসময় তার শরীর শীতল হয়ে এল। ময়নাতদন্ত বলল, সুর্দিং সিরাপ থেকে মৃত্যু।
১৯০৫ সালে স্যামুয়েল হপকিন্স অ্যাডামস লিখলেন, এই সিরাপ হচ্ছে 'গ্রেট আমেরিকান ফ্রড'। ক্যালিফোর্নিয়ার ড্রাগিস্ট জানালেন, শিশুরা সুর্দিং সিরাপে আসক্ত হয়ে পড়েছে। তিনি লিখলেন, সন্তান হবার পর একজন নারী তার কাছ থেকে সপ্তাহে একটি করে সিরাপ কিনতেন, এখন প্রতি তিন দিনে তাকে এক বোতল কিনতে হচ্ছে। কারণ, শিশুটি আসক্ত হয়ে উঠেছে।
সাংবাদিক স্যামুয়েল অ্যাডামসের লেখাতে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস নড়েচড়ে বসল। তারা বুঝতে সক্ষম হলো আমেরিকাতে মাদক এপিডেমিক শুরু হয়ে গেছে। ১৯০৬ সালে কংগ্রেস পিওর ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাক্ট পাস করল। পরে মিসেস উইনস্লোর বোতল থেকে মরফিন বাদ দেওয়া হলো সুদিং শব্দটি উঠিয়ে দেওয়া হলো। ওষুধের চাহিদা কমল, তারপরও ১৯৩০ দশক পর্যন্ত আমেরিকার ড্রাগস্টোরে মিসেস উইনস্লোস সিরাপ দেখা গেছে। ১৮৬০ থেকে ১৮৬৮-এর একটি হিসাব পাওয়া গেছে, তাতে দেখা যায় প্রতিবছর ১৫ লক্ষ বোতল সিরাপ বিক্রি হয়েছে।
বাংলাদেশেও শিশুর বেদনানাশক গ্রাইপ ওয়াটার একসময় একচেটিয়া বাজার দখল করেছিল। একই অভিযোগ ছিল গ্রাইপওয়াটারের বিরুদ্ধেও।
হাঁপানির সিগারেট
সিগারেট কোম্পানির উৎকোচ গ্রহণ করেছেন বিশেষ করে গলনালি চিকিৎসকগণ। উৎকোচ গ্রহণ করে সিগারেটের বিজ্ঞাপনে মডেলও হয়েছেন। ১৯৩০ থেকে ১৯৫০ দশক পর্যন্ত আমেরিকার ডাক্তারদের কেউ কেউ টোবাকো কোম্পানির সাথে যোগসাজশে সিগারেটের পক্ষে অনেক ওকালতি করেছেন। নিউইয়র্ক স্টেট জার্নাল অব মেডিসিনে বছরের পর বছর চেস্টারফিল্ড সিগারেটের বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছে। বিজ্ঞাপনের মডেল ডাক্তার সাহেব বলেছেন, 'আপনি যে পানি পান করেন, তার মতোই বিশুদ্ধ এই সিগারেট।' জার্নাল অব আমেরিকান মেডিকেল অ্যাসোসিয়েশন ১৯৩৩ সালে তাদের জার্নালে প্রকাশিত সিগারেটের বিজ্ঞাপনে বলা হয়েছে: অত্যন্ত সযত্ন বিবেচনার পর চিকিৎসাকর্মে নিয়োজিত ডাক্তাররা সিগারেট ধরেছেন। এই বিজ্ঞাপন টানা ৩০ বছর ধরে চলেছে।
আর হাঁপানি (অ্যাজমা) ও অনুরূপ শ্বাসকষ্টের রোগীদের বিশেষ ধরনের সিগারেট খাবার প্রেসক্রিপশন তো সেদিনও দেওয়া হয়েছে।
৩১ আগস্ট ১৯০৯ বিখ্যাত ফরাসি ঔপন্যাসিক মার্শেল প্রুস্ত তার শ্বাসকষ্ট ও হাঁপানি নিয়ে মাকে একটি চিঠি লেখেন। অনেক দিন ধরে তিনি ভুগছেন। তাকে আফিম, ক্যাফেইন ও আয়োডিন দেওয়া হয়েছে, তারা বাবা ডক্টর আড্রিয়েন প্রুস্তু তাকে মরফিন ইঞ্জেকশনও দিয়েছেন, বহুবার তার নাক কটারাইজ করা হয়েছে তাকে কেবল দুধনির্ভর খাবার দেওয়া হয়েছে, স্বাস্থ্য নিবাসে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে কিন্তু কোনোটাতেই তেমন কাজ হয়নি। মাকে লিখেছেন, তিনি অ্যাজমা সিগারেটও ফুঁকছেন।
