দক্ষ পাইলটের অভাবে দেশের প্রধান শিপিং রুটে বাড়ছে নৌ-দুর্ঘটনা
জাহাজ চলাচলের জন্য পর্যাপ্ত গভীরতা ও প্রশস্ততা থাকা সত্ত্বেও চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলে নৌ-যাতায়াতের প্রধান রুট চট্টগ্রাম-চরগজারিয়া রুটে নৌ-দুর্ঘটনা একটি সাধারণ ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রথম শ্রেণির এই রুটে নিয়মিত দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হলো দক্ষ পাইলটের অভাব। নৌযান পারপারের জন্য প্রয়োজনীয় পাইলট নেই বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডাব্লিওটিএ); সেইসঙ্গে তারা আরও জানান, নিয়ম না মানার প্রবণতা এবং বিআইডাব্লিওটিএ'র যথাযথ মনিটরিংয়ের অভাবে দুর্ঘটনা ঘটছে।
গত ৭ বছরে প্রায় সাত শতাধিক দুর্ঘটনা ঘটেছে চট্টগ্রাম-চরগজারিয়া রুটে। এ বছরের মার্চই ঘটেছে দুটি দুর্ঘটনা। গত ৭ মার্চ প্রগতি গ্রিন লাইন–১ জাহাজের ধাক্কায় রোকনুর–১ নামে একটি জাহাজ দুই হাজার টন সিমেন্ট ক্লিংকারসহ ডুবে যায়। এটি উদ্ধারে নিয়োজিত বার্জের প্লটুনের সঙ্গে ধাক্কায় গত ২৫ মার্চ ডুবে যায় এমভি প্রাইম লেইকস-০১ নামে আরেকটি জাহাজ। এছাড়া, ২৭ মার্চ হাতিয়ার নলছিরা ঘাট পার হওয়ার পর তলা ফেটে ডুবে গেছে এমভি হেমা-০৩ নামে আরেকটি জাহাজ।
বেসরকারি লাইটার জাহাজ পরিচালনা সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) নির্বাহী পরিচালক মাহবুব রশিদ খান দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এই রুটে দক্ষ পাইলটের প্রয়োজন। বিআইডাব্লিওটিএকে কোটি কোটি টাকা ফি দেওয়া হলেও পাইলট পাচ্ছি না।"
১০০ পাইলটের চাহিদার বিপরীতে বর্তমানে ১৩ জন স্থায়ী ও ১৩ জন স্থায়ীসহ মোট ২৬ জন পাইলট আছে বিআইডাব্লিওটিএ'র। সবমিলে ৬৯ জন পাইলট নিয়োগের অনুমোদন পেলেও অস্থায়ী পাইলটদের করা রিটের কারণে ঝুলে আছে প্রক্রিয়াটি।
কনভয় প্রক্রিয়ায় (একজন পাইলটকে অনুসরণ করে তার পেছনে ১০-১২ জাহাজ চালানো) পণ্যদ্রব্যসহ মালামাল পার করা হয় নিয়মিত। আকার অনুসারে জাহাজে বিভিন্ন শ্রেণিও পাইলট দ্বারা পরিচালনার বিষয়টিও মানা হয় না।
অথচ ১৯৬৯ সালের পাইলট অ্যাডিন্যান্স অনুসারে, এই রুটকে বাধ্যতামূলক পাইলট সার্ভিসের আওতাভুক্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। অর্থাৎ, এই রুটে চলাচলকারী সব ধরনের নৌযান বিআইডাব্লিওটিএ'র পাইলটের দ্বারা পরিচালিত হবে।
এছাড়া ক্লাসিফিকেশন সোসাইটির নিয়ম অনুযায়ী, জাহাজ নির্মাণ না করা, ওভার লোড, ফিটনেস বিহীন জাহাজ, সাগরে সিগনাল অমান্য করে জাহাজ পরিচালনা এবং জোয়ারের অপেক্ষা না করে ভাটার সময় নৌযান চালাতে গিয়ে চরের সঙ্গে আটকে তলা ফেটে গিয়েও দুর্ঘটনা ঘটে। এসব তদারকির দায়িত্বে থাকা সংস্থাগুলোর অবহেলা রয়েছে বলে অভিযোগ আছে।
বিআইডব্লিউটিএর পূর্ব ব-দ্বীপ অঞ্চলের সদ্য অবসারপ্রাপ্ত পাইলট সুপারভাইজার মো. মোতালেব দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ডকে বলেন, "এই রুটে ট্রিপের চাহিদা রয়েছে। অনেক সময় মাস্টাররা ভাটার জন অপেক্ষা করে না। চ্যানেলের কিছু স্থানে ভাটার সময় গভীরতা কম থাকে। সেখানে অপেক্ষা না করে জাহাজ চালালে বটম ফেটে যায়। এছাড়া অনেক সময় কনভয়ের জন্য অপেক্ষা না করে জাহাজ চালালেও দুর্ঘটনা ঘটে।"
