নতুন ৩ জাতের বাঁশ উদ্ভাবন করেছে বাংলাদেশ
বাড়ি নির্মাণ ও কাগজসহ বিভিন্ন পণ্য উৎপাদন বাঁশ ব্যাপকভাবে ব্যবহার হয়। তবে বাঁশের চারা তৈরি অনেক দীর্ঘ প্রক্রিয়া বলে এর চাষ চ্যালেঞ্জিং।
বাঁশ চাষের প্রক্রিয়া সহজ করতে বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএফআরআই) দুই দশক আগে একটি গবেষণা প্রকল্প নেয় টিস্যু কালচার ব্যবহার করে দ্রুত চারা উৎপাদনের জন্য। এ গবেষণার পথ ধরেই বিএফআরআই নতুন তিন জাতের বাঁশ উদ্ভাবন করেছে, যা প্রথাগত জাতের চেয়ে ভালো মানের।
গত বছরের ১৪ আগস্ট পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের গঠিত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটির সভায় গবেষণার ফলাফল যাচাই-বাছাই ও মূল্যায়ন করা হয়। এরপর নতুন তিন জাতের বাঁশের নিবন্ধনের বিষয়ে সুপারিশ করা হয়।
পরে ২০২২ সালের ১৬ আগস্ট অনুষ্ঠিত বিএফআরআইয়ের উপদেষ্টা কমিটির সভায় নতুন জাতের বাঁশগুলোর নিবন্ধনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়। বর্তমানে নিবন্ধনের আবেদনটি কৃষি মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে।
যেভাবে উদ্ভাবন হলো নতুন জাতের বাঁশ
বাংলাদেশ বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে, বাঁশের চারা তৈরি বা চাষ অনেক দীর্ঘ প্রক্রিয়া। কোনো কোনো প্রজাতির বাঁশের ফুল আসতে ২০ থেকে ৬০ বছর পর্যন্ত সময় লাগে। এজন্য বর্তমানে কঞ্চি কলম পদ্ধতিতে চারা তৈরি করা হয়।
বৃহৎ পরিসরে আধুনিক পদ্ধতিতে চারা তৈরির জন্য বিএফআরআই ১৯৯১ সাল থেকে টিস্যু কালচার ল্যাব চালু করে। আর এ আধুনিক পদ্ধতিতে বরাক, মাকলা ও করজবা বাঁশের চারা তৈরি করতে গিয়ে নতুন তিন প্রজাতির উদ্ভাবন করেন গবেষকরা।
বন গবেষণা ইনস্টিটিউটের সিলভিকালচার-জেনেটিক্স বিভাগের ল্যাবের গবেষকরা ২০০২ সালে বরাক বাঁশের টিস্যু কালচার প্রটোকল সম্পন্ন করেন। পরে তারা ২০০৪ সালে মাকলা বাঁশ এবং ২০০৫ সালে করজবা বাঁশের টিস্যু কালচার প্রটোকল সম্পন্ন করেন।
গবেষকরা লক্ষ করেছেন, নতুন জাতের এই বাঁশের চারাগুলোর রূপগত (মরফোলজিক্যাল) বৈশিষ্ট্য মূল প্রজাতির থেকে আলাদা।
২০০৫ সালে গবেষকরা পাবনা, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অভ ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সেস এবং বান্দরবানে মাঠ পর্যায়ে নতুন এই জাতগুলোর পরীক্ষামূলকভাবে রোপণ করেন।
বাঁশের জাতগুলো সফলভাবে বেড়ে ওঠার পর নতুন প্রজাতি হিসেবে স্বীকৃতির বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওযা হয়। জাতগুলোর নাম দেওয়া হয়—বিবি১ (বরাক বাঁশ থেকে), বিএন১ (মাকলা বাঁশ থেকে) এবং বিএস১ (করজবা বাঁশ থেকে)।
গবেষণায় নেতৃত্ব দিয়েছেন সিলভিকালচার জেনেটিক্স বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা ড. মো. মাহবুবুর রহমান। তিনি টিবিএসকে বলেন, 'বাঁশ জাতগুলোর মাতৃগুণাগুণ অক্ষুণ্ণ রেখে নতুন প্রজাতির উদ্ভাবন করা হয়েছে। মাঠ পর্যায়ে ট্রায়ালের প্রজাতিগুলোর উৎপাদনশীলতা, অঙ্গবৈশিষ্ট্য মূল্যায়ন করা হয়েছে।
'নতুন প্রজাতির বাঁশগুলোর প্রজনন হার কয়েকগুণ বেশি। বেঁচে থাকার হার শতভাগ এবং রোগমুক্ত।'
সিলভিকালচার-জেনেটিক্স বিভাগের সিনিয়র রিসার্চ অফিসার ড. ওয়াহিদা পারভীন টিবিএসকে বলেন, 'টিস্যু কালচারের প্রটোকল উদ্ভাবনের পর দেশের কয়েকটি স্থানে চারাগুলো লাগানো হয়েছে। এরপর সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত মানুষদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে পরিচর্যার বিষয়ে।
'মাঠ পর্যায়ে চারা রোপণের পর প্রতি দুই বছর পরপর বেড়ে ওঠার তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। দেখা গেছে— নতুন প্রজাতির বাঁশের ঝাড় ঘন, উচ্চতা বেশি এবং পরিণত হতে সময়ও কম লাগে।'
টিস্যু কালচারে আরো ১৫ প্রজাতির বাঁশ
বাঁশ সংরক্ষণ ও চাষ সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রামের ষোলোশহরে বন গবেষণা ইনস্টিটিউট নিজস্ব ক্যাম্পাসে পাঁচ একর জমিতে বাঁশ উদ্যান গড়ে তোলে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সব প্রজাতির বাঁশের সংগ্রহশাশা সৈয়দ মুর্তজা হাসান ব্যাম্বু সেন্টার গড়ে তোলা হয়েছে এখানে। বর্তমানে ৩৭ প্রজাতির বাঁশ রয়েছে এখানে। বাঁশের প্রজাতি সংরক্ষণের পাশাপাশি বাঁশঝাড় ব্যবস্থাপনা, চারা উৎপাদন, বীজ সংরক্ষণ ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবেও কাজ করছে উদ্যোনটি।
ড. ওয়াহিদা পারভীন বলেন, গবেষণার মাধ্যমে বাঁশের গুণগত মান অক্ষুণ্ণ রেখে ১৫ প্রজাতির বাঁশ টিস্যু কালচারে আনা সম্ভব হয়েছে। আরো পাঁচটি এখন পাইপলাইনে আছে। নতুন প্রজাতির উদ্ভাবনেও গবেষণা চলছে।
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) 'গ্লোবাল ব্যাম্বু রিসোর্সেস' শিরোনামে গবেষণা প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৫০০ প্রজাতির বাঁশ নিয়ে পৃথিবীতে প্রথম স্থানে অবস্থান চীনের। দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ব্রাজিলের রয়েছে ২৩২ প্রজাতি। তালিকায় ১৩৯ প্রজাতি নিয়ে তৃতীয় স্থানে রয়েছে জাপান। বাংলাদেশে আছে ৩৩ প্রজাতির বাঁশ।