এই সিগারেট তামাকের সাথে মেশানো হয়েছে স্ট্র্যামোনিয়াম, লোবেলিয়া ও পটাশ। স্ট্র্যামোনিয়ামের ধোঁয়া শ্বাসযন্ত্রকে কিছুটা সচল করে—পাশাপাশি কোকেনও চলতে থাকে। অ্যাজমা সিগারেট ব্রিটিশ সংস্কতির অংশ হয়ে ওঠে। বিংশ শতকের মাঝামাঝি নাগাদ বয়স্ক পুরুষদের ৮০ ভাগ এবং নারীদের ৪০ ভাগ সিগারেটনির্ভর হয়ে পড়ে।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2023/05/06/kellogs_asthma.jpg)
ওষুধ হিসেবে থেরাপিউটিক স্মোকিং খ্রিষ্টজন্মের দেড় হাজার বছর আগেও মিসরে চালু ছিল। গ্রিক ও রোমান ডাক্তার হিপ্পোক্র্যাটস ডিওস্কোরিডেস ও গ্যালেন শ্বাসকষ্টের জন্য ধূম্রটানার কথা বলেছেন। ঘন কফ গলিয়ে বের করার জন্য একই ব্যবস্থাপনা দিয়েছেন মধ্য যুগের মুসলমান চিকিৎসক আল রাজি ও ইবনে সিনা। কিতাব আল কানুন ফি আল তিব গ্রন্থে ইবনে সিনা সালফার ও আর্সেনিকসহযোগে ধূম্র গ্রহণের পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু একালে এসে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তামাক হাঁপানি নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে উসকানি দিয়ে থাকে। সুতরাং কথিত অ্যাজমা সিগারেট এখন প্রায় নিষিদ্ধ ধূমপানের পর্যায়ে এসে পড়েছে। বাস্তবে অ্যাজমা সিগারেট লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন শ্বাসজনিত রোগ ও ক্যানসারে বিপন্ন করে ফেলেছে। অথচ ১৯৬০ দশকে ডাক্তারের ব্যবস্থাপত্রে অ্যাজমা সিগারেট লিখিত হয়েছে। এমনই একটি জনপ্রিয় সিগারেট কেলগ অ্যাজমা সিগারেট।
মৃগীরোগ চিকিৎসায় পুরুষের চুল ও হরিণের হাড়
মৃগীরোগীদের চিকিৎসার বিধান 'দ্য বুক অব ফিজিকস'-এ দেওয়া হয়েছে। শক্তিশালী কোনো পুরুষের মাথার চুল এবং হরিণের পায়ের হাড় পাতিলে সেদ্ধ করতে করতে একসময় পাউডারে পরিণত করে রোগীকে নতুন চাঁদের আগমন পর্যন্ত সেই পাউডার খাওয়ানো হোক। মৃগীরোগীর ফিট হয়ে যাওয়ার ব্যাপারে চাঁদের কোনো প্রভাব আছে কি না, এ নিয়ে বিতর্ক ছিল। সর্বশেষ ২০০৪ সালে এপিলেপসি অ্যান্ড বিহেভিয়ার নামক জার্নালের বৈজ্ঞানিক নিবন্ধ 'দ্য ইনফ্লুয়েন্স অব দ্য ফুল মুন অন সিজারফ্রিকোন্সি: মিথ অর রিয়েলিটি' স্পষ্টভাবে বলে দিয়েছে, মৃগী রোগীর অজ্ঞান হবার প্রবণতার সাথে পূর্ণ চাঁদের কোনো সম্পর্ক নেই।
ম্যালেরিয়া সারাতে ম্যাজিক শব্দ অ্যাব্রাকাডাব্রা
ম্যালেরিয়ার অনেক বিস্ময়কর ও আজগুবি চিকিৎসার ইতিহাস পাওয়া যায়। একটি বহুল আলোচিত চিকিৎসা ব্যবস্থা দিয়েছেন তৃতীয় শতকের একজন রোমান চিকিৎসক। রোগীকে বলা হয়েছে একটি কাগজে অ্যাব্রাকাডাব্রা লিখে তার নিচে দুদিকের দুটি অক্ষর বাদে পুনরায় লিখতে, একপর্যায়ে যখন শুধু এ থাকবে, তখন লেখাগুলো ত্রিভুজের আকার ধারণ করবে। তারপর এই কাগজটিকে একটি তার দিয়ে গলায় ঝুলিয়ে ৯ দিন রাখতে হবে। ৯ দিন পর কাগজটিকে পূর্বগামী কোনো নদীর স্রোতোধারায় নিক্ষেপ করতে হবে। এরপরও যদি না সারে রোগীকে সিংহের চর্বি দিয়ে ঘষতে হবে। একালে এই ব্যবস্থাপত্র হাস্যকর মনে হতে পারে কিন্তু সেকালের জন্য এটাই ছিল মহৌষধ। অ্যাব্রাকাডাব্রা লেখা তাবিজ ব্যবহার করতেন রোমান সম্রাট কারাকাল্লা। মনে করা হতো এ কারণেই তিনি কখনো ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হননি। ইউরোপে লোককথায় ম্যালেরিয়া সারাতে এই জাদুশব্দের ব্যবহারের উল্লেখ রয়েছে।
