সিলেট সিটি নির্বাচন: আরিফকে নিয়ে বিএনপিতে অস্বস্তি
সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীরকে নিয়ে স্থানীয় বিএনপির নেতাদের মধ্যে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। বিশেষত গত ১ মে আরিফুল হক চৌধুরী 'সিলেটের প্রেক্ষাপটে আমরা নির্বাচনে যাব', এমন বক্তব্য দেওয়ার পর দলের সাথে তার দূরত্ব বেড়েছে। আরিফ প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে চাচ্ছেন সিলেটের বিএনপি নেতারা।
১ মে আরিফুলহ হক নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার ইঙ্গিত দিলেও বিএনপি নেতাদের প্রত্যাশা, এটাই আরিফের শেষ কথা না-ও হতে পারে। শেষ পর্যন্ত আরিফ নির্বাচনে যাবেন না বলেও বিশ্বাস তাদের।
আরিফুল হক চৌধুরী বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। সিটি নির্বাচনে বিএনপি অংশ না নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে। তবে প্রথম থেকেই আরিফুল হকের প্রার্থীতা নিয়ে গুঞ্জন ছিল। আরিফ নিজেও বিভিন্ন সময় বক্তৃতায় প্রার্থী হওয়ার ব্যাপারে ইঙ্গিত দেওয়ায় এ নিয়ে গুঞ্জন আরো ঘনীভূত। এর মধ্যে মে দিবসের অনুষ্ঠানে আরিফুল হক অনেকটা স্পষ্ট করেই সিলেট সিটি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেন।
আরিফের এমন ঘোষণায় তার প্রার্থিতা নিয়ে দীর্ঘ জল্পনা-কল্পনার অবসান হলো বলে মনে করেছিলেন নগরের বাসিন্দারা। তবে বিএনপি নেতাদের ভাষ্য, ১ মে আরিফের দেওয়া বক্তব্য চূড়ান্ত অবস্থান না-ও হতে পারে।
প্রার্থী হওয়ার আভাস দিয়ে আরিফের বক্তব্য প্রসঙ্গে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে সিলেট মহানগর বিএনপির সভাপতি নাসিম হোসাইন বলেন, 'আরিফুল হক নির্বাচনে অংশ নেওয়ার একটা আভাস দিয়েছেন। তবে এখনো স্পষ্ট ঘোষণা দেননি। আমার মনে হয় নির্বাচনী বাজারে আলোচনায় থাকার জন্যই তিনি এমনটি বলেছেন। তবে শেষ পর্যন্ত আরিফ প্রার্থী হবেন না বলেই আমার বিশ্বাস।'
নাসিম হোসাইন বলেন, 'আরিফুল হক বিএনপিতে আমাদের চেয়ে দায়িত্বশীল পর্যায়ে আছেন। তিনি দলের কেন্দ্রীয় নেতা। ফলে দলের অবস্থানের বাইরে যাওয়ার মতো বোকামি তিনি হয়তো করবেন না।'
প্রার্থীতা নিয়ে জল্পনা-কল্পনার মধ্যে মে দিবস উপলক্ষ্যে নগরে বিশাল মহড়া দেন আরিফুল হক চৌধুরী। ১ মে নগরের রেজিস্টারি মাঠে 'জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল ও সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের' ব্যানারে ওই শোভাযাত্রার শুরুতে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, 'আমরা এখন অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে আছি। অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে আগামী সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আমাদের দল (বিএনপি) অংশগ্রহণ করবে না। তবে সিলেটের প্রেক্ষাপটে আমরা নির্বাচনে যাব।'
আরিফ বলেন, 'বিএনপি কেন নির্বাচনে যাবে না তার ব্যাখ্যাসহ কারণ এবং কেন সিলেটের প্রেক্ষাপটে আমরা নির্বাচনে যাব--এ দুটি বিষয়ে জানাতে ২০ মে রেজিস্টারি মাঠে সমাবেশ আহ্বান করেছি। ওই সমাবেশে সবকিছু বিস্তারিত ব্যাখ্যা করে জনগণের কাছে তুলে ধরব।'
তবে প্রার্থী হওয়ার ইঙ্গিত দিলেও এবারের সিটি নির্বাচনকে প্রহসনের নির্বাচন হিসেবে উল্লেখ করে আরিফুল ওই দিন আরো বলেন, 'জাতীয় নির্বাচনে ইভিএম বাতিল করা হয়েছে। অথচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ইভিএমে ভোটগ্রহণ হবে। ইভিএম তাদের মেকানিজমের অন্যতম একটা বিষয়। এতে জনগণ তাদের পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিলেও কারসাজি করে আরেকজনকে জিতিয়ে দেয়া হবে। তাই এটি একটি প্রহসনের নির্বাচন হতে যাচ্ছে।'