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিওটিএ) এবং বেসরকারি লাইটার জাহাজ পরিচালনা সংস্থা ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট সেলের (ডব্লিউটিসি) তথ্যমতে, ২০১৬ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন ২৯টি জাহাজ ডুবেছে এই রুটে। চট্টগ্রাম-চরগজারিয়া রুটে বাল্কহেড ডুবেছে প্রায় ৪০টি। আর বিভিন্ন শিল্প গ্রুপ এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন জাহাজ ডুবির ঘটনা রয়েছে অন্তত ২৫টি। ২০২১ ও ২০২২ সালে অন্তত ১৫টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। ২০২৩ সালে এ পর্যন্ত ঘটেছে চারটি দুর্ঘটনা।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য নিয়ে দেশের বিভিন্ন নৌ রুটে চলাচল করে ২ হাজার জাহাজ। একটি জাহাজ ডুবে গেলে ৫-১০ কোটি টাকা পর্যন্ত ক্ষতি হয় বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
বিআইডাব্লিওটিএর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বর্তমান গড়ে প্রতিদিন ১০০-১২০টি জাহাজ যাতায়াত করে এই রুটে। এসব জাহাজ পরিচালনাসহ নৌবাহিনী ও বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের জন্য পূর্ব বদ্বীপ অঞ্চলে (চট্টগ্রাম অঞ্চল) অন্তত ১০০ পাইলট প্রয়োজন।
কিন্তু বর্তমানে সংস্থাটির একটি মাস্টার পাইলট সুপরভাইজার, ৩২টি ঊর্ধ্বতন মাস্টার পাইলট ও ৫টি মাস্টার পাইলট পদ মিলে মোট ৩৮টি পদ রয়েছে। সর্বশেষ ২০১৮ সালে ৫ জন পাইলট নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। দৈনিক ভিত্তিতে অস্থায়ী নিয়োগে থাকা পাইলটরা নিয়োগের দাবিতে মামলা করায় নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়া বন্ধ রয়েছে।
বিআইডব্লিউটিএর নৌ সংরক্ষণ ও পরিচালন বিভাগের যুগ্ম পরিচালক মো. সবুর খান টিবিএসকে বলেন, "মোট ৬৯টি পদে নিয়োগের ব্যাপারে দপ্তর থেকে একটি অনাপত্তিপত্র দেওয়া হয়েছে। তবে ৩৮টির মধ্যে শূন্য পদগুলো পূরণ করতে হবে। এখন নিয়োগ দিতে হলে প্রবিধান মানতে হবে। পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিতে হবে। কিন্তু অস্থায়ী পাইলটরা তাদের চাকরি স্থায়ী করার দাবিতে আদালতে রিট করেছেন। তাই নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত আছে।"
জাহাজের ফিটনেসসহ সার্বিক বিষয় দেখভাল করে মার্কেন্টাইল মেরিন অফিস (এমএমও)। এই দপ্তরের চট্টগ্রাম কার্যালয়ের প্রিন্সিপাল অফিসার ক্যাপ্টেন সাব্বির মাহমুদ টিবিএসকে বলেন, "এই রুটে চ্যানেলের প্রকৃতি নিয়মিত পরিবর্তন হয়। এগুলো নিয়মিত মনিটরিং করা বিআইডাব্লিওটিএর দায়িত্ব। তাদের পাইলট সংকট রয়েছে। এটি দুর্ঘটনার অন্যতম একটি কারণ।"
"তাদের পাইলট সংকট থাকলে নিয়োগ দিতে হবে। না হয় প্রাইভেটদের প্রশিক্ষণ দিতে পারে। অথবা অন্য কোনো উপায় বের করতে হবে।"
"সমুদ্রে চলাচল করতে হলে আমাদের অফিস থেকে ছাড়পত্র নিতে হয়। আমরা পরিদর্শন-তদারকি করে সনদ দিয়ে থাকি। অনেকে ঢাকা থেকে ডিজি শিপিংয়ের ছাড়পত্র নিয়ে আসে। অর্থাৎ, নদীতে চলাচলের অনুমতি নিয়ে অনেক নৌযান সমুদ্রেও নেমে যায়। এখানে আইন-কানুন ঠিকভাবে মানা হচ্ছে না," যোগ করেন তিনি।