![](https://947631.windlasstrade-hk.tech/bangla/sites/default/files/styles/infograph/public/images/2023/05/06/parod.jpg)
রোম সম্রাটের ব্যক্তিগত চিকিৎসক তার দ্য বুক অব মেডিসিনে তৃতীয় শতকে এই চিকিৎসার কথা লিখে গেছেন। খ্রিষ্টজন্মের ২৭০০ বছর আগের চায়নিজ ক্যানন অব মেডিসিনে ত্রিভুজাকৃতির এই কাগজের কথা বলা হয়েছে। সপ্তদশ শতকে লন্ডন প্লেগের সময়ও আব্রাকাডাব্রা ব্যবহারের নজির পাওয়া যায়। বাস্তবতা হচ্ছে সংগত কারণে সেরে ওঠা রোগীকে মনে করা হয়েছে ম্যাজিকের অনুদান। লিবার ম্যাডিসিনালিস গ্রন্থে (ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে সংরক্ষিত) ম্যালেরিয়া প্রতিষেধক জাদুকরি শব্দের ত্রিভুজের ছবি রয়েছে। বইটি খ্রিষ্টজন্মের প্রায় আড়াইশত বছর আগেকার।
সিফিলিসের মহৌষধ পারদ
মার্কারি পয়জনিং বা পারদ বিষের সাথে পরিচিতি অনেক পুরোনো হলেও সিফিলিস সারাতে পারদের প্রয়োগ বিংশ শতকেও ছিল। ১৯৪৩ সালেই প্রথম সিফিলিস সারাতে পেনিসিলিন ব্যবহার করা হয়। তার আগে প্রায় সাড়ে চার শ বছর সিফিলিসের মহৌষধ হিসেবে এককভাবে রাজত্ব করেছে পারদ। পারদ খাওয়ানো হতো, ক্ষতস্থানে লাগানোও হতো। ব্রিটেনের রয়াল আর্মি মেডিকেল কোর যৌন রোগগ্রস্ত সৈনিকদের জন্য এই ওষুধই পাঠাত। রণাঙ্গণের সৈনিক থেকে শুরু করে বিভিন্ন উপনিবেশে অবস্থানরত ব্রিটিশ সৈনিক ও নাগরিকদের জন্যও এই পারদ বরাদ্দ ছিল। একধরনের মার্কারিয়াল ক্রিমও সরবরাহ করা হতো। ১৮৮৪ সালে পারদের সাথে সিফিলিস চিকিৎসায় বিসমাথ লবণের ব্যবহারও শুরু হয়।
ইবনে সিনার 'ক্যানন অব মেডিসিন' গ্রন্থে (১০২৫ সাল) কুষ্ঠরোগের প্রাথমিক অবস্থায় পারদ প্রয়োগের কথা বলা আছে। সিফিলিসকে সমপর্যায়ের বিবেচনা করেই পারদ ব্যবহারের কথা চিন্তা করা হয়। ১৪৯৬ সালে ইতালির ভেরোনার জিওর্জিও সোমারিভা সিফিলিস রোগে প্রথম পারদ ব্যবহার করেন। তবে মনে করা হয় তিনি প্রকৃতপক্ষে চিকিৎসক ছিলেন না। ষোড়শ শতকে এর ব্যবহার বেড়ে যায়। খাওয়ানো হয় ক্ষত স্থানে মাখানো হয় এবং প্লাস্টারও করা হয়। পারদে আগুন ধরিয়ে তার ধোঁয়া রোগীর দেহে লাগানো হয়। সে সময় মাথা ঢেকে রাখা হতো। পারদ চিকিৎসার ফলে দ্রুত দাঁতের মাড়িতে ঘা হতো এবং দাঁত পড়ে যেত। ১৮৬৯ সালে মার্কারি ইনজেকশন এসে যায়। কলম্বাসের একটি তত্ত্ব হচ্ছে: ঈশ্বর যেখানে যে রোগ দিয়েছেন, তার উপশমের ওষুধও সেখানে দিয়েছেন। সে সময় সিফিলিসে আক্রান্ত ধর্মযাজক ফ্রান্সিসকো ডেলিক্যাডো একটি বিশেষ বৃক্ষের ছাল ব্যবহার করেন, কিন্তু তা কার্যকর মনে না হওয়ায় পারদ চিকিৎসায় ফিরে যান।
এরকম অসংখ্য আজগুবি চিকিৎসার বিবরণ ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ইতিহাসে, গ্রন্থে।