প্রার্থী হওয়ার আভাস দিয়ে আরিফুল হকের দেওয়া ওই বক্তৃতায় সিলেট বিএনপিতে তোলপড়া শুরু হয়। এ নিয়ে অস্বস্তি প্রকাশ করেন অনেক নেতা। আরিফুল হক সরকারের উচ্চ পর্যায়ের সমর্থন নিয়ে প্রার্থী হতে পারেন এমন গুঞ্জনও রয়েছে বিএনপিতে। তবে প্রকাশ্যে তারা এ ব্যাপারে কিছু বলতে চাননি।
বিএনপির মধ্যম সারির একাধিক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আরিফুল হকের সাথে মন্ত্রী-এমপিসহ সরকারের শীর্ষপর্যায়ের লোকদের সখ্যতা দীর্ঘদিন ধরেই বিএনপি পর্যবেক্ষণ করছে। সরকারের পক্ষ থেকে তাকে প্রার্থী হওয়ার প্রলোভন দেখানো হচ্ছে। সিলেটে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতো আরেকটি 'উকিল সাত্তার মডেলের' নির্বাচন করতে পারে সরকার। এমন অবস্থায় আরিফ সরকারের প্রলোভনে পা দিলে তা বিএনপির চলমান আন্দোলনের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে।
তবে আরিফ ঘনিষ্ঠ বিএনপিএকাধিক নেতাও জানিয়েছেন, দলে 'সম্মানজনক' কোনো পদ দেয়া হলে শেষ পর্যন্ত আরিফুল হক প্রার্থী না-ও হতে পারেন। তাকে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির ভাইস চেয়ারম্যান বা যুগ্ম মহাসচিব পদ দেওয়ার ব্যাপারে আলোচনা হচ্ছে বলেও জানিয়েছেন এই নেতারা।
এই নেতারা জানান, ইভিএম নিয়ে আরিফুল হকের মনে শঙ্কা রয়েছে। ফলে সুষ্ঠু ভোট নিয়েও তিনি শঙ্কিত। এছাড়া প্রার্থী হলে দলে অবস্থান হারাতে হবে। এসব বিবেচনা করেই সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে তাকে।
এ প্রসঙ্গে বিএনপির চেয়ারপার্সনের উপদেষ্টা ও গত সংসদ নির্বাচনে সিলেট-১ আসনে বিএনপির প্রার্থী খন্দকার আব্দুল মুক্তাদির বলেন, দেশের ৫টি সিটিতে নির্বাচন হচ্ছে। কোথাও বিএনপি অংশ নেবে না। সিলেট তার থেকে আলাদা কিছু নয়। ফলে সিলেটে আলাদাভাবে নির্বাচনে অংশ নেয়ার কিছু নেই।
আরিফুল হকের বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, 'কেউ ব্যক্তিগতভাবে কিছু বলে থাকলে এটা তার বিষয়। তার বক্তব্যকে দলীয়ভাবে দেখার সুযোগ নেই।'
আরিফুল হক প্রার্থী হলে তা বিএনপির চলমান সরকারবিরোধী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে আন্দোলনে কোনো প্রভাব ফেলবে কি না জানতে চাইলে মুক্তাদির বলেন, 'আমি দলীয় অবস্থান ব্যাখ্যা করতে পারি। কোনো ব্যক্তির অবস্থান নিয়ে মন্তব্য করতে রাজি নই।'
এ প্রসঙ্গে সিলেট বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক ডা. সাখাওয়াত হোসেন জীবন বলেন, 'আরিফুল হক চৌধুরী কী বলেছেন তা আমার জানা নেই। তবে কোনলনো সিটি নির্বাচনেই বিএনপি যাবে না। এমনকি বিএনপি নেতারা কাউন্সিলর পদেও প্রার্থী হবেন না।'
নির্বাচনী তফসিল অনুযায়ী ২১ জুন সিলেট সিটি করপোরেশনে ভোটগ্রহণ হবে। এতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হচ্ছেন দলটির যুক্তরাজ্য শাখার যুগ্ম সম্পাদক মো. আনোয়ারুজ্জামান চৌধুরী।
সিলেট সিটিতে ২০১৩ ও ২০১৮ সালের সর্বশেষ দুটি নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে মেয়র নির্বাচিত হন আরিফুল হক চৌধুরী। এবার আওয়ামী লীগের আনোয়ারুজ্জামান ছাড়াও জাতীয় পার্টির মহানগর শাখার আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম বাবুল, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক মাহমুদুল হাসান ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সিলেট মহানগর শাখার সহসভাপতি মাওলানা আব্দুল্লাহকে মেয়র প্রার্থী ঘোষণা করা হয়। এছাড়া এ পর্যন্ত ৩ জন স্বতন্ত্র প্রার্থী মনোনয়ন সংগ্রহ করেছেন।